পাকিস্তান আমলের ছাত্রলীগ এবং বর্তমানের ছাত্রলীগ
ছাত্রলীগের অসামান্য অবদানের ইতিহাসে পাঠে একসময় অভিভূত হয়ে পড়তাম। অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের গল্প বলে গৌরবান্বিতবোধ করতাম ।কিন্তু বর্তমানে ছাত্রলীগের কিছু নেতা কর্মীর কর্মকান্ড দেখলে তাদের দানবীয় শক্তির মতো কিছু একটা মনে হয়। এই প্রজন্ম ছাত্রলীগের দানবীয় রূপটা দেখেই বড় হচ্ছে। তাদের কাছে ছাত্রলীগ মানে আতঙ্কিত হবার মতো কিছু। বুয়েটের আবরার হত্যাকান্ডের পর ছাত্রলীগের জনপ্রিয়তা এখন তলানীতে। আর্থিক কেলেঙ্কারি, চাঁদাবাজির কারণে ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতার অব্যাহতি এবং সব মিলে এখন এই সংগঠনের কুৎসিত চেহারাটায় ভেসে উঠছে। ঢাকা পড়ে গেছে গৌরবোজ্জ্বল অতীতের অবদানগুলো ।খুব সহসাই ছাত্রলীগ নিজেদের এসবব কুকর্ম থেকে বের হতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে ছাত্রলীগের অভিভাবক সংগঠন আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকায় ছাত্রলীগের রুগ্ন দশা হতে দেবে না বলেই আমার বিশ্বাস।১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা কমিশন আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং ১১ দফা আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় স্বাধীকার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের উদ্দেশ্যে ছাত্রলীগ মুজিব বাহিনী গঠন করে, যুদ্ধে অংশগ্রহন করে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভূমিকা পালন করে।এখানে স্মরণ করে দেওয়া প্রয়োজন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে সাড়ে ১৭ হাজার ছাত্রলীগের নেতাকর্মী জীবন দিয়েছেন।একাত্তর পূর্ববর্তী ছাত্রলীগের ছিল গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা তৎপরবর্তী ছাত্রলীগের ভূমিকা জনমনে প্রশ্নবিদ্ধ ও যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক করেছে। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের একটানা প্রায় এগারো বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার এ সময়ে ছাত্রলীগের কার্যক্রমে সরকার যেমন বিব্রত হয়েছে জনগণ তেমনি হয়েছে ভুক্তভোগী। ছাত্রলীগ প্রায় সময় ধর্ষণ,অপহরণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, ভর্তি-বাণিজ্য, শিক্ষক লাঞ্ছনা, সাংবাদিক-পুলিশের ওপর হামলা, খুন, লুটপাট,ইভটিজিং, যৌন সন্ত্রাস সহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য হয়েছে পত্রিকার শিরোনাম। স্বাধীনতার পর স্বৈরশাসক এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা পালন ছাড়া ছাত্রলীগের ইতিবাচক কোনো কর্মকান্ড চোখে পড়ে না। বরং আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকার সময় এবং ক্ষমতার বাইরে ছাত্রলীগ জড়িয়েছে নানা ইতিবাচক কার্যকলাপে।১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা দুর্ধর্ষ ক্যাডার জসিমউদ্দিন মানিক ১০০ ছাত্রীকে ধর্ষণের সেঞ্চুরি উৎসব পালন করেছিল। ছাত্রলীগের নামধারী নেতা কর্মীদের দ্বারা ২০০০ সালে থার্টি ফাস্ট নাইটে ঢাবির টিএসসিতে বাঁধন নামে একটি মেয়ের বস্ত্র হরণ করে নিউ ইয়ার পালন করেছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বেশ কিছু নিষ্ঠুর ও নৃশংস ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ছাত্রলীগের নাম। গণমাধ্যমের সংবাদ অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে কোন্দলে নিহত হয়েছে ৩৯ জন।এই সময়ে ছাত্রলীগের হাতে প্রাণ হারায় বিরোধীমতের প্রায় ১৫ জন।
২০০৯ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের একাংশের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আসাদ ওরফে রাজীবকে হত্যা করে লাশ বহুতল ভবন থেকে ফেলে দেওয়া হয়। ২০১০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কর্মী নাসরুল্লাহ নাসিমকে নিজ সংগঠনের কর্মীরাই মারধর করে বহুতল ভবন থেকে ছুড়ে ফেলে হত্যা করেন। ২০১০ সালে স্যার এ এফ রহমান হলে সিট দখলকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র আবুবকর সিদ্দিক। একই বছর ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে মারা যান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মেধাবী ছাত্র জুবায়ের আহমেদ। ২০১২ সালে বিরোধী দলের হরতাল চলাকালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ছাত্রলীগ নেতাদের চাপাতির আঘাতে প্রাণ হারায় দরজি বিশ্বজিৎ দাস।২০১৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাবির ঐতিহ্যবাহী সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী দ্বারা নির্যাতিত হন এহসান রফিক।এতে তার চোখের কর্ণিয়া মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।শেষ পর্যন্ত ছাত্রলীগের হুমকি ধামকির কারণে দেশত্যাগে বাধ্য হন এহসান । বর্তমান সে মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত।
২০১৮-র কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হওয়ার পর ৯ই এপ্রিল ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মিছিল করে এবং বিভিন্ন সময় আন্দোলকারীদের উপর হামলা চালায়।রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নির্মমভাবে কোটা সংস্কারের একজন ছাত্রকে হাতুড়িপেটা করে আহত করে।
শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের কোনো কাজেই ছাত্রলীগকে খুঁজে পাওয়া না গেলেও বারবার তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ন্যায্য আন্দোলনে হামলা চালিয়েছে । কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের মতো আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর করার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নুরুল হকের ওপর ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অন্তত সাতবার হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ।সর্বশেষ ছাত্রলীগ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসার কারণ হলো বুয়েট তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে হত্যা। শিবিরের সাথে তার সংশ্লিষ্ট থাকা নিয়ে সন্দেহ করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা তাকে পিটিয়ে হত্যা করে।ফেসবুকে আবরারের একটি পোস্টের কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে। যে পোস্টে আবরার ভারতের সাথে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কিছু চুক্তির সমালোচনা করেছিল।এসব জঘন্য ঘটনা সংগঠনটিকে করেছে বিতর্কিত ও করেছে সাধারণ শিক্ষার্থী বিমুখ। চরিত্রহীন লোভী নেতৃত্ব সংগঠনকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারে না। নির্লোভ সত্যিকার বঙ্গবন্ধুর আদর্শে নিবেদিত নেতৃত্ব পারে প্রায় সত্তর বছরের পুরনো সংগঠনটির ইমেজ ফিরে দিতে। কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে ছাত্রলীগের বাধা প্রদান সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে সংগঠনটির ইমেজ সংকট তৈরি করেছে।
এতো পুরনো সংগঠনটির আদ্যোপান্ত পর্যবেক্ষণ করলে কৃতিত্ব অবদান বর্তমানের বীভৎস কার্যক্রমের কারণে আবরণে ঢাকা পড়েছে। কখনো কখনো এই ছাত্রলীগ ও বঙ্গবন্ধুর হাতে তৈরি ছাত্রলীগের মিল খুঁজতে গিয়ে মনে খটকা লাগে! এটি কি সেই সংগঠন যে সংগঠন একটি দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ছিল সম্মুখ সমরে! এটি কি সেই সংগঠন যে সংগঠনটি মায়ের ভাষা আদায়ে অকুতোভয়! তবে সেই সংগঠনের নেতৃত্বের কেন এই বেহাল দশা? জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠের সব জায়গায় আজ আমরা ছাত্রলীগকে পাচ্ছি। পাচ্ছি ধর্ষণের সেঞ্চুরিতে, তরুণীর বস্ত্র হরণে, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ অনৈতিক কার্যকলাপে!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন