নির্যাতিত চিনের উইঘুর মুসলিমরা। নিশ্চুপ কেন মুসলিম বিশ্ব?

মিয়ানমার সরকার যখন হাজার হাজার সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাকে হত্যা করে এবং সাত লাখ রোহিঙ্গাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করে, মুসলিম বিশ্ব চুপ ছিল না। প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন যখন তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর করে তখনও তীব্র ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিল তারা। কিন্তু চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং প্রদেশে ইসলামকে দমন করার যে নারকীয় চেষ্টা, সে বিষয়ে তারা সবসময়ই নীরব। কেন?
উইঘুর মুসলমানদের বাস জিনজিয়াং অঞ্চলে। চীনের বৃহত্তম এ প্রদেশটিতে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ।
চীনের মোট আয়তনের এক ষষ্ঠাংশজুড়ে জিনজিয়াং। যার আয়তন বাংলাদেশের আয়তনের ১২ গুণ!এর আয়তন পূর্ব ইউরোপের দেশ জার্মান, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও স্পেনের সমন্বিত আয়তনের প্রায় সমান। এমনকি এটি স্বাধীন দেশ হলে ভৌগোলিক আয়তনের দিক থেকে পৃথিবীর ১৬তম বৃহত্তম দেশ হতো।র আয়তন ১৬ লাখ ৪৬ হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ১ কোটি ৭০ লাখ। মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশই মুসলিম। ১৯৪৯ সারে চীনে কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার পর থেকে জিনজিয়াং অঞ্চলে মুসলমানদের ওপর জুলুম-নির্যাতন শুরু হয়।
মধ্য এশিয়ায় বসবাসরত তুর্কি বংশোদ্ভূত একটি জাতিগোষ্ঠী।উইঘুররা এই অঞ্চলের সরকারিভাবে স্বীকৃত ৫৬টি নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অন্যতম। এখানকার ৮০% উইঘুর অঞ্চলের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলে তারিম বেসিনে বসবাস করে।জিনজিয়াং এর বাইরে উইঘুরদের সবচেয়ে বড় সম্প্রদায় দক্ষিণ মধ্য হুনান প্রদেশে রয়েছে।] চীনের বাইরে মধ্য এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্র যেমন কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উইঘুর বাস করে।

শুধু মুসলমান হওয়ার অপরাধে ১০ লাখেরও বেশি উইঘুর মুসলিমকে অবৈধভাবে জিনজিয়াংয়ের ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে’ আটকে রাখা হয়েছে।   ‘কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে সমাজের মূল ধারায় নেয়ায় প্রক্রিয়া’র নামে সেখানে তাদের ওপর চালানো হচ্ছে নির্মম নির্যাতন। যা আধুনিক ইতিহাসে মুসলমানদের ওপর সবচেয়ে নির্লজ্জ সম্মুখ হামলা-নির্যাতন।

আর এই দমন-নিপীড়নের প্রতিবাদে বিশ্বের ৪৯টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ প্রায় কিছুই বলেনি। মালয়েশিয়া গত বছর এক ডজন উইঘুর শরণার্থীকে চীনে ফেরত পাঠাতে অস্বীকার করেছিল, কুয়েত পার্লামেন্টের চার সদস্য জানুয়ারিতে উইঘুরদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছিল এবং তুরস্ক গত মাসে চীনের নির্মম আচরণের নিন্দা জানিয়েছিল।


ব্যস, এটুকুই। বাকি ৪৬টি দেশ বিষয়টি নিয়ে কিছুই বলেনি, বলা ভালো এড়িয়ে গেছে। একমাত্র আল-জাজিরা ছাড়া আরব মিডিয়াগুলোতে এমনকি ইরান, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার মতো বড় মুসলিম দেশগুলোতেও এ বিষয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য করতে শোনা যায়নি। কেন? বিষয়টি অবাক করা মতো! 

কমিউনিস্ট দেশ চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জানার একমাত্র উপায় দেশটির সরকারি বার্তা সংস্থা সিনহুয়া ও সরকার নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম কর্তৃক পরিবেশিত সংবাদ। ফলে চীনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বা সরকারবিরোধী কোনো আন্দোলনের খবর বাইরে আসে কদাচিৎ।

চীনে উইঘুর ও অন্য মুসলিম জাতিগোষ্ঠীগুলো দীর্ঘ দিন ধরেই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কিন্তু এসব তথ্য গণমাধ্যম বা বহির্বিশ্বে উঠে এসেছে গত বছরই। বন্দি শিবির থেকে পালিয়ে যাওয়া অনেকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোকে বলেছেন, তাদের ইতিহাস-ঐহিত্য মুছে ফেলতে এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য তাদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে রেখে অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হচ্ছে। 


মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এসব ক্যাম্পে যাদেরকে রাখা হয়েছে তাদেরকে চীনা ম্যান্ডারিন ভাষা শেখানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, তাদের নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাসের সমালোচনা করতে অথবা সেই ধর্ম পরিত্যাগ করতে।

তবে এসব বক্তব্যকে 'সম্পূর্ণ মিথ্যা’ দাবি করে বেইজিং বলছে, অঞ্চলটিতে উইঘুর সম্প্রদায়ের কিছু লোক ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী’ তৎপরতায় লিপ্ত। তাদের দমন করতে ‘শুদ্ধি অভিযান’ চালানো হচ্ছে এবং উগ্রবাদীদের সংশোধন ক্যাম্পে পাঠানো হচ্ছে। 

জিনজিয়াংয়ে মুসলমানদের বসবাসের ইতিহাস ১৩০০ বছরের বেশি পুরনো। ১৯৪৯ সালে মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে চীনের অভ্যুদয়ের সময় প্রদেশটির জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ মুসলমান ছিল; বর্তমানে যা মাত্র ৪৫ শতাংশ। 

উইঘুরদের ভাষা অনেকটা তুর্কি ভাষার মতো। সংস্কৃতিগত দিক দিয়েও তুর্কিদের সঙ্গে তাদের অনেকটাই মিল। চীনের অন্যসব এলাকার ওপর প্রাধান্য বিস্তারকারী ‘হান জাতিগোষ্ঠী’ থেকে উইঘুররা সম্পূর্ণ আলাদা। শত শত বছর ধরে বঞ্চনা ও নির্যাতন সত্ত্বেও উইঘুররা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য আঁকড়ে ধরে আছে ।


চীনের সব সরকারেরই, এমনকি সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে অভ্যুদয়ের আগেও, ‘হান জাতিগোষ্ঠী’র মূল্যবোধের প্রতি আনুগত্য ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিত ‘আত্তীকরণ’ নীতি বজায় ছিল। তাদের দ্বারা মুসলিমদের ওপর অত্যাচার খুব একটা অবাক করা কোনো বিষয় নয়।

তবে মুসলিমদের প্রতি এত নির্যাতনের পরও মুসলিম বিশ্বের নীরবতা বিস্ময়করই বটে। কেন তারা নীরব?

তার মূল কারণ ‘অর্থ’। দেশে দেশে বড় অঙ্কের ঋণ ও অনুদান দিচ্ছে বিশ্বের বর্তমান এক নম্বর অর্থনৈতিক অগ্রগতির দেশ চীন। আরব দেশগুলোতে ২0 বিলিয়ন ডলারের ঋণ, পাকিস্তানে ছয় বিলিয়ন ডলার, পার্শ্ববর্তী মুসলিম দেশগুলোতে আরো বেশি (২৭ বিলিয়ন ডলার শুধু কাজাখস্তানে যৌথ শিল্প প্রকল্পে) ঋণ/অনুদান দিয়েছে দেশটি।

মুসলিম দেশগুলোর প্রয়োজন অর্থ। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী উইঘুর মুসলিমদের নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো এতটা বোকা নয় তারা। তাই তারা চুপ; একইভাবে তাদের গৃহপালিত গণমাধ্যমগুলোও চুপ।
সৌদি আরবের কার্যত স্বৈরশাসক যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান তার সাম্প্রতিক চীন সফরকালে জিনজিয়াংয়ে চীনা সরকারের নেয়া কথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ এবং ‘চরমপন্থী’ পদক্ষেপের সমর্থন জানিয়েছেন।

অবশ্য, সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যার পেছনে তার নির্দেশ ছিল বলে বিশ্বজুড়ে তার বিরুদ্ধে যে ঝড় উঠেছিল সেই লড়াইয়ে চীনের সমর্থন প্রয়োজন সৌদি যুবরাজের।
(সংকলিত ও সম্পাদিত )

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল