সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ঈদ যাত্রা কেন শোক যাত্রা হচ্ছে?


বাংলাদেশে ঈদের সময় সড়ক দূর্ঘটনায় ভয়াবহ আকার ধারণ করে। সড়ক মহাসড়কে চলতে থাকে অস্বাভাবিক সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি। পরিণতি অকালেই ঝরে যায় কিছু তরতাজা প্রাণ। শুণ্য হয় পিতামাতার কোল। হারিয়ে ফেলেন আদরের মানিক ধন। এই মৃত্যু মিছিল যেন কিছুতেই থামছে না। প্রতিবছর ঈদের সময় অস্বাভাবিক হারে সড়ক দূর্ঘটনা বেড়েই চলছে। দূর্ঘটনা রোধে কর্তৃপক্ষের নেই তেমন  জোরালো পদক্ষেপ। মন্ত্রী এমপি সরকারি আমলারা যতই নিরাপদ ঈদ যাত্রার কথা বলুক না কেন বাস্তবে চিত্র ভিন্ন।গত বছরের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান মতে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দিক থেকে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। বিশ্বের মধ্যে ১৩ তম। বাংলাদেশের উপরে আছে চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় শুধু ঈদুল ফিতরের সময়ই বাংলাদেশে সড়ক দূর্ঘটনায় প্রচুর সড়ক প্রাণহানি ঘটে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি ২০১৬ সাল থেকে ঈদের আগে ও পরে মোট ১৩ দিনের সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য প্রকাশ করে আসছে। তাদের হিসেবে ২০১৬ সালে ঈদুল ফিতরের আগে পরে ১৩ দিনে ১২১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৮৬ জন নিহত হন। আহত হন ৭৪৬ জন। ২০১৭ সালে একই সময়ে সারাদেশে ২০৫টি দুর্ঘটনায় ২৭৪ জন প্রাণ হারান। আহত হন ৮৪৮ জন। আর ২০১৮ সালে ২৭৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৩৯ জন নিহত এবং ১ হাজার ২৬৫ জন আহত হওয়ার তথ্য দেন তারা।এবার ২০১৯ সালে ঈদুল ফিতরের দিনই সড়ক দুর্ঘটনায় ২১ জন নিহত হওয়ার খবর দিয়েছে সংবাদ মাধ্যম। যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানায় তারা এবারও ঈদের আগে পরে ১৩ দিনের সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান তৈরী করবেন। এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে প্রাথমিক হিসেবে এবারেও সড়ক দূর্ঘটনায় প্রাণহানি খুব একটা কমছে বলে তারা মনে করেন না। পরিসংখ্যান অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি  বিভিন্ন সময়ে উঠানামা করছে কিন্তু প্রাণহানি খুব একটা  কমানো যায়নি।বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিউট (এআরআই)-এর পরিচালক অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান বছরে সারাদেশে যত সড়ক দুঘর্টনা ও প্রাণহানি হয় তার ১৪-১৫ শতাংশ হয় দুই ঈদের আগে পরে ১৩ থেকে ১৫ দিনে। তিনি আরো জানান ঈদের সময় বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার এবং মৃত্যু দুই থেকে চার গুণ বেড়ে যায়। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বিশেষজ্ঞরা প্রধান কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। যাত্রী বৃদ্ধির ফলে ট্রিপ বাড়ানো,  বেশি ট্রিপ দিতে বেপরোয়া গতি, সড়কে অবৈধ চালক ও যানবাহন বাড়ানো,  সড়ক নির্মাণে ত্রুটি এবং যাত্রীদের তাড়াহুড়োর প্রবণতা।মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৫৩ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বেপরোয়া গতি। এছাড়া দুর্ঘটনার দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে চলাচল অনুপযোগী এবং মহাসড়কে চলাচল নিষিদ্ধ থ্রি হুইলার, হিউম্যান হলারে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। ঈদের সময় এগুলো মহাসড়কে নেমে পড়ে।ফলে দূর্ঘটনা ঘটার আশংকা ব্যাপক ভাবে বেড়ে যায়।ঈদের সময়ে অনেক আনফিট যানবাহন রাস্তায় নামানো হয়। বাড়তি চালকের যোগান দিতে গিয়ে লাইসেন্স নেই এমন ব্যক্তি বা হেলপারদের দিয়ে গাড়ি চালানো হয়।এসব কারণে প্রতি বছর শত শত প্রাণ সড়কে মহাসড়কে যানবাহনে পিষ্ট হচ্ছে। কেউবা আহত বা পঙ্গু হয়ে মানবেতর দিনাতিপাত করছে। ঈদ পরিবার পরিজনের সঙ্গে আনন্দে কাটাতে গিয়ে অনেকের  ঈদ আনন্দটা হচ্ছে শোক যাত্রা। ফিরছেন অনেকে লাশ হয়ে। পরিবারের আনন্দের সঙ্গী হবার পরিবর্তে হচ্ছেন শোকের কষ্টের উপলক্ষ। ঈদ উদযাপনের পরিবর্তে তাদের জীবনে নেমে আসছে ঘোর অমানিশা। হয়তো দুর্ঘটনায়  অনেকে হারিয়ে ফেলছেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে। ফলে একজনের দুর্ঘটনায় অকাল মৃতুতে  সেই পরিবারে নেমে আসছে বিভীষিকাময় দিন। তবে কি এসব দুর্ঘটনা রোধে কি কিছুই। করার নেই। নাগরিক জীবনের ঈদ আনন্দ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করার জন্য কোন নিরাপদ ব্যবস্থা কি গড়ে উঠবে না? শত সমস্যায় আচ্ছন্ন আমাদের দেশটি সুন্দর নিরাপদ আর বাসযোগ্য করতে আর কত পথ এগুতে হবে? এমনি তো খাদ্যে ভেজাল খুন ধর্ষণ, রাস্তায় জ্যামে জনগণের নাভিশ্বাস অবস্থা। এরপরে সড়ক দুর্ঘটনা হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু।  নাগরিক সমাজকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।সড়ক দুর্ঘটনারোধে আমরা যা করতে পারি।  এই সময় যাত্রীসহ সব পক্ষকে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। তাড়াহুড়ো করা যাবে  না। হাইওয়ে পুলিশকে অনেক বেশি কার্যকর ও তৎপর হতে হবে। ফুটপাথ, জেব্রা ক্রসিং, আন্ডারপাস, ওভারপাস নির্মাণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে প্রাণহানি অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব। গতি নিয়ন্ত্রণ, মহাসড়কে ছোট যানবাহন বন্ধ ও বেপরোয়া যানবাহন চলাচল বন্ধ করা জরুরি। দেশের সড়ক-মহাসড়কে দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে ১০ লাখ নছিমন-করিমন-ইজিবাইক। অবাধে আমদানি হচ্ছে অটোরিক্সা, ব্যাটারিচালিত রিক্সা, ইজিবাইক। দেশব্যাপী ৫ লাখ ফিটনেসবিহীন বাস, ট্রাক, কভার্ডভ্যান, হিউম্যান হলার অবাধে চলছে। নিবন্ধনবিহীন সাড়ে ৪ লাখ অটোরিক্সা ও মোটরসাইকেল চলাচল করছে সড়ক মহাসড়কে। এসব যানবাহন সড়ক দুর্ঘটনার মুখ্যত দায়ী। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা এমনিতেই বেশি। বছরে গড়ে সাড়ে পাঁচ হজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়।  আর এর ৬ ভাগের একভাগ নিহত হয় দুই ঈদের সময়।ঈদ নিরাপদ করতে মহাসড়কে নিরাপত্তা জোরদার করি। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই। তবে আমাদের ঈদ হবে আনন্দ নির্ভর ও অর্থবহ। শোক যাত্রার পরিবর্তে হবে আনন্দময়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...