সাম্প্রতিককালে ইসকন বিতর্ক এবং কিছু কথা
হাজার বছর ধরে হিন্দু মুসলমানদের সহাবস্থানের তীর্থস্থান এ বাংলাদেশ। ইদানিং শকুনের দৃষ্টি পড়েছে এদেশের ওপর।আজ হিন্দু মুসলমান সদ্ভাব রুখতে ও সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য বিনষ্টে দেশি বিদেশী কিছু কুচক্রীমহল সক্রিয়। যারা সুযোগ পেলেই বিষাক্ত সর্প দংশনের মতো ছোবলে দেশটাকে অস্থিতিশীল করে তুলবে। দেশের স্বাধীনতা নস্যাৎ করতেও চেষ্টা করবে । এদেশের হিন্দু -মুসলমানদের পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বন্ধন কারো কারো কাছে ঈর্ষার জন্ম দিয়েছে। এক্ষেত্রে তারা হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে বিভেদের উসকানি দিয়ে ফায়দা লুটতে চায়। সাম্প্রতিক সময়ে ভোলায় মহানবী (সা.) কে অবমাননা করে ফেসবুকে দেওয়া পোস্ট তৎপরবর্তীতে পাঁচ মানুষের শহীদ হবার ঘটনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশে কে কতটা নিরাপদ তা নিয়ে নতুন করে ভাবনা দেখা দিয়েছে। কিছুদিন আগে চট্রগ্রামে মুসলমানদের কাছে ইসকনের কার্যক্রম নিয়ে নেতিবাচক ধারণা জন্ম দিয়েছে। ২০১৯ সালে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্কুলে ইসকন ফুড ফর লাইফের খাবার বিতরণ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। যেখানে দেখানো হয়েছে শিশুদের খাওয়ানোর পূর্বে হরে কৃষ্ণ, হরে রাম বলা হচ্ছে।এ ঘটনা শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সীমাবদ্ধ থাকেনি । যা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। প্রসাদ খাইয়ে শিক্ষার্থীদের ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ মন্ত্র পাঠ করার ঘটনাকে ‘অন্যায়’ বলে মন্তব্য করে হাইকোর্ট। তবে সামাজিক মাধ্যমে প্রসাদ খাওয়ানোর খবর ছড়ালে ইসকন বিবৃতি দেয়।বিবৃতিতে বাংলাদেশে হিন্দু ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেই স্বাস্থ্যসম্মত খাবার বিতরণ করা হয়েছে বলে তারা দাবি করে। বিবৃতিতে তারা বলে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার শুধুমাত্র একটি স্কুলে হিন্দু ছাত্রছাত্রীরা ‘হরে কৃষ্ণ’ মন্ত্র বলেছে।ইসকন দাবি করে তারা শুধু হিন্দুদের মাঝেই ধর্মীয় প্রচারণামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। যদিও কথাটি শতভাগ সত্য নয়।ইসকনের মন্দিরগুলোতে যেকোনো ধর্মের যেকোনো বয়সের ক্ষুধার্ত লোক গিয়ে দিনের পর দিন বিনামূল্যে খাবার খেতে পারে। তারা আর্তমানবতার সেবায় কাজ করে এবং তাদের ফুড ফর লাইফ অর্থাৎ জীবনের জন্য খাদ্য কর্মসূচির আওতায় তারা সারা বছর বিভিন্ন দারিদ্র্যপীড়িত এলাকাতে গিয়ে ক্ষুধার্ত মানুষের মধ্যে নিয়মিত খাদ্য বিতরণ করে। যদিও এসব সেবার আড়ালে ইসকন তাদের মতাদর্শ প্রচার করে থাকে। ইসকন নিয়ে সারা দেশে আলোচনা সমালোচনা হবার আরো কিছু কারণ রয়েছে। ইসকনের ধর্মগুরু তথা নেতৃবৃন্দের সাথে বাংলাদেশের প্রশাসনের বিভিন্ন আমলা ও সরকারি কর্মকর্তাদের কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু কি তাই? এদেশের প্রভাবশালী কিছু রাজনীতিবিদ, ভারতপন্থী বুদ্ধিজীবী এবং ইসলামবিদ্বেষী ও নাস্তিক বলে পরিচিত মানুষগুলোর অন্তরঙ্গ ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে। সেসব ছবিতে ইসকনের ধর্মগুরুরা নিজেদের মন্দিরে বাংলাদেশের উপরিউক্ত ব্যক্তিদের সংবর্ধনা দিচ্ছে। আবার ইসকনের ধর্ম গুরুরা ওই সব ব্যক্তিদের অফিসে গিয়ে সাক্ষাৎ করেছে। ছবিতে ইসকন নেতাদের অঙ্গভঙ্গি, হাস্যোজ্জ্বল চেহারা এবং ফল-ফুলের সম্ভার উপহার উপঢৌকন দেখে বোঝা যায়, তাদের মধ্যে চমৎকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক-সমঝোতা বা বোঝাপড়া রয়েছে। এসব ছবি বাংলাদেশে ব্যাপক হারে প্রচার হওয়ার পর ইসকন সম্পর্কে মানুষের নেতিবাচক ধারণা বাড়তে থাকে। সর্বশেষ বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা কান্ডের পর ইসকন নিয়ে আবার আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়। আবরার হত্যার সঙ্গে ইসকন জড়িত বলে চতুর্দিকে চাউর হতে থাকে। যদিও বিষয়টি তদন্তের দাবি রাখে। বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যাচ্ছে পুলিশ প্রশাসন ও অনেক সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে ইসকনের সম্পৃক্ততা তথা যোগাযোগ রয়েছে। যদি ঘটনাটি সত্যি হয়ে থাকে তা হবে জাতির জন্য দুঃসংবাদ। ২০০৯ সালের হিসেব অনুযায়ী, সারা বিশ্বে ইসকনের ৫০০০০ টিরও বেশি মন্দির এবং কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে ৬০টি খামার সংগঠন ৫৪টি বিদ্যালয় ও ৯০টি ভোজনালয়। বাংলাদেশে শতাধিক ইসকনের মন্দির রয়েছে।ইংরেজিতে আইএসকেসিওএন (ISKCON) শব্দের পুরো রূপটি হলো The International Society for Krishna Consciousness .যা আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ একটি হিন্দু বৈষ্ণব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান।পাশ্চাত্যে হরে কৃষ্ণ মুভমেন্ট বা হরে কৃষ্ণ আন্দোলন নামে পরিচিত। ১৯৬৬ সালে নিউ ইয়র্ক সিটিতে অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন।ইসকন প্রতিষ্ঠায় সেই সময় অধিকাংশ হিন্দুই তার বিরুদ্ধচারণ শুরু করে। কিন্তু সেই সময় স্বামী প্রভুপাদের পাশে এসে দাড়ায় জে. স্টিলসন জুডা, হারভে কক্স, ল্যারি শিন ও টমাস হপকিন্স-এর মত চিহ্নিত ইহুদী-খ্রিস্টান এজেন্টরা। ইসকন গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের অনুগামী। উক্ত মতটি খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে প্রবর্তিত হয়। এ সংগঠনটির মৌলিক মতবাদ মধ্যযুগের শ্রী চৈতন্য’ থেকে আগত। চৈতন্য’র অন্যতম থিউরী হচ্ছে- “নির্যবন করো আজি সকল ভুবন”। যার অর্থ- সারা পৃথিবীকে যবন মানে মুসলমান মুক্ত করো।১৯৩০-এর দশক থেকে পাশ্চাত্য সমাজে ধর্মান্তরণের কাজ শুরু করে।উইকিপিডিয়ার মতে ইসকন হিন্দু ধর্মভিত্তিক সংগঠন। ভক্তিযোগ এই সংগঠনের মূল উপজীব্য। স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণকে তুষ্ট করাই এই প্রতিষ্ঠানের ভক্তদের জীবনের মূল লক্ষ্য বলে বিবেচিত হয়। অতি অল্প সময়ের মধ্যে সংগঠনটি ব্যাপক পরিচিত লাভ করে । ইসকন প্রচার করছে, তাদের ধর্মে বর্ণিত ৩৩ কোটি দেবতার মধ্যে প্রধান দেবতা হলো কৃষ্ণ। তাদের মতে কৃষ্ণ হলো আদি ও একক দেবতা। কৃষ্ণ থেকেই বাকি দেবতাদের সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীতে মানবরূপে যত দেবতা এসেছেন, তারা সবাই কৃষ্ণের অবতার বা কৃষ্ণজাত সৃষ্টি। ইসকনের হরে কৃষ্ণ মতবাদের সাথে কোনো হিন্দু সংগঠনই একমত নয়। হিন্দুরা সেই অনাদিকাল থেকে শিবকেই প্রধান দেবতা মেনে আসছে। সুতরাং হরে কৃষ্ণ মতবাদ পুরো হিন্দুইজমের ওপরই আঘাত হেনেছে বলে হিন্দুরা অভিযোগ করছে।বাংলাদেশে সনাতন মন্দিরগুলো দখল করা এবং সনাতনদের মেরে পিটিয়ে তাড়িয়ে দেয়া। যেমন স্বামীবাগের মন্দিরটি আগে সনাতনদের ছিলো, পরে ইসকনরা কেড়ে সনাতনদের ভাগিয়ে দেয়। এছাড়া পঞ্চগড়েও সনাতনদের পিটিয়ে এলাকাছাড়া করে ইসকনরা। ঠাকুরগাও-এ সনাতন হিন্দুকে হত্যা করে মন্দির দখল করে ইসকন। মূলত ইসকন হিন্দু বেশধারী ইহুদিবাদের উগ্র সংগঠন বলে ধারণা করা হচ্ছে,আবু রুশদের লেখা---“বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক প্রধানদের কথা- বাংলাদেশে ‘র’ বইয়ে লেখা আছে-“ইসকন নামে একটি সংগঠন বাংলাদেশে কাজ করছে। এর সদর দফতর নদীয়া জেলার পাশে মায়াপুরে। মূলতঃ এটা ইহুদীদের একটি সংগঠন বলে জানা গেছে। এই সংগঠনের প্রধান কাজ হচ্ছে বাংলাদেশে উস্কানিমূলক ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি।”. (বই- বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক প্রধানদের কথা- বাংলাদেশে ‘র’ পৃষ্ঠা:১৭১)।
ইসকন তাদের মতবাদকে অর্থবিত্ত, ক্ষমতা, সঙ্গীত-বিনোদন এবং খাদ্য-পানীয় দিয়ে অত্যন্ত আকর্ষণীয় পণ্যরূপে মাশরেক থেকে মাগরেব এবং আমেরিকা থেকে জাগরেব পর্যন্ত জনগোষ্ঠীর দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছে দিচ্ছে একটি মাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে, আর তা হলো- সবাই সমস্বরে গেয়ে উঠুক! হরে কৃষ্ণ! হরিবল।
ষাটের দশকের হতাশাগ্রস্ত পশ্চিমা সমাজে যোগব্যায়াম অনুশীলন এবং ধ্যান করার প্রাচীন ভারতীয় রীতিকে হরে কৃষ্ণ কীর্তনের সুরে অনেকের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলে ইসকন।
মার্কিন পপ তারকাদের কল্যাণে আরো অনেক বিখ্যাত তারকা, মডেল, প্রভাবশালী লোকজন এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিরা ইসকন সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ফলে ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা অভয় করনারাভিন্দকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। যে অভয় একদিন শূন্য হাতে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে পা রেখেছিলেন, সেই তিনি ধর্মের নামে এত বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেন, যার বর্তমান মূলধন দেখে দুনিয়া কাঁপানো সফল ব্যবসায়ীরা পর্যন্ত হতবাক হয়ে পড়লেন। বর্তমানে ইসকন নামের প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন মন্দির, ধ্যানগৃহ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং তীর্থকেন্দ্রের মাধ্যমে সারা দুনিয়ার শত শত দেশের বিভিন্ন স্থানে নিজেদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে যাচ্ছে। তারা তাদের মন্দিরে কীর্তন-ভজন প্রভৃতি গান গেয়ে নিজেদের ধর্মাচার চর্চা করে। তাদের পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অনাথ আশ্রমে দরিদ্র ও অসহায় ও দুস্থ ছেলেদেরকে আশ্রয় দেয়া হয় এবং শিক্ষিত করে গড়ে তোলা হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি কোম্পানি অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস যখন গরীব ছিলেন তখন তিনি প্রায়ই হরে ইসকনের কৃষ্ণ মন্দিরে গিয়ে খাবার খেতেন বলে তিনি স্বয়ং বহু বক্তৃতায় তা উল্লেখ করেছেন।২০০৫ সালে স্টিভ জবস এক বক্তৃতায় বলেছিলেন“I didn’t have a dorm room, so I slept on the floor in friends’ rooms, I returned coke bottles for the 5¢ deposits to buy food with, and I would walk the 7 miles across town every Sunday night to get one good meal a week at the Hare Krishna temple."
ইসকন মূলত একটি উগ্রপন্থী সংগঠন। তাদের কার্যক্রম বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও ধর্মের জন্য চ্যালেঞ্জ। এই সংগঠনের পেছনে পৃষ্ঠপোষক কারা এদের উদ্দেশ্যইবা কি? তা খুঁজে বের করা সরকারের কর্তব্য। ইসকনের কার্যক্রম বাংলাদেশে হিন্দু মুসলমানের সহাবস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।আপনি যদি অতি সরলভাবে ইসকনের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করেন, তবে দেখতে পাবেন- তারা নিজেদের সনাতন ধর্মের অনুসারী বলে। তারা হরে কৃষ্ণ নামের গুণকীর্তন করে এবং হিন্দু ধর্মের বিধানাবলির আলোকে জীবন পরিচালনা করে। কিন্তু তারা উগ্রবেশধারী।
সত্য কথা
উত্তরমুছুন