সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষকের মর্যাদা

শিক্ষক সমাজ হলেন জাতির সুনাগরিক তৈরির করার সুমহান কারিগর ও সেবক। শিক্ষকদের শিক্ষা ও শ্রমের ফলেই সমগ্র বিশ্ব উদ্ভাসিত হয়েছে সভ্য সমাজ ও শিক্ষিত জাতি। শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড আমরা জানি সেই মেরুদন্ডী সমাজ বিনির্মাণের কারিগর শিক্ষকরা।এপিজে আবুল কালামের কথা -"যদি একটা দেশকে সম্পূণর্রূপে দুর্নীতিমুক্ত ও একটা জাতিকে সুন্দর মনের অধিকারী করতে হয়, তাহলে আমি বিশ্বাস করি, তিনজন ব্যক্তি এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারেন- বাবা, মা ও শিক্ষক।"
বাবা মা জন্ম দিয়ে শিক্ষকের কাছে দেন। শিক্ষক তাকে সুশিক্ষা দিয়ে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে। ইসলাম দিয়েছে শিক্ষা ও শিক্ষকের মর্যাদা যা আমরা কুরআন হাদিস ও বিভিন্ন ঘটনাবলী দ্বারা জানতে পারি। সাহাবা ও তৎপরবর্তীতে আমরা শিক্ষকদের মর্যাদা দেখতে পাই।
উমর (রা.) ও উসমান (রা.) তাদের শাসনামলে শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তারা শিক্ষক ও ধর্মপ্রচারকদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করেছিলেন। আবদুর রহমান ইবনুল জাওজি (রহ.) তার বিখ্যাত ‘সিরাতুল উমরাইন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) হজরত ওসমান ইবনে আফ্ফান (রা.)-এর যুগে মুয়াজ্জিন, ইমাম ও শিক্ষকদের সরকারি ভাতা দেওয়া হতো। (কিতাবুল আমওয়াল, পৃষ্ঠা: ১৬৫)

আইয়ামে জাহেলিয়ার সেই যুগে মহানবী (স.) শিক্ষক হয়ে এসে অন্ধকার সমাজে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছিলেন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমাকে শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। তাই তিনি শিক্ষা, শিক্ষা উপকরণ, শিক্ষক ও শিক্ষার ব্যাপকীকরণে সদা সচেষ্ট ছিলেন। বদরের যুদ্ধে বন্দি কাফিরদের তিনি মদিনার শিশুদের শিক্ষা দেয়ার বিনিময়ে মুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন, যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল ও উদার ঘটনা।এখানে শিক্ষক ও শিক্ষার মর্যাদা প্রকাশ পেয়েছে। পবিত্র কোরআনের প্রথম নাজিলকৃত আয়াতে জ্ঞানার্জন তথা বিদ্যাশিক্ষার কথা বলা হয়েছে। এ মর্মে আল্লাহতাআলা ইরশাদ করেন, ‘পড়! তোমার প্রভুর নামে নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন একবিন্দু জমাট রক্ত থেকে। পড়! আর তোমার প্রতিপালক পরম সম্মানিত। যিনি কলমের দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না।’ (সূরা আল-আলাক, আয়াত: ১-৫) আল-কোরআনের শিক্ষার আলোকে জ্ঞানার্জনের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর ওপর বিদ্যা অর্জন করা ফরজ।’ (ইবনে মাজা )
যার থেকে জ্ঞান অর্জন করবো সেই শিক্ষককে যথার্থ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে ইসলামে। হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করনে, 'তোমরা জ্ঞান অর্জন কর এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য আদব শিষ্টাচার শিখ। তাকে সম্মান কর; যার থেকে তোমরা জ্ঞান অর্জন কর।

