সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

স্যার, আমরা সবাই ধর্ষিত, আমরা ধর্ষকের বিচার চাই।



শুনতে মনে হবে কোন নাটক কিংবা উপন্যাসের সংলাপের অংশবিশেষ।তবে এটি একটি সত্য সংলাপ বটে। সত্য সংলাপে একঝাঁক   ভিকটিমের সরল স্বীকার উক্তির মাঝে অপরাধীর বিচারের দাবিতে বুলন্দ কণ্ঠে প্রতিবাদী উচ্চারণ।ঘটনাটি ১৯৯৮ সালের। দিনটি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এক ন্যাক্কারজনক অধ্যায়। তৎকালীন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সালাম বরকত হলের আবাসিক ছাত্র এবং নাটক ও নাট্যতত্ত্বের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা জসীম উদ্দীন মানিক এ ঘটনার মূল হোতা। এই মানিক প্রায় ১০০ জন ছাত্রীর ইজ্জত নষ্ট করে জাহাঙ্গীরগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সালাম বরকত হলের কমন রুমে নির্ভয়ে মিষ্টি বিতরণের মাধ্যমে তা উদযাপন করা শুরু করে। এ খবর ক্যাম্পাসে  ছড়িয়ে পড়লে প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা চলে আসে প্রশাসনিক ভবনে। স্লোগানে স্লোগানে উত্তপ্ত বিক্ষুব্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শান্ত করতে এগিয়ে আসেন তৎকালীন ভিসি। তিনি বলেন, আমি তোমাদের কথা মতো ব্যবস্থা নেব তবে তার আগে তোমাদের কাছে একটা জিনিস জানতে চাই? আমাদের কাছে যে অভিযোগ জমা পড়েছে সেখানে অভিযোগকারীর নাম আছে কিন্তু সে ভিকটিমের নাম নাই। এভাবে আমরা কিভাবে বিচার করবো? তোমরা আমাকে বল, তোমাদের মধ্যে কে ধর্ষিতা( কি সর্বনাশা কথা ) ? তখন উপস্থিত থাকা সব ছাত্রী এক সঙ্গে বলে উঠল, ‘স্যার, আমরা সবাই ধর্ষিত, আমরা ধর্ষকের বিচার চাই’। কিছুক্ষণ নির্বাক থেকে উপাচার্য নিশ্চয়তা দেন, তিনি এর বিহিত করবেন। পরে এর বিচার আচার কি হয়েছে আমাদের জানা নেই।গতকাল নতুন করে ছাত্রলীগ দ্বারা ছাত্রী নিপীড়নের ঘটনায় বিষয়টি সামনে আসছে।  বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে নারী শিক্ষার্থীরা কতটুকু নিরাপদ? বিশেষ করে ছাত্রীরা যখন ছাত্রলীগের নির্ভুল টার্গেট। গতকাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা আরেকটি ন্যাক্কারজন ঘটনার জন্ম দিয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসির পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি মাহাথির মোহাম্মদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।এসময় তাকে বাঁচাতে এগিয়ে যান সরকার ও রাজনীতি বিভাগের স্নাতকোত্তরের ছাত্রী মারিয়াম রশিদ ছন্দা। এ সময় ক্ষিপ্ত হয়ে ছাত্রলীগের এক কর্মী মারিয়ামের পেটে লাথি মারেন। এতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে হামলার শিকার ছন্দা এসময় মাটিতে শুয়ে কাতরাছিলেন। তার সহপাঠী বন্ধু ও অন্যরা তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়।অনুরূপ ঘটনা আগেও ঘটেছিল। এবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের ছাত্র ফরিদ হাসানকে  মেরে রক্তাক্ত করে ছাত্রলীগ। এ ঘটনায় হল প্রশাসনকে লিখিত অভিযোগ দিতে গেলে   হামলা ও নির্যাতনের শিকার হন ছাত্র ফেডারেশনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি উম্মে হাবিবা বেনজির। এসময় ডাকসুর ভিপি নুর, ভিপি প্রার্থী অরণি সেমন্তি খানসহ অন্যদের ওপরও হামলা চালানো হয়।তারা ঐদিন সন্ধ্যায় ফরিদকে মারধরের ঘটনার লিখিত অভিযোগ প্রভোস্টকে জানাতে এসএম হলে যান। হলের নিচে অপেক্ষা করছিল নুর। তিনি ফরিদকে নিয়ে তার রুমে যান রক্তমাখা ড্রেস পাল্টানোর জন্য। সেসময় এসএম হল ছাত্রলীগের ছেলেরা তাদেরকে বিভিন্ন অশালীন ভাষায় গালিগালাজ করে এবং এক সময় ছাত্রলীগের ছেলেরা তাদের ডিম ছুঁড়ে মারে। এরপর তারা এস এম হলের মূল গেটে অবস্থান নেয়। নুর ভেতরে অবরুদ্ধ ছিল। ভেতর থেকে নুরসহ অন্যরা যখন বের হয়, তখন ছাত্রলীগের হল শাখার নেতৃবৃন্দ তাদের পেছনে পেছনে আসতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা এলোপাথাড়ি লাথি, কিল ঘুষি শুরু করে। ছাত্রলীগের নেতারা তাদের উদ্দেশ করে বলে, ‘এরে ধর ধর’! আরেকজন বেনজিরের পেটে লাথি মারে।এসব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের গায়ে হাত তুলে কেউ কখনো ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। তার জ্বলন্ত প্রমাণ ফখরউদ্দীনের সরকার।এর আগে গভীর রাতে ঢাবির  শামসুর নাহার হলে ছাত্রীদের পুলিশি নির্যাতনের দায়ে ক্ষমতায় থাকতে পারেনি তৎকালীন ঢাবির ভিসি আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী। আজ সব যেন গা-সওয়া ব্যাপার স্যাপার হয়ে গেছে। ইচ্ছে করলেই ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারা ছাত্রীদের গায়ে হাত তুলতে পারে, গালি দিতে পারে, পেটে লাথি দিতে পারে।যার প্রমাণ ওপরে অবাঞ্চিত ঘটনাসমূহ।এসব ঘটনায় ভিকটিমের বিচার না পাওয়াটাও দুঃখজনক। কি অদ্ভুত কান্ড!  নারীদের সুরক্ষার কত আইন আছে, কত নারীবাদী সংগঠন আছে।  তারা আজ নিশ্চুপ, অনেকটা নির্বাক। নেই তাদের বিবৃ‌তি, প্রতিক্রিয়া কিংবা কোনো প্রতিবাদী কর্মসূচী। এসবের বিচার না হওয়ায় অপরাধীরা বেপরোয়া হচ্ছে, এসবে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। এদের লাগাম টেনে ধরা কি সরকারের দায়িত্ব নয়? গত বছর জানুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে ছাত্রলীগ সাধারণ ছাত্রীদের উত্যক্ত ও শারীরিকভাবে  হেনস্থা করে।ছাত্রী উৎপীড়নকারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থায় নেয়নি বরং আন্দোলনকারীদের বিভিন্নভাবে হুমকি ধামকির মধ্যে রাখে। যদি উপরিউক্ত  একটি ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হতো তাহলে আজ এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতো না। নারী শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত তোলার মতো দু:সাহস কোনো পুরুষের হতো না। বাঁধন মেয়েটির পরিধেয় বস্ত্র হরণের মতো পীড়াদায়ক ঘটনাও কখনো ঘটতো না।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

মো.আবু রায়হান:  কিয়ামত সংঘটিত হবার  পূর্বে হযরত ঈসা (আ.) এর সঙ্গে দাজ্জালের জেরুজালেমে যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধে ইহুদিরা দাজ্জালের পক্ষাবলম্বন করবে। হযরত ঈসা (আ.) দাজ্জালকে হত্যা করবেন।এদিকে  ইহুদিরা প্রাণ ভয়ে পালাতে চেষ্টা করবে।  আশেপাশের গাছ ও পাথর/ দেয়ালে আশ্রয় নেবে। সেদিন গারকাদ নামক একটি গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে। গারকাদ ইহুদীবান্ধব গাছ।গারকাদ একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হল কাটাওয়ালা ঝোঁপ।গারকাদ এর ইংরেজী প্রতিশব্দ Boxthorn। Boxএর অর্থ সবুজ ঝোঁপ এবং thorn এর অর্থ কাঁটা। এ ধরনের গাছ বক্সথর্ন হিসেবেই পরিচিত। এই গাছ চেরি গাছের মতো এবং চেরি ফলের মতো লাল ফলে গাছটি শোভিত থাকে।  ইসরায়েলের সর্বত্র বিশেষত অধিকৃত গাজা ভূখন্ডে গারকাদ গাছ ব্যাপকহারে  দেখতে পাওয়া যায়।ইহুদিরা কোথাও পালাবার স্থান পাবে না। গাছের আড়ালে পালানোর চেষ্টা করলে গাছ বলবে, হে মুসলিম! আসো, আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। আসো এবং তাকে হত্যা কর। পাথর বা দেয়ালের পিছনে পলায়ন করলে পাথর বা দেয়াল বলবে, হে মুসলিম! আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে, আসো! তাকে হত্যা কর। তবে গারকাদ নামক গাছ ইহুদিদেরকে ...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

উটের যুদ্ধ ইসলামের প্রথম ভাতৃঘাতি যুদ্ধ

#মো.আবু রায়হান উটের যুদ্ধ বা উষ্ট্রের যুদ্ধ বা জামালের যুদ্ধ ( Battle of the Camel) ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ইরাকের বসরায় সংঘটিত হয়। এটি ইসলামের ইতিহাসের প্রথম গৃহযুদ্ধ।এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী এর বিরুদ্ধে হযরত তালহা-জুবায়ের ও আয়েশা (রা)সম্মলিত যুদ্ধ। পটভূমি হযরত ওসমান (রা) এর বিভিন্ন প্রদেশে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগ নিয়ে একদল তার বিরুদ্ধে অভিযোগ টেনে বিদ্রোহ শুরু করে।হযরত ওসমান বিভিন্নভাবে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন। তাদের কথামত মিশরের গভর্নরকে প্রতিস্থাপন করে আবু বকরের ছেলে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর কে নিয়োগ করলেও বিদ্রোহীরা শান্ত হয় নি। তারা নানাভাবে অভিযোগ টেনে এনে ওসমান (রা) এর অপসারণের দাবী করতে থাকে। ওসমান সবকিছু মীমাংসার আশ্বাস দিলেও তারা ৬৫৬ সালের ১৭ জুন তারা বাড়ি অবরুদ্ধ করে এবং এক পর্যায়ে তারা তার কক্ষে প্রবেশ করে কুরআন তেলাওয়াত করা অবস্থায় হত্যা করে।ওসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডের পর আলী (রা.) খলিফা হন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে যখনই আলী (রা.) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন তখনই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবের কার...