আবরারের মৃত্যু দেশপ্রেমের চেতনায়
ছুটির দিন। ছুটির দিন বলে লেটে ঘুম থেকে উঠা। মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে ফেসবুকে ঢুঁ মারতেই মনটা বিষন্নতায় ভরে গেল। কষ্টটা বাড়তে লাগল। নিউজ ফিডে কি দেখছি? শিবির সন্দেহে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর আবরার ফাহাদ নামে একজন শিক্ষার্থীকে পিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ বিতর্কিত’ ফেইসবুক পেজে লাইক দেওয়া এবং তার শিবির সম্পৃক্ততার প্রমাণ’ মিলেছে বলে বুয়েট ছাত্রলীগের দাবি। আজকাল বাংলাদেশে সস্তা অপবাদ হলো শিবির বলে কাউকে চালিয়ে দিতে পারলেই বাজিমাত। আর কি লাগে? মানসিক ভাবে তাকে বিপর্যস্ত করতে পারলেন, এরপর শারীরিকভাবে আঘাত করবেন কেউ আপনাকে কিছু বলবে না। কারণ সবচেয়ে বড় পরিচয় সেই ব্যক্তি শিবির, স্বাধীনতা বিরোধী। তাকে ইচ্ছেমতো কিলঘুষি দিয়ে ওপারে পাঠিয়ে দিলেও আপনার কিছু হবে না। কারণ আপনি হিরো। আপনি একজন সাচ্চা দেশপ্রেমিক খেতাবধারী। আপনার সাত খুন মাফ।কারণ ওরা শিবির, হিংস্র হায়েনা। মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় আগে মানুষ, মানবিকতা। তারপর না হয় ধর্ম, দল, রাজাকার, শিবির ইত্যাদি পরিচয়। মানবতার পরিচয় দেই অন্তত। শিবির হলে আইন আছে, আদালত আছে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী আছে। তাদের হাতে সোপর্দ করুন। কিন্তু শিবির অপবাদ দিয়ে জন্তু জানোয়ারের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে মানুষ মারার অধিকার আপনাদের কে দিয়েছে? যাকে তাকে শিবির টেগ দেওয়ার অপচেষ্টা শুরু হয়েছে। এসব ভালো কোনো লক্ষণ নয়। এমনকি এদেশে মুক্তিযোদ্ধাকে পর্যন্ত রাজাকার বলার সাহস অনেকের হয়েছে। কিন্তু তার কোনো প্রতিকার হয়নি। কেননা রাজাকার, শিবির এবিষয়গুলো খুবই সেনসেটিভ এদেশে। মনে রাখবেন,
“একবার রাজাকার মানে চিরকাল রাজাকার; কিন্তু একবার মুক্তিযোদ্ধা মানে চিরকাল মুক্তিযোদ্ধা নয়। ”
(হুমায়ূন আজাদ)
ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ' If you want to kill a dog give him a bad name then kill him?'
এ কথার উৎকৃষ্ট প্রমাণ বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ড থেকে গতকাল হতভাগা আবরার ফাহাদের খুন। ঠান্ডা মাথায় খুন।বোবার শত্রু নেই। আবরার যদি দেশ নিয়ে না ভাবতো, চুপচাপ থাকতো তাহলে হয়তো তাকে এ বীভৎস মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হতো না। গতরাতে অাবরারকে মারধরের সময় উপস্থিত ছিল বুয়েট ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক আশিকুল ইসলাম বিটু, উপ আইন সম্পাদক অমিত সাহা, ক্রিয়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক শ্রী অনিক সরকারসহ আরো অনেকে।
ময়নাতদন্তে আবরারের দেহে আঘাতের অনেক চিহ্ন পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক। তার শরীরে অনেকগুলো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। আবরারকে স্ট্যাম্প, বাঁশ, লাঠি মতো ফাঁপা কিছু দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে। তার হাতে, পায়ে এবং পিঠে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে । আঘাতের কারণে রক্তকরণে সে মারা গেছে। আবরার ঢাবি এবং মেডিকেলেও ভর্তির সুযোগ পেয়েছিল। সব সুযোগ উপেক্ষা করে প্রকৌশলী হবার স্বপ্ন তাকে বুয়েটে টেনেছিল। হয়তো তার ইচ্ছে ছিল দেশ গড়ার কাজে নিজেকে বাপৃত রাখতে পারবে।কিন্তু ছাত্র নামের কুলাঙ্গারদের থাবায় সব থমকে দাঁড়িয়ে গেল। নিথর দেহ নিয়ে ওপারে ভালো থাকার অপেক্ষা এখন সে প্রহর গুনছে। এ দেশের নরপিশাচ তাকে বাঁচতে দিল না। গুজব বা সন্দেহ নিয়ে কিছুদিন আগে সরকার সরব ছিল। পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এতে ছেলে ধরা সন্দেহে অসংখ্য মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এদেশের জনগণ সেসব ঘটনা ভুলে যায়নি। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে শিবির সন্দেহে গুজবে একজন নিরীহ নিরপরাধ শিক্ষার্থীকে রুম থেকে ডেকে শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করার লাইসেনস ছাত্রলীগকে কে দিয়েছে? সরকার যেখানে গুজবে কানে দিতে নিষেধ করে সেখানে সরকারের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ গুজবে কান দিয়ে শিবির বলে একজন ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা বর্বরতা ছাড়া কি হতে পারে? অথচ তার পরিবার আওয়ামীলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এখন সব খবর বের হচ্ছে। নিচের প্রশ্নের উত্তরগুলো কে দেবে?
প্রথমত: আবরার শিবির করে তাই তাকে পিটিয়ে হত্যা করতে হবে, কোন আইনে আছে? শিবির সরকার কি নিষিদ্ধ করেছে?সরকার কি ছাত্রলীগকে শিবির নিধনের দায়িত্ব দিয়েছে?
দ্বিতীয়ত: পত্রিকা মতে সে তাবলীগ জামাতে যেত ,তাবলীগ করতো। তাহলে কেন সে হত্যার নিশানা হলো?
তৃতীয়ত: কুষ্টিয়ায় তার পরিবারের সবাই আওয়ামীলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।তারপরও কেন আবরারকে টার্গেট করা হলো?
চতুর্থত: যে যেই দল ও মতবাদে বিশ্বাসী হোক না কেন তাকে পিটিয়ে হত্যা করার অধিকার কে ছাত্রলীগকে দিয়েছে?
পঞ্চমত, আবরারের বিরুদ্ধে কি খুন ধর্ষণ গুমের বা ফৌজদারি কোন মামলা আছে? যে কারণে তাকে বিভৎসভাবে হত্যা করা হলো?
ষষ্ঠত : দেশে কি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নেই। তাদের কাজ কি?শিবির, তাবলীগ, আওয়ামীগ যাই করুক আবরার। এই হত্যাকান্ডে শিবির অপবাদ দোষের কিছু নয়।মূলত আবরারের অপরাধ বিশুদ্ধ দেশপ্রেমিক হবার চেতনা।যে চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে গত ৫ অক্টোবর বিকেল ৫.৩২মিনিটে ফেসবুক নিম্নোক্ত স্টাটাস দিয়েছিল,
১.৪৭ এ দেশভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশেে কোন সমুদ্রবন্দর ছিল না। তৎকালীন সরকার ৬ মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। কিন্তু দাদারা নিজেদের রাস্তা নিজেদের মাপার পরামর্শ দিছিলো। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মংলা বন্দর খুলে দেওয়া হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ ইন্ডিয়াকে সে মংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে।
২.কাবেরি নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে কানাড়ি আর তামিলদের কামড়াকামড়ি কয়েকবছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। যে দেশের এক রাজ্যই অন্যকে পানি দিতে চাই না সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড়লাখ কিউবিক মিটার পানি দিব।
৩.কয়েকবছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তরভারত কয়লা-পাথর রপ্তানি বন্ধ করেছে অথচ আমরা তাদের গ্যাস দিব। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে সেখানে নিজের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বালাব।
হয়তো এসুখের খোঁজেই কবি লিখেছেন-
"পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও,
তার মত সুখ কোথাও কি আছে
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।"
আবরারের এ ফেসবুক স্টাটাসে তার প্রচন্ড দেশপ্রেম প্রকাশ পেয়েছে।আর এই কালো অক্ষরে লেখাগুলো হলো তার জীবনের জন্য যমদূত । যে স্টাটাসের কারণেই তাকে খুন হতে হয়েছে। আবরারের এ নির্ভেজাল দেশপ্রেম ও দেশ নিয়ে ভাবনার জন্য এবং নিজের জীবন উৎসর্গ করায় সে এ প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একজন লড়াকু সৈনিক হিসেবে থাকবে প্রেরণার প্রতীক হয়ে ।আজ বড়ই আফসোসের বিষয় হলো বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী একটি ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাসীদের হাতে তাকে প্রাণ দিতে হলো।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন