ভ্রূণ হত্যা ইসলামে নিষিদ্ধ ও বর্তমানে প্রচলিত আইন

মো আবু রায়হানঃবাংলাদেশের বর্তমানে ভ্রণ হত্যা বা গর্ভপাত আশংকা জনকভাবে বেড়ে গেছে। যদিও ভ্রূণ হত্যা বাংলাদেশের আইনে নিষিদ্ধ তারপরও গোপনে বিভিন্ন হসপিটাল ও ক্লিনিকে গর্ভপাত করানো হয়। যা নৈতিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিতে বেমানান ও অগ্রহণযোগ্য। আজকের আলোচনা ভ্রণ হত্যা নিয়ে ইসলাম ও বাংলাদেশের আইন কি বলে তা নিয়ে আলোচনা।
সাধারণত কোনো স্ত্রীর গর্ভের ভ্রুণ নষ্ট করাকে গর্ভপাত বলে।
গর্ভধারণের পর প্রথম আট সপ্তাহের মধ্যে একটি ভ্রূণ সন্তান হিসেব রূপলাভ করতে থাকে,প্রথম অবস্থায় এটি মাংস পিন্ড হিসেবে নারীর দেহের একটি অরগান হিসেবে থাকে। ধীরে ধীরে তা বিকাশ লাভ করে ও প্রাণ সঞ্চারিত হয়। 
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, ভ্রুণের বয়স যখন হয় তেতাল্লিশ দিনের কম, তখন ভ্রুণ একটি রক্তপিণ্ড হিসেবে মায়ের গর্ভে অবস্থান করে। এ সময় পর্যন্ত তার কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রকাশ পায় না।আধুনিক যুগে ভ্রুণ হত্যা জাহেলি যুগে কন্যা সন্তানকে জীবন্ত সমাধিস্থ করার মতোই। তখন বাবা নিজ মেয়েকে গর্তে পুঁতে ফেলত আর এখন আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে মায়ের পেটেই শিশুকে মেরে ফেলা হচ্ছে।
বর্তমান সমাজ তথা রাষ্ট্রে নীতি নৈতিকতার অবক্ষয়ে বিভিন্ন প্রকারের সামাজিক সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে সেসব সমস্যায় মূলত ভ্রূণ হত্যার জন্য দায়ী। উল্লেখযোগ্য কারণ গুলো হলো
#দারিদ্রতা
#যেনা ব্যাভিচার করে গর্ভধারণ ও সামাজিক স্বীকৃতি না পাবার ভয়ে ভ্রুণ হত্যা।
#তথাকথিত প্রেম ছেলেমেয়েদের অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক। ছেলেদের নারীর গর্ভের সন্তান অস্বীকার করার কারণে।
#স্বামী স্ত্রীর বিচ্ছেদ স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হওয়া
#স্ত্রীর ক্যান্সার বা অন্য কোনো মরণ ব্যাধি যা বিকলাঙ্গ শিশু জন্মদিতে পারে এজন্য গর্ভপাত করা
#আধুনিক আবিষ্কার আলট্রাসোনোগারাফিতে কন্যা শিশু সনাক্ত হলে গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত
#লিঙ বৈষম্যের কারণে ভ্রণ হত্যা
#সামাজিক মর্যাদা রক্ষায়
#সম্পদে উত্তরাধিকার নির্ণয়ের কন্যা সন্তান বাঁধা এজন্য কন্যা ভ্রণ হত্যা।
#জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করেও দুর্ঘটনা ক্রমে সন্তান গর্ভে ধারণ।
উপরিউক্ত মেজর কারণে ভ্রূণ হত্যা সংঘটিত হচ্ছে অহরহ।তবে অধিকাংশ ভ্রূন হত্যা হচ্ছে নষ্ট চরিত্রের ফসল।
গবেষণা সংস্থা গাটমেচারের তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৬ লাখ ৪৬ হাজারের অধিক গর্ভপাত হয়, এবং অধিকাংশই হচ্ছে অনিরাপদ পদ্ধতিতে। সারাদেশে প্রতি ১০০০ জন নারীর (বয়সসীমা ১৫-৪৪) ১৮.২ জন নারী গর্ভপাত করেন নানা কারণে এবং গর্ভপাত-সংক্রান্ত মৃত্যুর হার মোট গর্ভপাতের ১% বা প্রায় ৭ হাজার, যাদের অধিকাংশই ঘটে গর্ভপাত নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে বিভিন্ন জটিলতার কারণে।
২০১৩ সালে প্রকাশিত পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক জরিপ বলছে, বাংলাদেশের প্রায় ১৮ শতাংশ মুসলিম নাগরিক নৈতিক বিবেচনায় গর্ভপাত সমর্থন করেন৷ অর্থাৎ প্রতি পাঁচজন বাংলাদেশি মুসলমানের মধ্যে একজন গর্ভপাতের পক্ষে৷ ৩৭টি দেশের মসুলমানদের উপর পরিচালিত এই জরিপে বাংলাদেশেই গর্ভপাতের পক্ষে সবচেয়ে বেশি মানুষ পাওয়া গেছে৷
কয়েকটি উপায়ে গর্ভপাত ঘটানো হয়। পেটের ভ্রণ যন্ত্রের মাধ্যমে টুকরো টুকরো করে, সাত সপ্তাহের মধ্যে হলে ঔষধ প্রয়োগ করে। সবচেয়ে সস্তা পদ্ধতি হলো মায়ের জঠরে বিষ বা লবণ প্রয়োগ করে হত্যা এবং চব্বিশ ঘন্টা পর মৃত বাচ্চা প্রসব করানো ।এসব নিষ্ঠুর পদ্ধতি অবলম্বন করে ভ্রূণ হত্যা করা হয়।
দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সার এইডসসহ অন্যান্য রোগের উপসর্গ থাকলে ওলামাদের মতে গর্ভপাত সিদ্ধ হতে পারে। যেখানে জীবন হানির আশংকা আছে সেখানে ইসলাম জীবন বাঁচানোর জন্য এমন গর্হিত কাজ করা সাময়িক বৈধতা দিয়েছে।
যদি স্তন দানকারিনী গর্ভবতী হয়ে দুধ বন্ধ হওয়ার ও বাচ্চা মারা যাওয়ার আশঙ্কা হয়, এ অবস্থায় গর্ভে বীর্য জমাট রক্ত কিংবা গোশতের টুকরাকারে থাকলে এবং কোনো অঙ্গ প্রকাশ না পেলে চিকিৎসার মাধ্যমে গর্ভপাত করানো যাবে। (ফতওয়ায়ে কাজিখান : ৩/৪১০)
ভ্রুণের বয়স যখন তেতাল্লিশ দিন হয়ে যায়, তখন থেকে তার প্রয়োজনীয় অঙ্গ ফুসফুস, নাক, হাত ও বিশেষ কিছু হাড় ইত্যাদি প্রস্তুত হওয়া শুরু হয়। তখন থেকে শুরু করে চার মাস পর্যন্ত গর্ভপাতের মাধ্যমে বা অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় ভ্রুণটি নষ্ট করে ফেলা মোটেও উচিত নয়। (আদ্দুররুল মুখতার : ১০/২৫৪)।
ভ্রুণকে জীবন হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। সূরা আল-মায়দাহের ৩০তম আয়াতে বলা হয়েছে, ‘‘যে বা যারা একটি আত্মার জীবনকে হত্যা থেকে বিরত থেকেছে, সে বা তারা যেন সব মানুষের জীবনকে হত্যা থেকে বিরত থেকেছে৷ যে বা যারা একটি আত্মাকে হত্যা করেছে, সে বা তারা যেন পুরো মানবজাতিকেই হত্যা করেছে৷’’ আর অধিকাংশ মুসলিম পণ্ডিত মনে করেন, গর্ভে থাকা ভ্রুণকেই ইসলাম জীবন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়৷
অনেকে জাহিলী যুগে দারিদ্রতার ভয়ে কন্যা সন্তান হত্যা করত।  যিনি তার বান্দাকে এত যত্ন করে সৃষ্টি করেছেন, তিনি তার রিজিকেরও ব্যবস্থা করবেন। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানকে দরিদ্রতার ভয়ে হত্যা কর না। আমরা তোমাকে এবং তোমার সন্তানকে রিজিক দান করি। তাই তাদের হত্যা করা সত্যিকার অর্থেই একটি মহাপাপ।’ (সূরা ইসরার : ৩২)
গর্ভপাত যদি ইচ্ছাকৃতভাবে হয়ে থাকে, কোনো ধরনের কারণ যদি এর মধ্যে না আসে তাহলে এটি হারাম। এটি যে অবস্থা বা যত দিনেই হোক না কেন। কারণ যেহেতু একটি বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পরে সেটাকে ধ্বংস করা আর সেটা যদি মানবভ্রূণ হয়ে থাকে তাহলে কোনো অবস্থাতেই এটি হালাল নয়, যেহেতু রাসুল (স.) বলেছেন, ‘জা-লিকাল ওয়াদুল খাফি’ অর্থাৎ এটি গোপন হত্যা। এটি গোপনীয়ভাবেই ভ্রূণ হত্যা যেটি সম্পূর্ণ হারাম করা হয়েছে।
স্মরণ কর ওই দিনকে, যেদিন জীবন্ত সমাধি দেয়া নিষ্পাপ বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করা হবে, তোমাকে কোন অপরাধের কারণে হত্যা করা হয়েছে?’ (সূরা তাকয়ির : ৮)
বিশ্বের সব মুসলিম দেশে ভ্রণ হত্যা আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শুধু তিউনিসিয়ায় ভ্রণ হত্যার বৈধতা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে ১৮৬০ সালের পেনাল কোডের কয়েকটি ধারার মাধ্যমে ভ্রুণ হত্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং সাজার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যদিও পরবর্তীতে কিছু সংশোধনী আনা হয়েছে কিছু ক্ষেত্রে ভ্রুণ হত্যার বৈধতা দেওয়া হয়েছে। দন্ডবিধি আইনের ৩১২ থেকে ৩১৬ ধারা পর্যন্ত গর্ভপাত সংক্রান্ত আইন ও সাজার কথা বলা হয়েছে। এরমধ্যে ৩১২ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো নারী গর্ভপাত ঘটালে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তিন বছর সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড বা জরিমানা বা উভয় প্রকার শাস্তি পেতে পারে।বাংলাদেশের গর্ভপাত-সংক্রান্ত অধিকাংশ আইন মূলত ব্রিটিশ আমলের ১৮৬০ সালের পেনাল কোড থেকে আসা, যা অনুসারে গর্ভপাত নিষিদ্ধ, যদি না নারীর জীবন বাঁচাতে গর্ভপাতের প্রয়োজন হয়। তবে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী কালীন সময়ে গর্ভপাতের আইনের ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা আনা হয়। যেমন, ১৯৭২ সালের আইন অনুসারে যেসব নারী মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তাদের জন্য গর্ভপাত বৈধ করা হয়েছিলো। এছাড়া, ১৯৭৯ সালে মাসিক নিয়মিতকরণ বা মেনস্ট্রুয়াল রেগুলেশনের ( এমআর) অধীনে, অর্থাৎ, নারীদের ঋতুস্রাব নিয়মিত করার জন্য গর্ভপাত বৈধ করা হয়। মূলত, বাংলাদেশে এই পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে বৈধভাবে (আইনগতভাবে) গর্ভপাত করানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কিছু ব্যতিক্রমবাদে পেনাল কোডের মূল আইন অনুসারে বাংলাদেশে গর্ভপাত নিষিদ্ধ। এমনকি ধর্ষণের ফলে গর্ভধারণ, শারীরিক ও মানসিক দুরাবস্থার কারণে গর্ভধারণ চালিয়ে যেতে না পারা, অর্থনৈতিক অথবা সামাজিক কারণ, কিংবা গর্ভের ভ্রুণের জৈব অথবা শারীরিক ক্রটি ইত্যাদি ক্ষেত্রে-ও গর্ভপাত নিষিদ্ধ। এমনকি যেসব ক্ষেত্রে গর্ভপাত আইনগতভাবে বৈধ সেইসব ক্ষেত্রে স্বামী অথবা অভিভাবকের সম্মতির প্রয়োজন পড়ে, অর্থাৎ, নারীর একার সিদ্ধান্তে গর্ভপাত করা যাচ্ছে না। ফলে স্বামী বা অভিভাবকবিহীন নারীদের অথবা যেসব ক্ষেত্রে তাদের অনুমতি পাওয়া যায় না পারিবারিক অথবা সামাজিক অনৈক্যের কারণে সেসব ক্ষেত্রে নারীরা হয়রানির শিকার হন।
তাই আসুন ভ্রূণ হত্যার মতো জঘন্যতম কাজ হতে নিজেদের বিরত রাখি। এ পাপাচার হতে সমাজকে মুক্ত রাখি।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল