কৃষকের সঙ্গে মশকরা কি বন্ধ হয়েছে?
সাম্প্রতিক সময়ে ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া নিয়ে সারাদেশের কৃষকের মধ্যে জ্বলছে ক্ষোভের আগুন । ধানের মূল্য উৎপাদন খরচের চেয়ে কম হওয়ায় কৃষকেরা পড়ছেন ভীষণ বিপাকে। কষ্টে উৎপাদিত ফসলটুকু যেন আরেকটি কষ্টের প্রতিচ্ছবি। ধানের ন্যায্য দাবি আদায়ে যখন দেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষকেরা বিচ্ছিন্নভাবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছেন তখন দুএকজন এমপি মন্ত্রীর অযাচিত মন্তব্য কৃষক সমাজকে করেছে বিক্ষুব্ধ ও মর্মাহত। টাঙ্গাইলের একজন কৃষক যখন ধানের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে ধানের ক্ষেত যখন আগুনে পুড়িয়ে ফেললেন। প্রথম আলোসহ অধিকাংশ পত্রিকায় খবরটি এসেছে।
ধানের দাম কম। আবার কৃষি শ্রমিকের মজুরি বেশি। এই রাগে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার বানকিনা গ্রামের কৃষক আবদুল মালেক সিকদার গতকাল রোববার দুপুরে নিজের পাকা ধানে পেট্রল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেন। এ দৃশ্য পত্র পত্রিকায় ও সোসাল মিডিয়ায় আসার পরে দেশবাসীই যেন চরমভাবে দগ্ধ হয়েছেন।দগ্ধ হননি মন্ত্রী মশাই। বিবেক দংশন করেনি তাকে। এদেশের ৮০% কৃষক। সরাসরি কৃষি পেশায় জড়িত অসংখ্য মানুষ। এদেশের অভিজাত বলে দাবি করা কৃষিকে হেয় জ্ঞান করা অনেক মানুষের শরীর থেকে এখনো বের হয় গ্রামের পচা কাদা মাটির দুর্গন্ধ। হয়তো উন্নত মানের পারফিউম বেশভূষায় পরিবর্তন করে বাবু সেজেছেন। শিকড় ভুলে গেছেন। টাঙ্গাইলের ঘটনার পর একজন মন্ত্রী বলেছেন -
" সরকারকে বিব্রত করার জন্য না কি কৃষক ষড়যন্ত্র করে পাকা ধানে আগুন দেওয়ানো হয়েছে।"একথা বলার পরে দেশ জুড়ে চলে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা। এ সমালোচনায় বিবেকের তাড়নায় যুক্ত হন জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ। তিনি যেন আগুনে ঘৃতাহুতি দেন ফেসবুকে একটি স্টাটাস দেন। যাতে তিনি মন্ত্রীর কঠোর সমালোচনা করেন। তার সেই ফেসবুক পোস্টটি ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়েছে। ফেসবুক পোস্টটির নির্বাচিত কিছু অংশ ছিল -
"কৃষককে ধানের মূল্য দিতে পারবেন না, বিনয়ের সঙ্গে সম্মানিত কৃষকদের সীমাবদ্ধতার কথা অবহিত করুন। সমস্যা কোথায়? অসীম সমস্যার এই দেশে সব কিছু রাতারাতি ঠিক হবে না, একথা বিনয়ের সঙ্গে বললে মানুষ গ্রহণ করবে।
একজন অসহায় কৃষকের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকেও সহ্য করতে পারবেন না? আপনি তো সামরিক স্বৈরাচারের মন্ত্রী নন।.............
ইউনিয়ন চেয়ারম্যান থেকে ধাপে ধাপে ধান আবাদি মানুষের সহযোগিতা, সমর্থনে আজকের পর্যায়ে এসেছেন। অন্ততঃ আপনি কৃষকের সঙ্গে মসকরা করতে পারেন না।
"এরপরও কি কৃষকের সঙে মশকরা বন্ধ হয়েছে? না বন্ধ হয়নি। গত কয়েকদিন ধরে কৃষকের খেতে ডিসি ব্যাংকার শিক্ষক সাংবাদিক এবং ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের ধান কাটার ফটোসেশন আরেক হাসি তামাশার জন্ম দিয়েছে।তাদের এ ধান কাটার দৃশ্য ফটোসেশন দেখে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের বহুল পঠিত একটি কবিতার কয়েকটি পংক্তি মনে পড়ে গেল।
“ চিরসুখীজন ভ্রমে কি কখন
ব্যথিতবেদন বুঝিতে পারে।
কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে
কভূ আশীবিষে দংশেনি যারে ”
এই মুহূরতে কৃষকের মনে কি যে কষ্টের বহ্নি শিখা উদগিরিত তা কৃষক মনই শুধু জানে। প্রতিটি কৃষকের মন আজ সুপ্ত ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তারা অগ্নিবারুদের মতো জ্বলে নিঃশেষ করে দিতে পারে অনাচার অবিচারের তখতে তাউস। কৃষকদের রয়েছে আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল অতীত। বৃটিশদের নাকানি চুবানি দেওয়ার সেই উত্তাল কৃষক আন্দোলন আজও কৃষকদের প্রেরণা দেয়।
কৃষকদের সঙে নতুন মশকরা যুক্ত হয়েছে ক্ষেতে আগুন দেওয়া ঘটনাটি বাংলাদেশে নয় ভারতে।
দিন যাচ্ছে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করে শুধু ফটোশেসন ও কৌতুকপূর্ণ মন্তব্য নিয়ে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছি।প্রতি মণ ধানের জন্য কৃষকের উৎপাদন খরচ পড়েছে অন্তত ৯৬০ টাকা। সরকার সেখানে দর বেঁধে দিয়েছে এক হাজার ৪০ টাকা। এতে প্রতি মণে কৃষকের বড়জোর ৮০ টাকা লাভ হতে পারে। অন্যদিকে দেশের কোনো অঞ্চলেই কৃষকরা ৫২৫ থেকে ৫৫০ টাকার বেশি দর পাচ্ছে না।
চাল আমদানিতে এখন ৫৫ শতাংশ কর দিতে হবে।তারপরও আশংকা থেকে যায়। আপাতত পুরোপুরি চাল আমদানি বন্ধ করে কৃষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করা জরুরী। আসুন মশকরা বাদ দিয়ে কৃষকদের ন্যায্য পাওনা দিয়ে তাদের পরিশ্রমের একটু হলেও প্রতিদান দেই। তারা তো আমাদেরই একজন। আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার একজন পরিশ্রান্ত কর্মী।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন