সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আখেরি চাহার শোম্বা পালন ও ভ্রান্তি অপনোদন



আখেরী চাহার শোম্বা হলো ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের পালিত অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ একটি স্মারক দিবস। হিজরি সফর মাসের শেষ বুধবার বা ২৭শে সফর মাসে আখেরী চাহার শোম্বা হিসাবে মুসলমানেরা খুশির দিন হিসাবে পালন করে থাকে।ভারতীয় উপমহাদেশের ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশ এবং ইরান, ইরাকে শুধু এই দিবসটি উদযাপন করা হয়ে থাকে। যদিও কিছু নির্দিষ্ট বিধি-বিধানের আলোকে 'আখেরি চাহার শোম্বা' পালন করা হয়,যেখানে  ধর্ম-তত্ত্ববিদগণের মধ্যে এই দিবসটি পালন করা নিয়ে কিছুটা মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। দিবসটি মূলতঃ শুকরিয়া দিবস হিসাবে পালিত হয়,  যাতে সাধারণত গোসল করে দু’রাকাত শোকরানা-নফল নামাজ আদায় শেষে রোগ থেকে মুক্তির দোয়া ও দান-খয়রাত করা হয়।  বিভিন্ন মসজিদ,খানকায় ওয়াজ-নসিহত, জিকির-আজকার, মিলাদ মাহফিল, মাদরাসা, দরবার,  দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয় এই দিনটি পালন উপলক্ষে। এদিন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারিভাবে বন্ধ রাখার পাশাপাশি অফিস-আদালতে ঐচ্ছিকভাবে ছুটির দিন হিসাবে বিবেচনা করা হয়। 
আখেরী চাহার শোম্বা শব্দগুলো আরবি ও ফার্সি ভাষায় সংমিশ্রিত শব্দ। আখেরী অর্থ শেষ। চাহার শোম্বা ফার্সী শব্দ এর অর্থ বুধবার। আখেরী চাহার সোম্বা বলতে সফর মাসের শেষ বুধবারকে বুঝায়।আল্লামা ছফিউর রহমান মোবারকপুরী রচিত ‘আর রাহীকুল মাখতূম’-এ উল্লেখ করা হয়েছে, আখেরি চাহার শোম্বা ছিলো রাসূল (সা.)-র ইন্তেকালের পাঁচদিন আগে। কারো মতে, আখেরি চাহার শোম্বার দিন দশেক পর রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার তিনি ইন্তেকাল করেন। আজকের  এইদিনে রাসুলের (সা.) অসুখ আরো বেড়ে যায়। তাঁর নির্দেশ মতে, সাত কূপের সাত মশক পানি দিয়ে তিনি গোসল করেন। এরপর কিছুটা সুস্থ্যবোধ করেন। তারপর ইমামতিতে মসজিদে নববীতে যান। বোখারী শরীফে সংকলিত হাদীসে আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন আমার গৃহে প্রবেশ করলেন এবং তাঁর অসুস্থতা বৃদ্ধি পেল, তখন তিনি বললেন, তোমরা আমার উপরে ৭ মশক পানি ঢাল…; যেন আমি আরামবোধ করে লোকদের নির্দেশনা দিতে পারি। তখন আমরা এভাবে তাঁর দেহে পানি ঢাললাম…। এরপর তিনি মানুষদের নিকট বেরিয়ে গিয়ে তাদেরকে নিয়ে সালাত আদায় করলেন এবং তাদেরকে খুৎবা প্রদান করলেন বা ওয়াজ করলেন।’ (সহীহ বুখারী)
মৃত্যুর পাঁচদিন পূর্বে বুধবার রাসূল (সা.)-এর দেহের উত্তাপ ও মাথাব্যথা খুব বৃদ্ধি পায়। তাতে তিনি বারবার বেহুঁশ হয়ে পড়তে থাকেন। অতঃপর তাঁর মাথার উপরে পানি ঢালা হ’লে তিনি একটু হালকা বোধ করলে মসজিদে গিয়ে যোহরের ছালাত আদায় করেন এবং মুছল্লীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন’ (বুখারী)
এই দিন কিছুটা সুস্থবোধ করায় ইসলামের মহান নবী মোহাম্মদ(সা.)গোসল করেন। মদীনাবাসী এই খবরে আনন্দ-খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলেন এবং দলে দলে এসে নবীকে এক নজর দেখে গেলেন।সকলে তাদের সাধ্যমতো দান-খয়রাত  করলেন, শুকরিয়া নামাজ আদায় ও দোয়া করলেন। নবীর রোগমুক্তিতে তার অনুসারীরা এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে, তাদের কেউ দাস মুক্ত করে দিলেন, কেউবা অর্থ বা উট দান করলেন, যেমন আবু বকর সিদ্দিক ৫ হাজার দিরহাম, উমর ৭ হাজার দিরহাম, ওসমান ১০ হাজার দিরহাম, আলী ৩ হাজার দিরহাম, আবদুর রহমান ১০০ উট এবং আবদুর রহমান  ইবনে আউফ ১০০ উট দান করেন।
অসুস্থ অবস্থাতেই, ইন্তিকালের কয়েকদিন আগে তিনি গোসল করেছিলেন বলে সহীহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে উক্ত দিবস ঘটা করে পালন করা হয় এবং সরকারী ছুটি ঘোষণা করা হয়। অথচ এটি সম্পূর্ণরূপে বিদ‘আতী প্রথা। এটি পালন না করার পক্ষে যুক্তি
প্রথমত:সাহাবায়ে কেরামের জামানায় এরূপ প্রথার কোন অস্তিত্ব ছিল না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘কেউ যদি এমন কোন আমল করে, যার প্রতি আমাদের নির্দেশ নেই তা প্রত্যাখ্যাত’ (বুখারী )।
দ্বিতীয়ত:রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর জীবনে অনেক আনন্দের দিন আ মুহূর্ত এসেছে, যখন তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছেন, শুকরিয়া জ্ঞাপনের জন্য আল্লাহর দরবারে সিজদাবনত হয়েছেন। কোন কোন ঘটনায় তাঁর পরিবারবর্গ ও সাহাবীগণও আনন্দিত হয়েছেন ও বিভিন্নভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু পরের বছর বা পরবর্তী কোন সময়ে সেই দিন বা মুহূর্তকে তারা বাৎসরিক ‘আনন্দ দিবস’ হিসেবে উদযাপন করেননি। এজন্য রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর নির্দেশ বা সাহাবীদের কর্ম ছাড়া এইরূপ কোন দিন বা মুহূর্ত পালন করা বা এইগুলিতে বিশেষ ইবাদতকে বিশেষ সওয়াবের কারণ বলে মনে করার কোন সুযোগ নেই।
তৃতীয়ত:আলেম ওলামাদের মতে, গোসল করার ঘটনাটি কত তারিখে বা কি বারে ঘটেছিল তা হাদীসের কোন বর্ণনায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। তবে আল্লামা ইবনু হাযার আসকালানী সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের অন্যান্য হাদীসের সাথে এই হাদীসের সমন্বয় করে উল্লেখ করেছেন যে, এই গোসলের ঘটনাটি ঘটেছিল ইন্তিকালের আগের বৃহস্পতিবার, অর্থাৎ ইন্তিকালের ৫ দিন আগে (ইবনু হাযার, ফাতহুল বারী ৮/১৪২)। ১২ই রবিউল আউয়াল ইন্তিকাল হলে তা ঘটেছিল ৮ই রবিউল আউয়াল।
কেউ বলেছেন রবিউল আউওয়াল মাসের শুরু থেকে তাঁর অসুস্থতার শুরু। দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রখ্যাত তাবিয়ী ঐতিহাসিক ইবনু ইসহাক (১৫১হি/৭৬৮ খ্রি) বলেনঃ “রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যে অসুস্থতায় ইন্তিকাল করেন, সেই অসুস্থতার শুরু হয়েছিল সফর মাসের শেষ কয়েক রাত থাকতে, অথবা রবিউল আউয়াল মাসের শুরু থেকে।” (ইবনু হিশাম, আস-সীরাহ আন- নববিয়্যাহ )
চতুর্থত:রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সফর বা রবিউল আউয়াল মাসের কত তারিখ থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কত তারিখে ইন্তিকাল করেন সে বিষয়ে হাদীস শরীফে কোনরূপ উল্লেখ বা ইঙ্গিত নেই। অগনিত হাদিসে তাঁর অসুস্থতা, অসুস্থতাকালীন অবস্থা, কর্ম, উপদেশ, তাঁর ইন্তিকাল ইত্যাদির ঘটনা বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোথাও কোন ভাবে কোন দিন, তারিখ বা সময় বলা হয়নি। কবে তাঁর অসুস্থতা শুরু হয়, কতদিন অসুস্থ ছিলেন, কত তারিখে ইন্তেকাল করেন সে বিষয়ে কোন হাদীসেই কিছু উল্লেখ করা হয়নি।
পঞ্চমত:কি বার থেকে রাসুলুল্লাহ (সা.)এর অসুস্থতার শুরু হয়েছিল, সে বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন শনিবার, কেউ বলেছেন বুধবার এবং কেউ বলেছেন সোমবার তাঁর অসুস্থতার শুরু হয়।কতদিনের অসুস্থতার পরে তিনি ইন্তেকাল করেন, সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, ১০ দিন, কেউ বলেছেন ১২ দিন, কেউ ১৩ দিন, কেউ বলেছেন ১৪ দিন অসুস্থ থাকার পর রাসুল (সাঃ) ইন্তিকাল করেন। তিনি কোন তারিখে ইন্তকাল করেছেন সে বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছনে ১লা রবিউল আউয়াল, কেউ ২রা রবিউল আউয়াল, এবং কেউ বলেছেন ১২ই রবিউল আউয়াল তিনি ইন্তেকাল করেন।
মূল কথা সেই সময় তারিখ দিয়ে তার জীবনের ঘটনাবলী সাজানো ছিল না। সুতরাং এই দিনটির সঠিক তারিখ কি ছিল তা অজানা।কেননা ২য় হিজরী শতক থেকে তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী আলিমগন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর জীবনের ঘটনাবলী ঐতিহাসিক দিন তারিখ সহকারে সাজাতে চেষ্টা করেন।আরেকটি কথা সারা বিশ্বের মুসলিমরা দিনটি উদযাপন করেন না। এতেই বিষয়টি পরিষ্কার যে দিবসটি পালনে ঐতিহাসিক দলীলের অপ্রতুলতা রয়েছে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...