সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

তারুণ্যের বিসিএস উন্মাদনা এবং আগামীর বাংলাদেশ

মো আবু রায়হানঃবাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণ তরুণীদের পছন্দের শীর্ষে সরকারি চাকরি। সরকারির চাকরির মধ্যে এক নম্বরে পছন্দের বিসিএস ক্যাডার হওয়া।আর এ ক্যাডার হওয়ার জন্য চলে রীতিমতো পড়াশোনার যুদ্ধ। টেবিল চেয়ারে বসে নির্বিঘ্নে চার পাঁচ বছর  কেটে দিতেও  রাজি। তবু হতে হবে বিসিএস ক্যাডার। এ যেন  মনের মধ্যে প্রচন্ড এক জেদ সামনে এগিয়ে যাবার দৃঢ় প্রত্যেয়। এ তরুণ তরুণীরা সরকারি চাকরির শুধু উপরের মোড়ক দেখেই এত ক্রজি। এর ভেতরের রয়েছে অসংখ্য তরুণের স্বপ্ন ভাঙার আর্তনাদ। সেকি সেই আর্তনাদ শুনতে পায়? দেখতে পায় কি অসংখ্য তরুণেরর স্বপ্ন ভঙ্গের নীরব কান্না ।তরুণরা কি জানে স্বাধীনতার পর কত জন এ পর্যন্ত বিসিএস ক্যাডার হয়েছে। এ সংখ্যা খুবই নগণ্য। তরুণরা তো দেখছে প্রতি বছর কয়েক লাখ শিক্ষিত বেকার বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। এর মধ্যে মাত্রা কয়েক পারসেন্ট শিক্ষিত বেকার বিসিএস ক্যাডার হচ্ছে। অনেকে তিন চার পাঁচ বছর বিসিএসের প্রস্তুতি নিয়ে কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের ধরা না পেয়ে হতাশায় ভুগছে। অথবা শেষ পর্যন্ত বেসরকারী সরকারি কোনো ছোটখাটো চাকরি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর সাম্প্রতিক এক গবেষণা বেকারত্বের এ চিত্র উঠে এসেছে। ‘ট্রেসার স্টাডি অব গ্র্যাজুয়েটস অব ইউনিভার্সিটিস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই গবেষণা পরিচালনা করে প্রতিষ্ঠানটি।
এক হাজার ৫৭৪জন উচ্চশিক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এ গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করা ৩৮ দশমিক ছয় শতাংশই বেকার। সে হিসেবে দেশে বর্তমান বেকার সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ।
বাংলাদেশের সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে থাকে বিপিএসসি। এটি বাংলাদেশের একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান।বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন (বিপিএসসি) যে পরীক্ষাগুলো পরিচালনা করে থাকে তার মধ্যে রয়েছে ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষা, নন-ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষা, ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষা ও সিনিয়র স্কেল পদোন্নতি পরীক্ষা।
১৯৭২ সালের ৮ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন আদেশ (রাষ্ট্রপতির ৩৪নং আদেশ) জারির মাধ্যমে কর্মকমিশন গঠন করা হয়। তবে বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর হয় ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ১৯৭৭ সালে ‘The Bangladesh Public Service Commission Ordinance, 1977’ এর মাধ্যমে প্রথম ও দ্বিতীয় কমিশনকে একীভূত করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের সরকারি কর্মকমিশন সংবিধনের ৮৮, ১৩৭-১৪১ ও ১৪৭ অনুচ্ছেদ এবং অর্ডিন্যান্স দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। কর্মকমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব যা সংবিধানের ১৪১ (১)-এর ক অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগদানের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিদিগকে মনোনয়নের উদ্দেশ্যে যাচাই ও পরীক্ষা পরিচালনা। ব্রিটিশ আমলের মর্যাদাপূর্ণ সিএসপি এবং পাকিস্তান আমলের আইসিএস পরীক্ষার পরিবর্তিত রূপ বর্তমান বিসিএস পরীক্ষা।
বাড়ছে পরীক্ষার্থী বাড়ছে না পদ সংখ্যা। 
প্রতিবছর বিসিএস পরীক্ষারথী বেড়েই চলছে। ৩৪তম বিসিএসের প্রিলিমিনারিতে আবেদনের সংখ্যা ২ লাখ ২১ হাজার ৫৭৫, ৩৫তমতে ২ লাখ ৪৪ হাজার ১০৭, ৩৬তমতে ২ লাখ ১১ হাজার ৯১২, ৩৭তমতে ছিল ২ লাখ ৪৩ হাজার ৪৭৬, ৩৮ তমতে ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৫৩২, ৩৯ তম ছিল ডাক্তারদের স্পেশাল বিসিএস।  সর্বশেষ অনুষ্ঠিত ৪০ তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষাতে প্রার্থী ছিল ৪ লাখ ১২ হাজার ৫৩২ জন।প্রতিবছর বহু সংখ্যক পরীক্ষার্থী বাড়ছে কিন্তু সেই তুলনায় পদ খুব বেশি বাড়েনি।লাখ লাখ প্রার্থীর মধ্যে সর্বশেষ চারটি বিসিএসে ৩৬ তম থেকে  ৪০ তম বিসিএস পর্যন্ত নিয়োগ পেয়েছেন বা পাবেন ৭৪৭৬ জন। ৪০ তম বিসিএস এখানে  ধরা হয়নি। 
প্রতিবছর বিসিএস পরীক্ষায় প্রার্থী বেড়ে যাওয়ায় বিভিন্ন মহলে জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে তরুণরা কেন বিসিএস মুখী হচ্ছে। এর যৌক্তিক কিছু কারণও খুঁজে পাওয়া যায়।যেমন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন নীতিমালা,  নতুন নতুন পে-স্কেল আসার কারণে আবেদনকারীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হচ্ছে ফলে বিসিএসে আগ্রহ বাড়ছে তরুণ চাকরি প্রার্থীদের।এছাড়াও কিছু কারণ উঠে এসেছে। যেমন, সামাজিক মর্যাদা , বর্তমান সরকারের আমলে বড় রকমের ঝুটঝামেলা ছাড়া স্বচছ নিয়োগ প্রক্রিয়া, মেধার মূলায়ন, বেতন বেসরকারি চাকরির প্রায় সমান, সরকারি চাকরিতে নিরাপত্তা, পারিবারিক চাপের কারণে, ক্ষমতার জন্য, বিয়ের বাজারে বিসিএস চাকরিজীবীর কদর বেশি, সরকারি জব হতে অবসরের পর পেনশন ও গ্রাইচুটি সুবিধা, তরুণদের পড়াশোনা শেষ করে উদোক্তা হবার মত পুঁজির অভাব এ ব্যাপারে পরিবারের সাপোর্ট না থাকাসহ নানাবিধ কারণে শিক্ষিত তরুণরা সরকারি চাকরির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর সাম্প্রতিক এক গবেষণায় নিম্নের তথ্যটি উঠে এসেছে।  মাত্র পাঁচ দশমিক ৭৭ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মনির্ভরশীল বা নিজেই উদ্যোক্তা হতে পারছেন।এখন সরকারি চাকরির সব মোটামুটি সব নিয়োগ বিসিএসের ম্যাধমে নিয়োগ হচ্ছে। আগের দিনে নন ক্যাডার, সেকেন্ড ক্লাস চাকরির আলাদা সার্কুলার হতো এখন সব পদে মোটামুটি বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে নেওয়া হচ্ছে। এটাও একটি কারণ হতে পারে বিসিএসের প্রতি তরুণদের আকৃষ্ট হবার।পরিসংখ্যানে দেখা গেছে,বিগত চারদলীয় সরকারের আমলে  ২০০১ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত ক্যাডার এবং নন-ক্যাডার মিলিয়ে কমিশনের সুপারিশ ছিল ১৬ হাজার ৯৮৭ প্রার্থী। এর মধ্যে ক্যাডার ১২ হাজার ৭৯৪ জন এবং নন-ক্যাডার ৪ হাজার ১৯৪ জন।অন্যদিকে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর গত বছরের জুন মাস পর্যন্ত ক্যাডার এবং নন-ক্যাডার মিলিয়ে সুপারিশ হয়েছে ৫৪ হাজার ৫৩৬ প্রার্থীর। যাদের মধ্যে ক্যাডার ২৬ হাজার ৫৯২ জন এবং নন-ক্যাডার ২৮ হাজার ৪৫ জন।
বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নিয়োগ নিয়ে দীর্ঘ সূত্রিতারও রয়েছে বিস্তর সমালোচনা। অভিযোগ রয়েছে, বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ থেকে চাকরিতে যোগদানের গেজেট,পর্যন্ত  দীর্ঘমেয়াদি পরীক্ষা ও ফল প্রকাশ পর্যন্ত লাখো তরুণ-তরুণীর মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে।২৮তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করতে সময় লাগে ২৮ মাস আর ২৯তম বিসিএসের ২৫ মাস। ৩৪তম বিসিএসের এই প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় লেগেছে তিন বছর চার মাস। ৩৫তম বিসিএসসের সময় লাগে ১৮ মাস। তবে পিএসসি বারবার দ্রুত সময় সব কিছু করার প্রতিশ্রুতি দিলেও পুরোপুরি এখন সক্ষম হয়ে উঠেনি।এত কিছুর পরও তরুণদের বিসিএস ক্যাডার হবার স্বপ্ন হতে তাদের নিবৃত্ত করতে পারছে না।বিসিএস বিমুখ কিছু তরুণ থাকলেও সেটা সংখ্যায় খুব নগণ্য। নিয়োগের দীর্ঘসূত্রিতা, পদ সংখ্যা সীমিত, স্বাধীনতার পর থেকে খুব অল্প সংখ্যক বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সরকারি  চাকুরিজীবী হওয়ার কারণে অনাগ্রহ।আবার দেশের  রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে  অনেক তরুণ বিদেশে ক্যারিয়ার গঠনে তৎপর।
আজকাল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ঝাঁক  তরুণ মেধাবী একাডেমিক পড়াশোনা বাদ দিয়ে বিসিএস ও সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পরীক্ষার দুচারদিন আগে বন্ধু বান্ধবদের কাছ থেকে ধার করে আনা গাইড, পুরোনো হ্যান্ডনোট ফটোকপি করে কোনো ভাবে তারা পরীক্ষায় অংশ নিয়ে একটা রেজাল্ট করছে।এদেশে সরকারি চাকরি পেতে খুব ভালো রেজাল্ট প্রয়োজন হয় না। সেজন্য একাডেমিক পড়াশোনা পাশে সরিয়ে রেখে কিছু তরুণ পুরোদস্তুর বিসিএসের পেছনে নিজেদের সঁপিয়ে দিচ্ছে। অনেক তরুণ দেখাদেখি  গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে দিচ্ছে।  নিজের সক্ষমতা  ও বিসিএস এর মতো কঠিন পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ঠিকমতো বেসিক জ্ঞান আছে কি না সেদিকে যেন তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। যার ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। অনার্স মাস্টারস পাস করার পর বিসিএস ধ্যান জ্ঞান হওয়ায় অনেকেই স্বপ্নের বিসিএস নাগালে পাচ্ছে না। পদ সংখ্যা সীমিত, বিপুল প্রার্থীর কারণে অনেকের  বিসিএস হাতছাড়া হয়ে যায়। ফলে একজন তরুণের মাসটারস পাশের পর চার পাঁচ বছরের বিসিএসের পেছনে ছুটতে গিয়ে হারিয়ে ফেলতে হয় জীবনের মূলবান কিছু সময়। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন ছুঁতে না পারার কষ্ট কিছু তরুণ হতাশায় কিংবা  বিষন্নতায় নিমগ্ন হয়ে অন্ধকার জগতে পা বাড়ায়।অনেক তরুণ বিসিএসের মত কঠিন যুদ্ধে টিকতে না পারে ক্লান্ত হয়ে এদেশে ক্যারিয়ার না গড়ে বিদেশ মুখী হতে চায়।
কিছুদিন আগে প্রথম আলোর উদ্যোগেওআরজি-কোয়েস্ট সারা বাংলাদেশে তরুণদের ওপর যে জরিপ পরিচালনা করেছে, এই জরিপেও দেখা গেছে যে বাংলাদেশের ৮২ শতাংশ তরুণই উদ্বিগ্ন তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। ভবিষ্যৎ কর্মজীবন নিয়ে তাঁরা নানা ধরনের অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায় আমাদের তরুণ প্রজন্ম তেমন একটা ভালো নেই এ দেশে। তরুণেরাই যখন তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত, তখন তা আমাদের একটি বার্তা দেয়; আর তা হলো দেশের জন্য অপেক্ষা করছে হতাশাজনক একটি সময়। সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চ (সিডার) ‘কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার পর্যালোচনা ২০১৭’ শিরোনামে যে সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তাতে বেরিয়ে আসে, যার শিক্ষাগত যোগ্যতা যত বেশি, তার চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা তত কম। প্রতিবেদনটি যে সমস্ত তরুণ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে চান, তাদের জন্য এক হতাশাজনক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়।
এদিকে বিসিএস নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র আরো ভয়াবহ। বাংলাদেশের স্বাধীকার আন্দোলন সহ সব ন্যায্য আন্দোলনের সূতিকাগার আজ জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা ও গবেষণা  পরিহার করে অধিকাংশ শিক্ষার্থী উন্নত ক্যারিয়ার গঠনের নামে বিসিএসের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত। একাডেমিক পড়াশোনা বাদ দিয়ে অধিকাংশ ছেলে মেয়ে হলে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, পাবলিক লাইবেরী, অাডডায় তাদের এখন ধ্যান জ্ঞান হবু বিসিএস ক্যাডার। ঢাবিতে ভর্তি  হয়ে প্রথম বর্ষেই ছেলে মেয়েটি এখন সিনিয়রদের সাথে পাল্লা দিয়ে কাক ডাকা ভোরে কেন্দ্রীয় লাইবেরীর সামনে একটা সিটের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি।বর্তমানে এখানে প্রায় ৩ লাখ ১৮ হাজার ৭৪টি বই, ৪১ হাজার ৪৮৩টি সাময়িকী ও জার্নাল রয়েছে। বইয়ের পাশাপাশি ১৪-১৫ শতকের দুষ্প্রাপ্য পান্ডুলিপি আছে এ লাইব্রেরিতে। দুঃখের বিষয় বিভিন্ন বই জার্নাল পেপারে ধুলির আস্তরণ পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কিন্তু এসব বই পড়ার পাঠক আজ অবশিষ্ট নেই। সবাই ব্যস্ত চাকরির পড়াশোনা নিয়ে।এখন গবেষণা ধর্মী পড়াশোনা ও একাডেমিক পড়াশোনা নেই বললেই চলে। যে কারণে ঢাবি আজ বিশ্বের সুনামধন্য ভার্সিটির তালিকায় ঠাঁই পায় না।বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিগুলোয় ছিল বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক লেখাপড়া, গবেষণা ও বাড়তি জ্ঞান আহরণের স্থান। এখন তা ক্রমেই হয়ে উঠেছে বিসিএস তথা সরকারি চাকরির নির্বিঘ্ন পড়াশোনার স্থান হিসেবে। এখন লাইব্রেরিতে কোনো চেয়ার খালি থাকে না, বিশেষ করে কোনো সরকারি চাকরির আগে। ভোর থেকে এসে লাইনে দাঁড়ায় সবাই, চাকরির জন্য মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতে হয় বলে।
বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী যারা তারাও ডুবে আছে বিসিএসের পড়াশোনা নিয়ে। এতে আগামীদিনে গবেষক ও বিজ্ঞানী হতে বঞ্চিত হবে দেশ। এ নিয়ে কয়েকজন শিক্ষাবিদের সাম্প্রতিক কালের কিছু  মন্তব্য এখানে উপস্থাপন করা যুক্তিযুক্ত হবে মনে করি।চাকরির পড়ার সাথে বিজ্ঞান ভিত্তিক লেখা-পড়ার সমন্বয় না থাকার কারনে বিজ্ঞান ভিত্তিক পড়াশুনার উদ্দেশ্য সম্পূর্নরূপে ব্যহত হচ্ছে বলে মনে করেন গবেষকরা। তাদের মতে, উচ্চতর গবেষনায় বরাদ্দ কম ও বিজ্ঞান ভিত্তিক চাকরির বাজার না থাকায় কাজে লাগছেনা অর্জিত জ্ঞান।ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল (ডীন, আর্থ এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) বলেন, তাদের পাঠ্যপুস্তকের সাথে চাকরির কোন মিল না থাকার কারণে বিজ্ঞানের ছাত্ররা বিজ্ঞানের প্রতি মনোযোগ হারিয়ে ফেলছে।অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বিজ্ঞান ছাড়া আমাদের ভবিষ্যত অন্ধকার। কর্মের নতুন সংস্থান করতে হবে, শিক্ষাক্ষেত্রে জাতীয় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।সম্ভাবনাময়ী এই শিক্ষার্থীদের উচ্চতর গবেষনায় আগ্রহী করতে না পারলে বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার এই যুগে প্রতিযোগিতাশীল বিশ্বে পিছিয়ে পড়তে পারে বাংলাদেশ এমন আশঙ্কা প্রবীণ এই শিক্ষাবিদের।পরিতাপের বিষয় ডিপার্টমেন্টর ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট হওয়া ছেলেটি যদি বিসিএস না দেয় কিংবা কোন কারণে উত্তীর্ণ হতে না পারে তাকেও উপহাস করা হয়। একাডেমিক অর্জনের স্বীকৃতি কিংবা প্রশংসাও জোটে না তার কপালে । সমাজ তথা রাষ্ট্রের কিছু শিক্ষিত অর্ধ শিক্ষিতের কাছে বিসিএসই যেন সব সফলতার মূলমন্ত্র। বর্তমান ডিজিটাল যুগে নিজের নাম স্বাক্ষর দিতে না পারা অজ পাড়া গায়ের মানুষটিও বিসিএসের খোঁজ খবর রাখে। গ্রামের মোড়ের মুদি দোকানীও কোন শিক্ষার্থী বাড়ি গেলে জিজ্ঞেস করে বিসিএস দিয়েছে কি না? আজকাল বিসিএসটা এমন হয়ে গেছে বিসিএসের চেয়ে ভালো ও বড় কোনো  চাকরি বা পেশা বোধহয় এদেশে নেই। তাদের কাছে মাশরাফি সাকিব গেলেও জিজ্ঞেস করবে তারা বিসিএস দিয়েছে কি না। একজন তরুণ যদি মাইক্রোসফট, গুগল কিংবা আমাজান আলীবাবা ডটকমের সিইও হয় তাতেও কিছু মানুষ স্বভাবসুলভ গভীর কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করবে সে বিসিএস দিয়েছে কি না।নাসায় কর্মরত থাকলেও জিজ্ঞেস করবে  সে কি বিসিএস দিয়েছে?বাংলাদেশে চারিদিকে তরুণদের মধ্যে  যেন বিসিএস বাতিক ছড়িয়ে পড়েছে। বিসিএস ছাড়া তারা অন্য  কিছুর কল্পনা ও আল্পনা আঁকতে পারেনা। 
যে ভাবে প্রতিনিয়ত তরুণদের বিসিএস নিয়ে যেভাবে উজ্জীবিত করা হচ্ছে তা এদেশের জন্য অশনিসংকেত । প্রথমে চিন্তা করুন আপনি বিসিএস দেবেন আপনার কি সেই পরিমাণ বেসিক নলের আছে? আচ্ছা না থাকলো অল্প সময়ে কি তা রপ্ত করতে পারবেন? আপনি পড়াশোনা শেষ করে চার পাঁচ বছর পড়াশোনা করে ক্যাডার হবেনই এমন নিশ্চয়তা কি দিতে  পারেন ।পরিবারের ওপর লোড পড়বে না তো? আপনি কি যথেষ্ট উদদোমী পরিশ্রমী ও ধৈর্যশীল। আপনি পড়াশোনা করে এদেশে সরকারি জব পাবেন এর কোনো নিশ্চয়তা আছে? বিসিএসে একই সাথে ভাগ্য ও পরিশ্রম প্রয়োজন। এসব দিক বিবেচনা না করে হুজুগে কোনো  সিদ্ধান্ত নিলে আপনি ভুল করবেন। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত, আপনার কতদূর পর্যন্ত। আপনার দৌড় কত দূর তা দেখে নিন। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত কয় হাজার বিসিএস ক্যাডার হয়েছে? কতজন পরীক্ষা দিয়েছিল?  কতজন নিয়োগ পেয়েছেন?  সেই পরিসংখ্যানটা জেনে নিয়েও এগুতে বা পিছুটান দিতে পারেন।আপনার জন্য পুরোনো একটি তথ্য দিলাম মিলিয়ে নিতে পারেন।২৮তম বিসিএসের তুলনায় ৩৭তম বিসিএসসে আবেদনকারীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় শতভাগ। আগে বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় শতকরা ২০ জন উত্তীর্ণ হতো, বর্তমানে এটা এত প্রতিযোগিতামূলক হয়েছে, যেখানে সাড়ে ৩ শতাংশের বেশি কৃতকার্য হওয়ার সম্ভাবনা নেই।গেল ৩৪তম বিসিএস প্রিলিমিনারিতে ২০.৮৭ শতাংশ, ৩৫তম বিসিএস প্রিলিমিনারিতে ৮.৩৫ শতাংক, ৩৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারিতে ৬.৫৪ এবং সর্বশেষ ৩৭তম বিসিএস প্রিলিমিনারিতে কৃতকার্য হয়েছেন মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ প্রার্থী। লিখিত পরীক্ষায় আগে ১০ শতাংশ কৃতকার্য হলেও এখন তা আরও বেশি প্রতিযোগিতামূলক হয়ে গেছে। এখন তা ২.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। ৩৫তম লিখিত পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েছে ২.৪৯ শতাংশ।
মনে রাখবেন সবাই বিসিএস ক্যাডার হবে না। আপনার ভাগ্য ও পরিশ্রম আপনাকে একটি জায়গায় উপনীত করবে। সেখানেই আপনি পৌঁছবেন। কোনো বিসিএস মোটিভেশনাল বক্তার মুখরোচক কথায় প্রভাবিত হবেন না।আপনি যথেষ্ট সুবিবেচক ও পরিপক্ক।আপনার সিদ্ধান্ত যদি আপনি না নিতে পারেন অন্যের দ্বারা এ বয়সে প্রভাবিত হন তাহলে বিসিএস আপনার জন্য নয়।  নিজে আত্মসমালোচনা করে দেখেন আপনি এসবের জন্য কতটুক প্রস্তুত। কোচিংয়ের কোন ভাইয়ার অনুপ্রেরণায় নয়। নিজেকে জিজ্ঞেস করেন, এই বন্ধুর পথ আপনি পাড়ি দিতে পারবেন কি না। তিন বছরের প্রস্তুতি পরীক্ষা নিয়োগ সব মিলে আরো দুই বছর ততদিনে আপনার প্রিয়জন অপেক্ষা করবে তো? আমি নিরুৎসাহিত করছি না জাস্ট জীবনের হিসাবের সঠিক ফর্মুলা ফরম্যাট বলে দিলাম। শেষে কানে কানে বলি এতদুর এপথ পাড়ি দিয়ে নানা চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে যখন প্রাপ্তির খাতায় শূন্য।  তখন কেমন উপলব্ধি হবে? হতাশা বিষন্নতা নিজেকে গিলে ফেলবে। তখন মনে হবে বিসিএসটা কারো কারো কাছে আসলেই মরীচিকা। আলেয়ার আলো আঁধারি খেলা।কারো কাছে সোনার হরিণ। শেষ করছি ররবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার কয়েকটি পংক্তি দিয়ে -
“ নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস,
ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।
নদীর ওপার বসি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে;
কহে, যাহা কিছু সুখ সকলি ওপারে। ”

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

মো.আবু রায়হান:  কিয়ামত সংঘটিত হবার  পূর্বে হযরত ঈসা (আ.) এর সঙ্গে দাজ্জালের জেরুজালেমে যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধে ইহুদিরা দাজ্জালের পক্ষাবলম্বন করবে। হযরত ঈসা (আ.) দাজ্জালকে হত্যা করবেন।এদিকে  ইহুদিরা প্রাণ ভয়ে পালাতে চেষ্টা করবে।  আশেপাশের গাছ ও পাথর/ দেয়ালে আশ্রয় নেবে। সেদিন গারকাদ নামক একটি গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে। গারকাদ ইহুদীবান্ধব গাছ।গারকাদ একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হল কাটাওয়ালা ঝোঁপ।গারকাদ এর ইংরেজী প্রতিশব্দ Boxthorn। Boxএর অর্থ সবুজ ঝোঁপ এবং thorn এর অর্থ কাঁটা। এ ধরনের গাছ বক্সথর্ন হিসেবেই পরিচিত। এই গাছ চেরি গাছের মতো এবং চেরি ফলের মতো লাল ফলে গাছটি শোভিত থাকে।  ইসরায়েলের সর্বত্র বিশেষত অধিকৃত গাজা ভূখন্ডে গারকাদ গাছ ব্যাপকহারে  দেখতে পাওয়া যায়।ইহুদিরা কোথাও পালাবার স্থান পাবে না। গাছের আড়ালে পালানোর চেষ্টা করলে গাছ বলবে, হে মুসলিম! আসো, আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। আসো এবং তাকে হত্যা কর। পাথর বা দেয়ালের পিছনে পলায়ন করলে পাথর বা দেয়াল বলবে, হে মুসলিম! আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে, আসো! তাকে হত্যা কর। তবে গারকাদ নামক গাছ ইহুদিদেরকে ...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

উটের যুদ্ধ ইসলামের প্রথম ভাতৃঘাতি যুদ্ধ

#মো.আবু রায়হান উটের যুদ্ধ বা উষ্ট্রের যুদ্ধ বা জামালের যুদ্ধ ( Battle of the Camel) ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ইরাকের বসরায় সংঘটিত হয়। এটি ইসলামের ইতিহাসের প্রথম গৃহযুদ্ধ।এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী এর বিরুদ্ধে হযরত তালহা-জুবায়ের ও আয়েশা (রা)সম্মলিত যুদ্ধ। পটভূমি হযরত ওসমান (রা) এর বিভিন্ন প্রদেশে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগ নিয়ে একদল তার বিরুদ্ধে অভিযোগ টেনে বিদ্রোহ শুরু করে।হযরত ওসমান বিভিন্নভাবে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন। তাদের কথামত মিশরের গভর্নরকে প্রতিস্থাপন করে আবু বকরের ছেলে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর কে নিয়োগ করলেও বিদ্রোহীরা শান্ত হয় নি। তারা নানাভাবে অভিযোগ টেনে এনে ওসমান (রা) এর অপসারণের দাবী করতে থাকে। ওসমান সবকিছু মীমাংসার আশ্বাস দিলেও তারা ৬৫৬ সালের ১৭ জুন তারা বাড়ি অবরুদ্ধ করে এবং এক পর্যায়ে তারা তার কক্ষে প্রবেশ করে কুরআন তেলাওয়াত করা অবস্থায় হত্যা করে।ওসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডের পর আলী (রা.) খলিফা হন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে যখনই আলী (রা.) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন তখনই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবের কার...