বিশ্বজিৎ থেকে রিফাত
যে মৃত্যুর কথা গুলো মনে পড়লে কিংবা ভাইরাল হওয়া ভিডিও সামনে ভেসে উঠলে এখনো শরীরটা ভয়ে শিউরে উঠে মনটা খারাপ হয়ে যায়।গতকালের বরগুনার রিফাত নামের একজন যুবককে কুপিয়ে হত্যার ভিডিও তেমনি একটি। কি নির্মম পাশবিকতা! হায়েনার পৈশাচিকতাকেও যেন হার মানায়।চীনা দার্শনিক
কনফুসিয়াস বলেন। “মানবজাতি জানোয়ারদের থেকে খুব সামান্যই আলাদা হয়ে থাকে, কিন্তু অনেক মানুষ সেই সামান্যটুকুও নিজের মন থেকে বার করে দেয়” –
আমরা নিজেরদের আশরাফুল মাখলুকাত পরিচয় দেই। সেই লকব কি এই মনুষ্য জাতির জন্য এখন উপযোগী? আমরা বনের জন্তু জানোয়ারের চেয়ে অধম ও হিংস্র হয়ে গেছি। মনে হয় এখন আমাদের লকব হওয়া উচিত আশরাফুল জানোয়ার।কি এ কথায় ব্যথা পেলেন? মনে কষ্ট নেবেন না। আমাদের দেশে এখন জনসংখ্যা বাড়ে সেই ভাবে মানুষ মনুষ্যত্ববোধ আমাদের বৃদ্ধি পায়নি ।শরৎচন্দ্রের একটি কথা মনে পড়ে গেল"মানুষের মৃত্যু আমাকে যতোটুকু কষ্ট দেয় তার চেয়ে বেশী কষ্ট দেয় মনুষ্যত্বের মৃত্যু"।
আজ আমাদের সত্যিকার মনুষ্যত্বের মৃত্যু ঘটেছে। তা না হলে এতো বড় ভয়ংকর ঘটনায়ও আমরা নিরব!
মনুষ্যত্বববোধ, মনুষ্যত্বের বিকাশ ও মনুষ্যত্বের কার্যকর উপস্থিতির মধ্যেই ‘মানুষ’— এর প্রকাশ। প্রতিদিনের ছোট ছোট ব্যবহার, ছোট ছোট কথা, হাসি–রহস্য, একটুখানি সহায়তা,একটুখানি নম্রতা, একটু স্নেহের বাক্য, অসহায়ের প্রতি একটুখানি দয়া প্রদর্শন, একটুখানি সৌজন্যতাই মনুষ্যত্ব বিকশিত হয়। ‘মানুষ’ জন্মগত ভাবে ‘মানুষ’ হিসেবে পরিচিতি পেলেও ‘মনুষ্যত্ব’ অর্জন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছেন–“ভালো–মন্দের দ্বন্দ্বের মধ্য থেকে ভালোকে বেছে নেবে বিবেকের দ্বারা, প্রথার দ্বারা নয়—এই হচ্ছে মনুষ্যত্ব।”
সিলেটের খাদিজার প্রতি বদরুলেল নৃশংসতা, পুরান ঢাকায় সোনার ছেলেদের বিশ্বজিতের ওপর বীভৎসতা, ফেনীর নুসরাতের ওপর নির্মমতাও যাদের অন্তরে পরিবর্তন, মনুষ্যত্ববোধ ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার আবেদন তৈরি করতে পারেনি তাদের কাছে মানববতা মনুষ্যত্ববোধ এসব আপেক্ষিক ও হাস্যরসের খোরাক। শুধু এসব ঘটনা নয় আরো বহু ঘটনা প্রতিনিয়ত আমার চারিদিকে ঘটছে কিন্তু এতকিছুর পরও আমরা সাবধান বা সতর্ক হচ্ছি না। কিংবা দৃষ্টান্তমূলক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছি না। আজ এসব যেন আমাদের গা সওয়া ব্যাপার স্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বরগুনার ঘটনায় স্ত্রীর সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে একজন স্বামী রিফাতের লোমহর্ষক খুন।এযেন একখন্ড বাংলাদেশের অবিচ্ছিন্ন ঘটনার প্রতিচ্ছবি। খুন ধর্ষণ গুম ছিনতাই চাঁদাবাজি যেদেশের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা সেখানে এধরনের ঘটনা খানিকটা বিচ্ছিন্ন বলেই অনেকের কাছে মনে হতে পারে। কিন্তু না এতসব অন্যায় অবিচার ও জুলুমের পরেও এ জাতি যেন আজ অনুভূতিহীন নিরব। দিনদিন আমরা যেন হচ্ছি যান্ত্রিক ও রোবট। রিফাতকে আক্রমণের সময় যত মানুষ সেখানে উপস্থিত ছিল তারা যদি একটু প্রতিরোধের প্রাচীর হয়ে দন্ডায়মান হতেন তাহলে রিফাতকে হয়তো অকালে আমাদের হারাতো হতো না। বাঙালির অতীতের প্রতিরোধ, প্রতিবাদের ভাষা যেন এখন এক টুকরো ইতিহাস ও সবই ঝলমলে অতীত। এখন বাঙালির সেই অতীতের তেজ, অনুভূতি ভোতা ও নির্বাসিত। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া বড় বড় হৃদয়স্পর্শী ঘটনা আমাদের সেইভাবে আর আলোড়িত ও শিহরিত করে না।এযেন সর্বংসহা নিশ্চুপ স্বল্পভাষী একটি জাতি। এখন সবকিছু এমন হয়ে গেছে যেন চাচা আপন প্রাণ বাঁচা।অথচ আমরা বিপদে আপদে মানুষের জন্য কখনো কখনো অবতার হয়ে অবতীর্ণ হয়েছি।কিন্তু আজ চোখের সামনে বড় বড় অপরাধ যেন আমরা না দেখার ভান করে অবলীলায় এড়িয়ে যাচ্ছি। আমরা যদি সরব হই। প্রতিবাদী হই। তাহলে দুষ্কৃতকারীরা এমন ঘটনা ঘটানোর দুঃসাহস পাবে না। তবে তার চেয়ে বড় কথা হলো সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। বিচারহীনতার সংস্কৃতি অপরাধীদের অপরাধ সংঘটনে প্রলুব্ধ করে। মারটিন লুথার কিং জুনিয়র বলেন -"Injustice anywhere is a threat to justice everywhere."
যবনিকাপাতে বলি রিফাত হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু বিচার হোক। অপরাধী যেই হোক উপযুক্ত শাস্তি পাক। ভবিষ্যতে কেউ যেন এরকম ঘটনা ঘটাতে দুঃসাহস দেখাতে না পারে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস জনগণের এ ছোট চাওয়াটি কখনো আলোর মুখ দেখে না।"People don't always get what they deserve in this world."
(Lemony Snicket)
আজ আমরা বাঙালি কিন্তু মানুষ হতে পারিনি। মনুষ্যত্ববোধ অর্জন করতে পারিনি। এখন সময় এসেছে আত্মসমালোচনার, মানুষ হবার। সব রুখে দেবার।
“ সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি ”
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন