সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

গীবত রোজা নষ্ট করে।।। গীবতে রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি


শয়তান মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্টের যত হাতিয়ার ব্যবহার করেন তারমধ্যে জঘন্যতম হাতিয়ার হলো গীবত। এ গীবত মানুষকে নিকৃষ্টতম প্রাণীতে পরিণত করে। তাই তো মহান আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে এই নিকৃষ্ট স্বভাব থেকে বিরত থাকার তাগিদ দিয়েছেন। গীবত শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে দোষারোপ করা, অনুপস্থিত থাকা, পরচর্চা করা, পরনিন্দা করা, কুৎসা রটনা করা, পিছে সমালোচনা করা ইত্যাদি। পরিভাষায় গীবত বলা হয় ‘তোমার কোনো ভাইয়ের পেছনে তার এমন দোষের কথা উল্লেখ করা যা সে গোপন রেখেছে অথবা যার উল্লেখ সে অপছন্দ করে।’ (মু’জামুল ওয়াসিত)। গীবতের সবচেয়ে ভালো ধারণা পায় নিম্নোক্ত হাদিস থেকে -হযরত আবু হুরায়রা( রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) - বলেছেন, গীবত কাকে বলে, তোমরা জান কি? সাহাবিগণ বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) -ই ভালো জানেন। তিনি বললেন, তোমার কোনো ভাই (দীনি) সম্পর্কে এমন কথা বলা, যা সে অপছন্দ করে, তা-ই গীবত। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) -, আমি যে দোষের কথা বলি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে তাহলেও কি গীবত হবে? উত্তরে রাসূল (সা.) -বললেন, তুমি যে দোষের কথা বল, তা যদি তোমার ভাইয়ের থাকে তবে তুমি অবশ্যই তার গীবত করলে আর তুমি যা বলছ তা যদি তার মধ্যে না থাকে তবে তুমি তার ওপর মিথ্যা অপবাদ দিয়েছ। (সহীহ মুসলিম, অধ্যায় ৩১, হাদিস নং ৬২৬৫)।

অতএব এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, কোনো ভাইয়ের এমন দোষের কথা বলা গীবত যা সে অপছন্দ করে না।গীবত প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা  ইরশাদ করেন, ‘তোমরা একে অন্যের দোষ-ত্রুটি অন্বেষণ করো না এবং পরস্পর গিবত করো না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করতে পছন্দ করবে? বস্তুত, তোমরা তা ঘৃণাই কর। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।’ (স‍ুরা হুজুরাত, আয়াত-১২)।আল্লাহ তায়ালা এ ধরনের লোক থেকে দূরে থাকতে আদেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আর তুমি আনুগত্য করো না এমন প্রত্যেক ব্যক্তির, যে অধিক কসমকারী, লাঞ্ছনা, পেছনে নিন্দাকারী ও যে চোগলখোরি করে বেড়ায়, ভালো কাজে বাধাদানকারী, সীমা লঙ্ঘনকারী, পাপিষ্ঠ।’ (সুরা ক্বালাম আয়াত, ১০-১৩)। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, “মুসলিমদের গীবত করো না এবং তাদের দোষ অনুসন্ধান করো না। কেননা, যে ব্যক্তি মুসলিমদের দোষ অনুসন্ধান করে, আল্লাহ তার দোষ অনুসন্ধান করেন। আল্লাহ যার দোষ অনুসন্ধান করেন, তাকে স্ব-গৃহেও লাঞ্ছিত করে দেন।” (আবু দাউদ- ৪৮৮০)।
স্বাধীন কোনো বিবেকবান মানুষই জ্ঞান অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত মৃত মানুষ তো দূরের কথা, যে পশু জীবিত থাকলে হালাল সেই পশু মৃত হলে তার গোশতও ভক্ষণ করবে না। অথচ মানুষ সুস্থ মস্তিষ্কে, স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে গীবতের মতো জঘন্য ফেতনায় নিমজ্জিত হয়।রাসূল (সা.) - এর যুগে দুই মহিলা রোজা রাখল। রোযায় তাদের এত কষ্ট হলো যে, তারা মৃত্যুর মুখোমুখী হলো। রাসূল (সা.) -  এর খেদমতে বিষয়টি জানানো হলে তিনি তাদের কুলি করতে বললেন। তারা কুলি করলে তাদের মুখ থেকে ছোটো গোস্তের টুকরা বের হোলো। তারা আশ্চর্য হয়ে বলল, আমরা তো কোনো পানাহারই করিনি। রাসূল (সা.) - বললেন, মুলত তোমরা রোজা রেখে অন্যের গীবত করেছ। আর গীবত হলো মৃত ভাইয়ের গোস্ত খাওয়া।হযরত শেখ সাদি (রহ:) ছোটকালে তার বাবার সাথে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তেন। একদিন তিনি তার পিতাকে বললেন আব্বা বাসার অন্যান্যরা কিন্তু তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ছে না। তার পিতা বললেন, "তারা তোমার চেয়ে উত্তম, আরো ভালো হতো তুমি যদি নামাজ না পড়ে তাদের মতো ঘুমিয়ে থাকতে।" শেখ সাদি (রহ:) এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন "তারা ঘুমিয়ে আছে অথচ কারো গীবত করছে না , যেটা তুমি করছো।
গীবতের জন্য ভয়াবহ শাস্তি অপেক্ষা করছে। গীবত করা কবিরা গুনাহ ও হারাম। আল্লাহ বলেন, ‘পেছনে ও সামনে প্রত্যেক পরনিন্দাকারীর জন্য দুর্ভোগ-ধ্বংস।’(সুরা হুমাজাহ, আয়াত-১)।রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সম্ভ্রমহানি বা অন্য কোনো বিষয়ে জুলুমের জন্য দায়ী থাকে, সে যেন দুনিয়ায়ই তার নিকট ক্ষমা চেয়ে নেয়- ওই দিন আসার আগে, যেদিন তার কোনো দিনার বা দিরহাম থাকবে না। সেদিন তার কোনো নেক আমল থাকলে সেখান থেকে জুলুমের সমপরিমাণ তার থেকে কর্তন করে নেওয়া হবে। আর তার কোনো নেক আমল না থাকলে মজলুমের গুনাহের কিছু অংশ তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। (বোখারি, হাদিস নং- ২২৮৭)।
রাসূল (সা) বলেছেন, মিরাজের সময় আমাকে এমন এক সম্প্রদায়ের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো যাদের নখ ছিল তামার। তারা তাদের মুখমণ্ডল ও দেহ আঁচড়াচ্ছিল। আমি জিবরীল (আ)-কে জিজ্ঞাসা করলাম, এরা কারা? তিনি বললেন, এরা নিজ ভাইদের গীবত করত ও ইজ্জতহানি করত। (মুসনাদে আহমাদ- ৩/২২৪, সুনানে আবু দাঊদ- ৪৮৭৮)।অন্যের দোষ ধরা ও অন্বেষণ করা থেকে বিরত থাকা মুমিনের কর্তব্য -রাসূল(সা.) একবার লোকদের ডেকে বলেন, ” হে মানুষেরা, যারা মুখে মুখে ঈমান এনেছ এবং ঈমান যাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি, অপর মুসলিমের গীবত করোনা, অন্যের দোষ-ত্রুটি অন্বেষন করোনা, কারন যে অন্যের দোষ-ত্রুটি অন্বেষন করে বেড়ায়, আল্লাহ তার দোষ অন্বেষণ করেন, আর আল্লাহ যার দোষ অন্বেষনে লেগে যান তিনি তাকে তার ঘরের মধ্যেই অপমান করে ছাড়েন।” (সুনানে আবু দাঊদঃ ৪৮৬২, তিরমিজীঃ ১৬৫৫ )।
রাসুল (সা.) আরও ইরশাদ করেন, ‘গীবত জিনার চেয়েও নিকৃষ্ট। ’ (মিশকাত)।হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘একবার রাসুল (সা.) দুটি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি বললেন, নিশ্চয়ই এ দুই কবরবাসীকে আযাব দেওয়া হচ্ছে। তবে বড় কোনো অপরাধের কারণে নয়; এদের একজন প্রস্রাব থেকে নিজেকে হেফাজত করত না। অন্যজন গীবত করে বেড়াত। ’ (বুখারি)।পবিত্র রমযান হলো সংযমের মাস। অশালীন কথা, গালিগালাজ, মিথ্যা কথা, গিবত, পরনিন্দা, ঝগড়া-ফাসাদ, মারামারি, অন্যকে কষ্ট দেওয়া, ধুম পান সহ সর্বপ্রকার গোনাহের কথা ও কাজ পরিহার করতে হবে।রাসূল (সা.) এরশাদ করেছেন,  ‘রোজা হল (জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার) ঢাল, যে পর্যন্ত না তাকে বিদীর্ণ করা হয়। জিজ্ঞাসা করা হলো, কীভাবে রোজা বিদীর্ণ হয়ে যায়? রাসূল (সা.) বললেন, মিথ্যা বলার দ্বারা অথবা গীবত করার দ্বারা।মুফাসসির মুজাহিদ (রহ.) বলেন, দু’টি অভ্যাস এমন রয়েছে, এ দু’টি থেকে যে বেঁচে থাকবে তার রোজা নিরাপদ থাকবে- গীবত ও মিথ্যা।গীবত হতে বেঁচে থাকার অন্যতম উপায় হলো নীরব থাকা। গীবতের ভয়াবহ শাস্তি ও পরিণতির কথা ভেবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা।

গ্রন্থনায়- মো. আবু রায়হান

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

মো.আবু রায়হান:  কিয়ামত সংঘটিত হবার  পূর্বে হযরত ঈসা (আ.) এর সঙ্গে দাজ্জালের জেরুজালেমে যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধে ইহুদিরা দাজ্জালের পক্ষাবলম্বন করবে। হযরত ঈসা (আ.) দাজ্জালকে হত্যা করবেন।এদিকে  ইহুদিরা প্রাণ ভয়ে পালাতে চেষ্টা করবে।  আশেপাশের গাছ ও পাথর/ দেয়ালে আশ্রয় নেবে। সেদিন গারকাদ নামক একটি গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে। গারকাদ ইহুদীবান্ধব গাছ।গারকাদ একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হল কাটাওয়ালা ঝোঁপ।গারকাদ এর ইংরেজী প্রতিশব্দ Boxthorn। Boxএর অর্থ সবুজ ঝোঁপ এবং thorn এর অর্থ কাঁটা। এ ধরনের গাছ বক্সথর্ন হিসেবেই পরিচিত। এই গাছ চেরি গাছের মতো এবং চেরি ফলের মতো লাল ফলে গাছটি শোভিত থাকে।  ইসরায়েলের সর্বত্র বিশেষত অধিকৃত গাজা ভূখন্ডে গারকাদ গাছ ব্যাপকহারে  দেখতে পাওয়া যায়।ইহুদিরা কোথাও পালাবার স্থান পাবে না। গাছের আড়ালে পালানোর চেষ্টা করলে গাছ বলবে, হে মুসলিম! আসো, আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। আসো এবং তাকে হত্যা কর। পাথর বা দেয়ালের পিছনে পলায়ন করলে পাথর বা দেয়াল বলবে, হে মুসলিম! আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে, আসো! তাকে হত্যা কর। তবে গারকাদ নামক গাছ ইহুদিদেরকে ...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

উটের যুদ্ধ ইসলামের প্রথম ভাতৃঘাতি যুদ্ধ

#মো.আবু রায়হান উটের যুদ্ধ বা উষ্ট্রের যুদ্ধ বা জামালের যুদ্ধ ( Battle of the Camel) ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ইরাকের বসরায় সংঘটিত হয়। এটি ইসলামের ইতিহাসের প্রথম গৃহযুদ্ধ।এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী এর বিরুদ্ধে হযরত তালহা-জুবায়ের ও আয়েশা (রা)সম্মলিত যুদ্ধ। পটভূমি হযরত ওসমান (রা) এর বিভিন্ন প্রদেশে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগ নিয়ে একদল তার বিরুদ্ধে অভিযোগ টেনে বিদ্রোহ শুরু করে।হযরত ওসমান বিভিন্নভাবে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন। তাদের কথামত মিশরের গভর্নরকে প্রতিস্থাপন করে আবু বকরের ছেলে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর কে নিয়োগ করলেও বিদ্রোহীরা শান্ত হয় নি। তারা নানাভাবে অভিযোগ টেনে এনে ওসমান (রা) এর অপসারণের দাবী করতে থাকে। ওসমান সবকিছু মীমাংসার আশ্বাস দিলেও তারা ৬৫৬ সালের ১৭ জুন তারা বাড়ি অবরুদ্ধ করে এবং এক পর্যায়ে তারা তার কক্ষে প্রবেশ করে কুরআন তেলাওয়াত করা অবস্থায় হত্যা করে।ওসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডের পর আলী (রা.) খলিফা হন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে যখনই আলী (রা.) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন তখনই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবের কার...