ইমাম তিরমিযী (রাহি.) আবূ উমামাহ আল বাহিলী (রা.)-র সূত্রে বর্ণনা করেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে দু’জন ব্যক্তির আলোচনা করা হলো তাদের একজন— আবিদ তথা ইবাদতমগ্ন ব্যক্তি, আরেকজন হলো শিক্ষিত ও জ্ঞানী।
তিনি বললেন, ইবাদতে মগ্ন ব্যক্তির চেয়ে শিক্ষিত ও জ্ঞানী লোকটির মর্যাদা, তোমাদের সাধারণ কারো চেয়ে আমার মর্যাদার মতো। তারপর তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষকে কল্যাণকর বিষয় শিক্ষা দেয় আল্লাহ তার ওপর অনুগ্রহ করেন। ফেরেশতা, আকাশ ও জমিনবাসী এমনকি গর্তের পিঁপড়া, পানির, মাছও তার জন্য দোয়া করে।
কিন্তু আমাদের সমাজ তথা রাষ্ট্রে শিক্ষকতা পেশাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ও খাটো করে দেখা হয়। সভ্যতার সূচনা ও বিকাশে শিক্ষক সমাজই অগ্রগামী। সেই শিক্ষক সমাজের অধিকার আজ ভূলুণ্ঠিত। তাদের যথাযথ প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা  অনেক ক্ষেত্রে দেওয়া হয় না। একটি সুন্দর রাষ্ট্র বিনির্মাণের কারিগর মানবেতর জীবন যাপন করেন। যা খুবই দুঃখজনক। হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, একদিন জনৈক বয়স্ক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবারে হাজির হলে উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম নিজ স্থান থেকে সরে তাকে জায়গা করে দেন।তখন তিনি ইরশাদ করেন, 'যারা ছোটদের স্নেহ ও বড়দের সম্মান করে না, তারা আমাদের দলভুক্ত নয়।' (তিরমিজি )
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী ছাড়া কেউই আমার আপন নয়। এই হাদিসের আলোকে বলা যায়, যারা শিক্ষকদের তুচ্ছতাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে, অপমান করে-তারা তো পরোক্ষভাবে হজরত রাসুলুল্লাহর (সা.) আপনজনদেরই তুচ্ছতাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখছে; তাদেরই অপমান করছে। আর হজরত রাসুলুল্লাহর (সা.) আপনজনদের সঙ্গে বিরূপ ধারণা পোষণকারী কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহর রাসুলের (স.) সুপারিশ লাভ থেকে বঞ্চিত হবে।
একবার হজরত জায়েদ ইবনে সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহু তার সওয়ারিতে ওঠার জন্য রেকাবে পা রাখলেন। তখন ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু রেকাবটি শক্ত করে ধরেন।
হজরত জায়েদ ইবনে সাবিত বললেন, ‘ হে আল্লাহর রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চাচাতো ভাই! আপনি (রেকাব থেকে) হাত সরান।
উত্তরে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ‘ না’, আলেম ও বড়দের সঙ্গে এমন সম্মানসূচক আচরণই করতে হয়।’
ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষকতা তথা শিক্ষার গুরুদায়িত্ব পালন অত্যন্ত সম্মানিত ও মহান পেশা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সামাজিক দায়িত্ব ও মর্যাদার দিক থেকে শিক্ষকতার এ মহান পেশা গুরুত্বপূর্ণ হলেও বর্তমান সমাজে এ মহান দায়িত্বকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখা হয়।
দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষকরা অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়।যার প্রমাণ আমরা বিভিন্ন সময়ে পেয়েছি। শিক্ষককে পা ধরতে বাধ্য করা। কান ধরে উঠবস করানো। কয়েকদিন পূর্বে পাবনায় কলেজ শিক্ষককে লাথি ঘুষি দিয়ে নাজেহাল করার মত ঘটনা ঘটেছে। যে ঘটনার দৃশ্য অবলোকনে পুরো জাতি স্তম্ভিত। শারীরিকভাবে নিগৃহীত হওয়ার পর শিক্ষকদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা আজ কোথায়? এগুলো অত্যন্ত ঘৃণ্য ও অমানবিক কাজ।শেষ করি কবি কাদের নেওয়াজের শিক্ষকের মর্যাদা কবিতার নির্বাচেত কিছু অংশ দিয়ে।
বাদশাহ্ কহেন, ''সেদিন প্রভাতে দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে
নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন,
পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ।
নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে
ধুয়ে দিল না'ক কেন সে চরণ, স্মরি ব্যথা পাই মনে।''
উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষকে আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে
কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে-
''আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির,
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

মো.আবু রায়হান:  কিয়ামত সংঘটিত হবার  পূর্বে হযরত ঈসা (আ.) এর সঙ্গে দাজ্জালের জেরুজালেমে যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধে ইহুদিরা দাজ্জালের পক্ষাবলম্বন করবে। হযরত ঈসা (আ.) দাজ্জালকে হত্যা করবেন।এদিকে  ইহুদিরা প্রাণ ভয়ে পালাতে চেষ্টা করবে।  আশেপাশের গাছ ও পাথর/ দেয়ালে আশ্রয় নেবে। সেদিন গারকাদ নামক একটি গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে। গারকাদ ইহুদীবান্ধব গাছ।গারকাদ একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হল কাটাওয়ালা ঝোঁপ।গারকাদ এর ইংরেজী প্রতিশব্দ Boxthorn। Boxএর অর্থ সবুজ ঝোঁপ এবং thorn এর অর্থ কাঁটা। এ ধরনের গাছ বক্সথর্ন হিসেবেই পরিচিত। এই গাছ চেরি গাছের মতো এবং চেরি ফলের মতো লাল ফলে গাছটি শোভিত থাকে।  ইসরায়েলের সর্বত্র বিশেষত অধিকৃত গাজা ভূখন্ডে গারকাদ গাছ ব্যাপকহারে  দেখতে পাওয়া যায়।ইহুদিরা কোথাও পালাবার স্থান পাবে না। গাছের আড়ালে পালানোর চেষ্টা করলে গাছ বলবে, হে মুসলিম! আসো, আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। আসো এবং তাকে হত্যা কর। পাথর বা দেয়ালের পিছনে পলায়ন করলে পাথর বা দেয়াল বলবে, হে মুসলিম! আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে, আসো! তাকে হত্যা কর। তবে গারকাদ নামক গাছ ইহুদিদেরকে ...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

উটের যুদ্ধ ইসলামের প্রথম ভাতৃঘাতি যুদ্ধ

#মো.আবু রায়হান উটের যুদ্ধ বা উষ্ট্রের যুদ্ধ বা জামালের যুদ্ধ ( Battle of the Camel) ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ইরাকের বসরায় সংঘটিত হয়। এটি ইসলামের ইতিহাসের প্রথম গৃহযুদ্ধ।এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী এর বিরুদ্ধে হযরত তালহা-জুবায়ের ও আয়েশা (রা)সম্মলিত যুদ্ধ। পটভূমি হযরত ওসমান (রা) এর বিভিন্ন প্রদেশে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগ নিয়ে একদল তার বিরুদ্ধে অভিযোগ টেনে বিদ্রোহ শুরু করে।হযরত ওসমান বিভিন্নভাবে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন। তাদের কথামত মিশরের গভর্নরকে প্রতিস্থাপন করে আবু বকরের ছেলে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর কে নিয়োগ করলেও বিদ্রোহীরা শান্ত হয় নি। তারা নানাভাবে অভিযোগ টেনে এনে ওসমান (রা) এর অপসারণের দাবী করতে থাকে। ওসমান সবকিছু মীমাংসার আশ্বাস দিলেও তারা ৬৫৬ সালের ১৭ জুন তারা বাড়ি অবরুদ্ধ করে এবং এক পর্যায়ে তারা তার কক্ষে প্রবেশ করে কুরআন তেলাওয়াত করা অবস্থায় হত্যা করে।ওসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডের পর আলী (রা.) খলিফা হন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে যখনই আলী (রা.) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন তখনই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবের কার...