হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ও তাঁর কাব্য প্রতিভা
প্রেম বিরহ ও মানবতার কবি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। এক সময়ের বাংলাদেশের শক্তিমান স্বৈরশাসক এরশাদ ক্ষমতায় থাকাবস্থায় ও ক্ষমতার বাইরে এমনকি জেলে বসে লিখেছেন অসংখ্য প্রেম ভালোবাসা বিরহ ও কষ্টের কবিতা। সেনাপ্রধান থেকে সামরিক শাসক- বিপুল অভিজ্ঞতায় ও ব্যস্ত জীবনে এক সময় ক্ষমতা, প্রেমিকা, স্ত্রীরা সকলেই তাকে ছেড়ে গেছে। কিন্তু তিনি কখনো কবিতা ছাড়েনি।কবিতাও তাঁকে কখনো ছাড়েনি।এরশাদ হয়ত চরম দুঃখের সময়েও সঙ্গী করে নিয়েছেন এ কবিতাকে। লিখে গেছেন ক্ষমতা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের দিনেও। লিখে গেছেন প্রেম ও প্রেয়সীদের সঙ্গে সংসার জীবনেও।কবিতা লিখেছেন সংসারহীন নিঃসঙ্গ একাকী দিনগুলিতে। লিখেছেন যখন ক্ষমতার রাজনীতিতে দুর্দিনের অনিশ্চয়তা ও কষ্টের দিনে। কৈশোর হতে যার কবিতায় হাতে খড়ি। শরীরের অস্থি মজ্জায় যার কবিতার পংক্তি জড়িয়ে। তাঁকে কি কোনো বাধা হার মানাতে পারে? তার কিছু কবিতা বিভিন্ন সময় আবৃত্তির সিডি এলবাম হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে।কখনো কখনো এরশাদ মহান সংসদেও আবৃত্তি করেছেন তাঁর জীবনমুখী কবিতা। এরশাদের প্রতিটি কবিতায় যেন তার জীবন প্রেম, ভালোবাসা ও বিরহের সঙ্গে মিশিয়ে থাকা একেকটি কবিতার চরণ। এরশাদের ভক্ত অনুরাগী ও দলের নেতা কর্মীদের কাছে তাঁর কবিতা পেয়েছে ভালোবাসার সুউচ্চ আসন ও মর্যাদা।
নারী ভালোবাসে কবিতা ক্ষমতা বলিষ্ঠ পুরুষ আর এরশাদ ভুল করেননি সেই সুযোগ লুফে নিতে। জানা যায় কবিতা প্রেমী নারীদেরকে প্রেমের ফাঁদে ফেলতে এরশাদ ক্ষমতা দখল করে শুরু করেন কবিতা লেখা। বলা হয়ে থাকে, রোমান্টিক কবিতা ও কবির প্রতি নারীরা স্বভাবতই দুর্বল হয়ে থাকে।আর তিনি এসুযোগ নিতে লিখে যান নারী ও প্রেম বিষয়ক কবিতা। নারী,ফুল, যৌনতা বিষয়ক কবিতা লেখার পর এরশাদ এসব কবিতা বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপাতে পত্রিকার সম্পাদকদেরকে বাধ্য করতেন বলে জানা যায়।
তার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ হলো তিনি কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ আলী আহসান, সৈয়দ শামসুল হক, ফজল শাহাবুদ্দীন ও আল মাহমুদসহ নামীদামি কবিদের ভাড়ায় কবিতা লিখাতেন।একথা কতটুকু সত্য তা শুধু ভুক্তভোগীরাই মালুম। এসব কবিদের রোমান্টিক ও যৌনতায় ভরপুর কবিতা নাকি পত্রিকায় ছাপা হতো এরশাদের নামে।
বিশ্বপ্রেমিক এরশাদের প্রেম ও পরকীয়ার কাহিনী সাপ্তাহিক যায়যায়দিন পত্রিকায় ছেপে সেই সময় দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন পত্রিকাটির সম্পাদক শফিক রেহমানকে।এই শফিক রেহমানই এদেশে ভালোবাসা দিবস আমদানির জনক ও প্রবর্তক।
কবি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে যখন আলাপচারিতা করতেন তখন তিনি বলতেন। মানুষের ব্যথায় আমি ব্যথা পেয়েছি। মানুষের আনন্দে আমি আনন্দিত হয়েছি। সেসব নিয়েই আমার কবিতা। আমি বলব না আমি কবি। আমার লেখা পড়লে বুঝবেন আমার মনে কত ব্যথা, কত সুর, কত আনন্দ।"
সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী সাবেক রাষ্ট্রপতি ও কবি এরশাদের ২৭টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে চারটি গদ্যগ্রন্থ। বাকি সবই কাব্যগ্রন্থ। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে, কনক প্রদীপ জ্বালো, এক পৃথিবী আগামী কালের জন্য, নির্বাচিত কবিতা,নবান্নে সুখের ঘ্রাণ, “যুদ্ধ এবং অন্যান্য কবিতা, এরশাদের কবিতা সমগ্র, ইতিহাসে মাটির চেনা চিত্র,যেখানে বর্ণমালা জ্বলে “কারাগারে নিঃসঙ্গ দিনগুলো, হে আমার দেশ, ঈদের কবিতা, বৈশাখের কবিতা ও প্রেমের কবিতা,একুশের কবিতা, যে কবিতা সুর পেল, জীবন যখন যেমন এবং এক আকাশে সাত তারা।
সংগীতেও তাঁর প্রবল অনুরাগ ভক্তি পরিলক্ষিত হয়। ব্যক্তিগত জীবনে কবি এরশাদ মৃদুভাষী, মিষ্টি ভাবের প্রচন্ড মিশুক ও দয়ালু স্বভাবের মানুষ। তিনি কবিতা ও গান লেখায় সিদ্ধহস্ত।তাঁর বিখ্যাত কিছু কবিতা ও গান হলো।
শ্রাবনের সৃষ্টিতে, ইচ্ছা (গান), এরিকের জন্মদিন (গান), রূপের মোহনায়, দুর্বিষহ সাতদিন, প্রতিটি মানুষের অন্তরে, একটি অভিজ্ঞতার আলোকে,
কোথাও হয়তো ঘটেছে প্রথম, তোমাদের দোয়া প্রার্থী আমি, নতুন দিনের অঙ্গীকার, হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন। তিনি প্রেম বিরহ, দেশাত্মবোধক, হাসি কান্না, কৃষক, জন্মদিন ইত্যাদি নিয়ে অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। তার প্রেমগীতি কবিতাটি একটি প্রেম বিষয়ক কবিতা।
প্রেমগীতি
তুমি যে আমার অবাক বিষ্ময়
হৃদয় মনের শান্তনা,
স্বপ্নলোকের বাস্তব তুমি
আমার ধারনা ভ্রান্তনা।
ক্লান্ত বিকেলে অবশ পায়ে
ঘুরেছি যখন এই পথে,
শান্ত নদীর নিরব কিনারে
দেখা হয়েছিলো তোমার সাথে।
.....................................
বিশ্বপ্রেমিক ও প্রেমের কবি এরশাদ একদিন তার প্রিয়তমা সহধর্মিণীর হাত ধরে গভীর আবেগ আর ভালোবাসায় শুনিয়েছেন কবিতা। হৃদয়ের সব আবেগ উজাড় করে লেখা কবিতায় তিনি বলতে চেয়েছেন, রওশন তাঁর আলোর মৌমাছি।’ কবি পুরুষ এরশাদ, এক নিঃসঙ্গ প্রেমিক ও কবি। রওশনকে লক্ষ্য করে কবি এরশাদ লেখেন চার লাইনের আলোর মৌমাছি কবিতাটি।
"নিঃসঙ্গ ধূসর বিশাল এক অন্ধকারে
আমি জেগে আছি
কোথায় উষার জ্যোতি
কতদূর আলোর মৌমাছি?"
প্রিয় স্বদেশকে নিয়ে এরশাদ লিখেছেন অনবদ্য এক কবিতা " হতভাগ্য এ দেশ "
ভয়ানক দ্রুত গতিতে ঝড়ের বেগে
কোথায় চলেছে প্রিয় এ দেশ? হতভাগ্য এ দেশকে
ক্রমাগত করছে গ্রাস ভয়ানক ভীতি;
সন্ত্রাস, দুর্নীতি এবং দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতি
গ্রাস করেছে দেশের প্রতিটি অঙ্গ ও এলাকা;
দিশেহারা আজ সুশীল সমাজ, দিশেহারা
শহর-গ্রাম-গঞ্জের মানুষ। খুন-হত্যা-লুটপাট
চলছে লাগামহীন। আইন-নিয়ম-কানুন লুটছে
.............................................
কবি এরশাদের কবিতায় বাদ পড়েনি কৃষকেরাও। তিনি তার "কৃষকের গান "কবিতায় উচ্চারণ করেন।
"শত বঞ্চনার শৃক্সখল ছিঁড়ে-
কৃষক জনতা দাঁড়িয়েছে ঘুরে-
এবার এ দেশের দুঃখ ঘুচবে।
কৃষক বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে"
.............................
তাঁর জন্মদিন নিয়ে লেখেছেন অসাধারণ কবিতা। "আমার জন্ম দিনে আমি"
"আমার জন্মদিন আমার কাছে
সব দিনের মতোই সমান
সুখ দুঃখ আনন্দ ব্যাথা বেদনা
সংমিশ্রনের নিত্য দিনের ন্যায়
স্বচ্ছ স্বাভাবিক একটি দিন। "
সাহিত্য অঙ্গনে এমন কোন দিক নেই যেখানে তাঁর বিচরণ দৃশ্যমান হয় না। প্রেম ভালোবাসা বিরহ প্রকৃতি সবই তার কবিতার উপজীব্য বিষয়। একবার যুক্তরাজ্যে সফরে গিয়ে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বলেছিলেন। যৌবন একটা গোল্ড লিফ সিগারেট। আমার যৌবন আর বেশি দিন নেই। কয়েক বছর পর আমি মধ্যবয়স্ক হয়ে যাব। তাই যতোদিন পারি, এই ক্ষণস্থায়ী যৌবনকে উপভোগ করতে চাই।’ তাঁর এসব কথায় বুঝা যায়, তিনি কতোটা ‘রোমান্টিক ও তিনি কতোটা প্রেমিক পুরুষ।সর্বোপরি একজন শাসকের পাশাপাশি শক্তিমান কবি হিসেবেও তিনি ইতিহাসের পাতায় ও সাহিত্য অঙ্গনে ঠাঁই করে নেবেন। তাঁর নয়ন বছরের শাসনামল যেমন ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছে তাঁর কবিতাও তাঁকে চিরঞ্জীব করে রাখবে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন