কেন বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদ?
দুটো অচেনা অজানা নর -নারীর মধ্যে হয় বিয়ে নামক আত্মিক সম্পর্ক। এতে তাদের দুই পরিবারের মধ্যে গড়ে উঠে আত্মীয়তার সমন্ধ। পরম সুখে দুজনে শুরু করেন জীবনের নতুন অধ্যায়। এক বুক আশা আর অকৃত্রিম ভালোবাসা নিয়ে শুরু হয় তাদের বর্ণিল পথচলা। তখন তাদের পরিচয় হয় স্বামী এবং স্ত্রী হিসেবে। স্বামী স্ত্রীর এযেন মধুর এক সম্পর্ক। দুটো দেহ মন যেন মিশে যায় একটি আত্মায়। দুজনে হয়ে যায় একে অপরের পরিপূরক। তারা দিনদিন একই সত্ত্বা ও অনুভূতির অনবদ্য বন্ধনে বাঁধা পড়ে। সুখ দুঃখ হাসি কান্না ভাগাভাগি করে নিতেও তাদের থাকে না আপত্তি। তাদের সেই সংসার বিচ্ছেদ নামক কাল নাগিনীর ছোবলে কখনো হয়ে যায় বিষাক্ত।আলাদা হয়ে যায় দুজনের স্বপ্ন ও ভবিষ্যৎ। হারিয়ে যায় একই পথে চলার কুসুমাস্তীর্ণ সেই পথ। সিঁধকেটে ঢোকা বিচ্ছেদে অশান্তির অনলে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় দুটো হৃদয়। বিদগ্ধ হৃদয় লুটে পড়ে তাসের ঘরের মতো। ঘোর অমানিশায় হারিয়ে যায় শক্ত করে ধরা দুটো যুগল হাত। এতক্ষণ বর্ণনা করছিলাম বিয়ে এরপর বিচ্ছেদের সেই বিষাদময় যন্ত্রণার কথা। আজ বিবাহ বিচ্ছেদ যেন বাংলাদেশে মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা শহরে বিবাহ বিচ্ছেদের পরিসংখ্যান দেখলে রীতিমতো চোখ ছানাবড়া হওয়ার উপক্রম।সামাজিক অস্থিরতা, খুন, গুম ধর্ষণ চাঁদাবাজির পরে ঘরের অস্থিরতাও কোন অংশে কম নয়। এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মাত্র ৬ মাসে ঢাকার দুই সিটিতে তালাকের আবেদন জমা পড়েছে ৪ হাজারেরও বেশি। দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন,ফুটফুটে সন্তান, সুন্দর সংসার, এক সময়ের মধুর সম্পর্কের স্মৃতি কোনো কিছুই যেন এই বিবাহ বিচ্ছেদকে ঠেকাতে পারছে না। শুধু ঢাকা সিটি করপোরেশন যে পরিমাণ বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়েছে তা সামাজিক বন্ধনের বিচ্ছিন্নতাকে চরমভাবে নাড়া দিয়েছে। পরিসংখ্যান মতে,২০১৯ সালের বিগত ৬ মাসে অর্থাৎ ১৮০ দিনে ৪ হাজার ৫৫৭টি তালাকের আবেদন হলে একদিনে আবেদন হয়েছে ২৬টি তালাকের। অর্থাৎ প্রতি ৫৫ মিনিটে একটি সংসার ভাঙার আবেদন জমা পড়েছে নগর ভবনে।স্বামীর পরকীয়া, মাদকাসক্ত এসব গুরুতর কারণে যেমন তালাক হয়, আবার স্ত্রীর নানা দোষ দেখিয়েও স্বামীরা তালাকের আবেদন করে। ২০১৮ সালে একটি জরিপ হয় যেখানে বিগত ছয় বছরের একটি জরিপে দেখা যায়, প্রতি ১ ঘণ্টায় একটি ঘর ভাঙার আবেদন জমা পড়েছে ঢাকার দুই নগর ভবনে। এ হিসেবে শেষ ছয় বছরে তালাকে আবেদনের মোট সংখ্যা অর্ধলাখেরও বেশি।
বিবাহিত নারী-পুরুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন মিলমেশ না হলে তারা আলাদা থাকছেন কিংবা বিবাহবিচ্ছেদ হয়।প্রেম করে বিয়ে তারপর তাদের মতের অমিলেও ভাঙছে কত সংসার। তালাকের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সন্তানেরা। তালাকের সবচেয়ে বড় কারণগুলো- স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ‘বনিবনা বা মিল মহব্বত না হওয়া’। স্বামীর অবাধ্য হওয়া,স্ত্রী ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী না চলা, বদমেজাজ, সংসারের প্রতি উদাসীনতা, সন্তান না হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে স্ত্রীকে তালাক দিচ্ছেন স্বামীরা।অপরদিকে স্ত্রীর তালাক আবেদনে কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে স্বামীর সন্দেহবাতিক মনোভাব, মাদকাসক্তি,ভরণপোষণ না দেওয়া, পুরুষত্বহীনতা,পরনারীর প্রতি আসক্তি, যৌতুক, দেশের বাইরে গিয়ে ফিরে না আসা,, ফেসবুকে আসক্তি,ব্যক্তিত্বের সংঘাত, নৈতিকতাসহ বিভিন্ন কারণ। তবে ইদানিং নারীদের তালাক দেওয়ার বেশি প্রবণতার কারণ হলো সহজে বাবার বাড়িতে ঠাঁই পাবার সুযোগ ও আর্থিক স্বচছলতা। গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন বিশ্বব্যাপী বিচ্ছেদের প্রবণতা হলো নারীরা সহজে তালাকের সিদ্ধান্ত নেন না। বাংলাদেশে নারীদের পক্ষ থেকে তালাকের আবেদন কেন বাড়ছে, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েদের মতামত ছাড়া কম বয়সেই বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার দেখা যাচ্ছে বেশি বয়সী লোকের সঙ্গেও অভিভাবকেরা মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। একটা পর্যায়ে গিয়ে এ ধরনের বিয়েগুলো টিকছে না।
সংবাদ পত্রের রিপোর্ট অনুসারে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের পাঁচটি অঞ্চলে তালাকের আবেদন। জমা পড়েছে ২৩১৫ হাজারটি। এর মধ্যে অঞ্চল-১ এ তালাকের আবেদনকারীর সংখ্যা ২৮৩ (নারী ১৫৫, পুরুষ ১২৮ জন), অঞ্চল-২ এ ৫০০ (নারী ৩৭২, পুরুষ ১৭৭ জন), অঞ্চল-৩ এ ৫২৩ (নারী ৩৪৩, পুরুষ ১৮০ জন), অঞ্চল-৪ এ ৩৭৭ (নারী ২৭৯, পুরুষ, ৯৪), অঞ্চল-৫ এ ৬৩২ (নারী ৫০৭, পুরুষ ১২৫)।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করেছেন ২২৪২ হাজার জন। এর মধ্যে অঞ্চল-১ এ তালাকের আবেদনকারীর সংখ্যা ২৫০ (নারী ১৫২, পুরুষ ৫৮ জন), অঞ্চল-২ এ ৫৮৪ (নারী ৪০০, পুরুষ ১৮৪ জন), অঞ্চল-৩ এ ৪৮৯ (নারী ৩৮৮, পুরুষ ১০১ জন), অঞ্চল-৪ এ ১৫৭ (নারী ১১১, পুরুষ, ৪৪), অঞ্চল-৫ এ ৭৬২ (নারী ৫৭২, পুরুষ ১৯০)।
নারীদের মধ্যে অভিজাত ও পেশাজীবী নারীদের স্বামীকে তালাক দেওয়ার পরিমাণ বেশি। সংবাদপত্রের মাধমে জানা যায় ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের বনানী ও গুলশান অভিজাত পরিবারের শিক্ষিত ও স্বচছল নারীরা বেশি তালাকের আবেদন করছেন। আবার দক্ষিণ সিটিতে মোহাম্মদপুর, কারওয়ান বাজার এলাকায় পেশাজীবী নারীরা বেশি তালাক দেন।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে তালাকের প্রবণতা বেড়েছে ৭৫ শতাংশ, দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে বেড়েছে ১৬ শতাংশ। জরিপ মতে, তালাকের আবেদনের পর ৫ শতাংশেরও কম দম্পতি নিজেদের মধ্যে আপস-মীমাংসা করে থাকেন।
১৯৬১ সালে আইয়ুব খানের সময় প্রণীত মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী তালাক আবেদনের ৯০ দিনের মধ্যে কোনো পক্ষ মীমাংসার বা তালাক প্রত্যাহারের আবেদন না করলে তালাক কার্যকর হয়ে যায়। তালাকের প্রবণতা সারা দেশের হিসাবেও বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৮ সালের তথ্য বলছে, গত সাত বছরে তালাকের প্রবণতা ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। শিক্ষিত স্বামী-স্ত্রীদের মধ্যে বিচ্ছেদ বেশি হচ্ছে।
সংসার জীবনে ধৈর্য ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার অত্যধিক সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আকস্মিকভাবে বিবাহবিচ্ছেদ কারোর জন্য হিতকর নয়।খুব বেশি শিক্ষিত ও আধুনিক পরিবার হলেই যে সংসারে অশান্তি বিরাজ করবে তা বিচ্ছেদ ঘটবে তা কিন্তু ঠিক নয়। পরিবারের মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় শিক্ষা ও পারস্পরিক মর্যাদার থাকা প্রয়োজন ।শেষ করি আশা নিয়ে বিবাহ নামক মধুর সম্পর্ক টিকে থাকুক আজীবন। সংসার সুখের হোক দুজনের গুণে।"সংসার সুখী হয় রমণীর গুণে,
গুণবান পতি যদি থাকে তার সনে "।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন