সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সবার বিচার চাওয়ার অধিকার আছে, পাবার অধিকার নেই

আমরা আবরার ফাহাদের জন্য যে ন্যায় বিচার পাবো না তা অনেকেটাই নিশ্চিত।এর পেছনে যৌক্তিক অনুমান আছে।পূর্বে ঘটে যাওয়া  এরকম বীভৎস দুটো ঘটনা এখানে উপস্থাপন করলে বিষয়টি পরিস্কার হবে।ঘটনা দুটো হলো বিশ্বজিৎ ও ঢাবি শিক্ষার্থী আবুবকরের হত্যাকান্ডের ঘটনা। দুটো ঘটনায় মামলা হয়েছিল কিন্তু সেই  গুরুত্বপূর্ণ মামলার বিচারের নামে আমরা প্রহসন দেখেছি।গত এক দশকে বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘর্ষে দুই ডজন শিক্ষার্থী নিহত হবার খবর আমরা জানি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি), বুয়েট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ (চবি) দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে রাজনৈতিক সহিংসতায় লাশ হয়েছেন এসব শিক্ষার্থী। লেজুড়ভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের আধিপত্য বিস্তার, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি মূলত এসব হত্যাকান্ডের প্রধান কারণ।
এসব হত্যাকান্ডের অধিকাংশই বিচার হয়নি। অপরাধীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আবরার ফাহাদের যে সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত হবে না তার প্রধান  কয়েকটি কারণ হতে পারে, নিম্নোক্ত ঘটনা গুলো,
প্রথমত :প্রথমেই আবরার হত্যাকান্ডের সিসিটিভির ফুটেছ গায়েব বা নষ্ট করে আবরার  হত্যাকান্ডের  মূল হোতাদের আড়ালের চেষ্টা।
দ্বিতীয়ত : আবরার হত্যাকান্ডে অংশ নেওয়া অন্যতম অভিযুক্ত অমিত সাহাকে  গ্রেফতার না করা ও অভিযুক্তদের তালিকায় তার নাম থাকা। আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় ১৯ জনকে আসামি করা হয়েছে।এই মামলা থেকে রহস্যজনক ভাবে বাদ পড়েছে আবরার হত্যাকান্ডের অন্যতম অভিযুক্ত বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের আইন বিষয়ক উপ সম্পাদক অমিত সাহা। খোঁজ নিয়ে জানা যায় সে শেরে- বাংলা হলের ২০১১ নং রুমে থাকতো যে রুমে আবরারকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আবরারের একাধিক সহপাঠী অভিযোগ করে বলেন, এই হত্যাকান্ডের সাথে আমিত সাহা সরাসরি সম্পৃক্ত কিন্ত রহস্যজনকভাবে মামলার এজহার থেকে তার নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। পত্র পত্রিকা ও টেলিভিশনেও তার সমপৃক্ততার খবর প্রচারিত হলেও তাকে এখনো আইনের আওতায় আনা হয়নি।
তৃতীয়ত: দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি।
চতুর্থত: আগেই বলেছি আলোচিত আবু বকর ও বিশ্বজিৎ হত্যার সুষ্ঠু বিচার না হওয়া ও অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত না করতে পারা। আজ বিচার ব্যবস্থা হয়েছে সক্রেটিসের বহুল আলোচিত বাণীর ন্যায়,
'যার টাকা আছে তার কাছে আইন খোলা আকাশের মত, আর যার টাকা নেই তার কাছে আইন মাকড়ষার জালের মত!'এবার আসি আবু বকর ও বিশ্বজিতের মামলা ও বিচার প্রসঙ্গে। 
বর্তমান সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের এক বছরের মাথায় ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নির্মমভাবে নিহত হন ঢাকা  বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের মেধাবী ছাত্র আবু বকর। ঘটনার পর  হলের আবাসিক ছাত্র ওমর ফারুক বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটির তদন্ত শেষে এফ রহমান হল শাখার তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি সাইদুজ্জামান ফারুকসহ আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় শাহবাগ থানার পুলিশ।
পরে বাদীর নারাজি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে সিআইডি মামলাটির অধিকতর তদন্তের ভার নেয় এবং ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়। তাতে আগের আটজনসহ আরও দুজনকে অভিযুক্ত করা হয়। আসামীদের সবাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ছিলেন। কিন্তু এই হত্যা মামলার রায়ে ছাত্রলীগের সাবেক ১০ নেতাকর্মীর সবাই পরবর্তীতে বেকসুর খালাস পান।বড় বিস্ময়কর ব্যাপার হলো মামলার রায় হওয়ার আট মাস পর গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়।এ মামলার রায়ের বিষয়ে নিহত আবু বকরের বাবা-মা, এমনকি বাদীকে রায় সম্পর্কে কিছুই জানানো হয়নি।এই হলো বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা ও অপরাধীর শাস্তি!
দ্বিতীয় বহুল আলোচিত ঘটনা ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ১৮ দলের অবরোধ কর্মসূচির দিনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে  বাহাদুর শাহ পার্কে দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎ দাসকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।যে হত্যাকান্ডের দৃশ্য গোটা জাতিকে হতবিহবল ও বিস্মিত করেছিল। এ ঘটনায় আটজনের মৃত্যুদন্ড ও ১৩ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বড়ই কষ্টের খবর কি জানেন? মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত দুজন ও যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ১১ জনই পলাতক। এ হচ্ছে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘটা বহুল আলোচিত দুটো হত্যাকান্ডের বিচার। তাহলে আবরারের ক্ষেত্রে আমরা কি বিচার পেতে পারি। আদৌও কি সুষ্ঠু বিচার পাবো? আপাতত বলতে হয় না পাবো না। কেননা উপরে আলোচিত মামলা দুটোর আসামী আর আবরার খুনের আসামিরা একই ঘরানার ও শক্তি সামর্থ্যের অধিকারী। আমরা পারি স্লোগান দিতে, অপরাধীর শাস্তি দাবি করতে কিন্তু বাকি কাজ আদালতের। আমরা We want justice বলে স্লোগান দিয়ে মুখে ফেনা তুলতে পারি কিন্তু ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে পারি না।আবরার খুনের  আসামিকে যখন পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায়, কি দেখলেন? হাসি খুশি জলি মুডে। এরপরও আপনারা ন্যায় বিচারের স্বপ্ন দেখেন?এদেশে সবার বিচার চাওয়ার অধিকার আছে কিন্তু বিচার পাবার অধিকার নেই।শেষ করি হযরত আলীর একটি উক্তি দিয়ে, 'রাজ্যের পতন হয় দেশ হতে সুবিচার উঠে গেলে, কারণ সুবিচারে রাজ্য স্থায়ী হয়। সুবিচারকের কোন বন্ধুর দরকার হয় না। ”তবে আশা করি বিশ্বজিৎ ও আবুবকরের প্রতি এ রাষ্ট্র যে অবিচার ও নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে আবরারের ক্ষেত্রে তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। রাষ্ট্র আবরারের খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করে মানবিকতা ও ন্যায় বিচারের নজির উপস্থাপন করবে। আমাদের যাবতীয় অনুমান ও ধারণা ভুল প্রমাণিত করবে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...