খাদ্যে ভেজাল ও ওজনে কম দেওয়ার বিরুদ্ধে ইসলামের কঠোর হুশিয়ারি


মো আবু. রায়হানঃ খাদ্যে ভেজাল ও ওজনে কম দেওয়া একটি সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। একদিকে মানুষ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা অন্যদিকে খাদ্যে ভেজাল জনগণকে আতঙ্কিত করে তুলছে। খাদ্য বেশিদিন সতেজ ও সংরক্ষণ করার জন্য ফরমালিন ও বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল, রং ব্যবহার করা হচ্ছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নির্বিঘ্নে এসব করলেও কর্তৃপক্ষ যেন নিশ্চুপ। এসব খাদ্য খেয়ে জনগণ হচ্ছে অসুস্থ ও বিভিন্ন অসুখ বিসুখে আক্রান্ত। কিছু ব্যবসায়ী পণ্য বিক্রির সময় হরদম মিথ্যা কথা বলে ও কসম করে দ্রব্য বিক্রি করে যা ঠিক নয়। পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের সময় সব ব্যবসায়ীকে মিথ্যা কসম বর্জন করতে হবে। খাঁটি মাল বলে বিক্রি করে আদৌও খাঁটি কিনা সেটা বিক্রেতা খাঁটি বলে চালিয়ে দেয়। আবু কাতাদা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'ক্রেতা-বিক্রেতা যতক্ষণ বিচ্ছিন্ন হয়ে না যায়, ততক্ষণ তাদের চুক্তি ভঙ্গ করার ঐচ্ছিকতা থাকবে। যদি তারা উভয়েই সততা অবলম্বন করে ও পণ্যের দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করে, তাহলে তাদের পারস্পরিক এ ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে। আর যদি তারা মিথ্যার আশ্রয় নেয় এবং পণ্যের দোষ গোপন করে, তাহলে তাদের এ ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত শেষ হয়ে যাবে' (বুখারি-২০৭৯; মুসলিম -১৫৩২)।কারো কাছে পণ্যের খুঁত গোপন করে বিক্রি করা উচিত নয়। অবশ্যই দ্রব্য সামগ্রী বিক্রির আগে ক্রেতাকে পণ্যের দোষ গুণ বলে দেওয়া ভালো। না বলা তাকওয়ার বরখেলাপ ।এবিষয়ে ইমাম আবু হানিফার একটি ঘটনা বর্ণনা করছি।আল ইমাম আবূ হানিফা (র.) একবার ব্যবসায়ের অংশীদার হাফস ইবন আবদির রহমান এর নিকট কিছু কাপড় পাঠালেন বিক্রয়ের জন্য। তারমধ্যে একটি কাপড়ে কিছু খুত ছিলো। আবূ হানিফা গ্রাহককে খুত দেখিয়ে দেয়ার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু হাফস বিক্রয়ের সময় খুত উল্লেখ করতে ভুলে যান। এ কথা অবগত হয়ে আবূ হানিফা (র.) সমস্ত কাপড়ের বিক্রয়লব্ধ টাকা গরীব-দু:খীদের মাঝে বিতরণ করে দেন। খাদ্যে ভেজাল দেয়া ক্রেতার সাথে প্রতারণা করার শামিল। প্রতারণা ইসলামে নিষিদ্ধ।
হযরত আবূ হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- একদা রাসূল (স.) বাজারে এক খাদ্য স্তুপের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি খাদ্যস্ত‚পের ভিতরে হাত প্রবেশ করিয়ে দেখলেন ভিতরেরগুলো ভিজা। তিনি খাদ্য বিক্রেতার নিকট জানতে চাইলেন- এটি কেমন কথা? সে বলল- বৃষ্টিতে ভিজে গেছে, হে আল্লাহর রাসূল! তদুত্তরে রাসূল (স.) বললেন - তাহলে তুমি খাদ্যগুলো উপরে রাখনি কেন, যাতে মানুষ দেখতে পেত। অত:পর নবী (স.) বললেন- যে ব্যক্তি প্রতারণা করবে সে আমার উম্মাত নয়। (সহিহ মুসলিম, হাদিস - ১০২)।হযরত উমার (রা.) এর শাসনামলের একটি ঘটনা প্রণিধানযোগ্য। প্রজাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য খলিফা উমার রাতের আঁধারে ছদ্মবেশে বের হয়েছেন। পথিমধ্যে একঘর থেকে আওয়াজ শুনতে পেলেন- মা মেয়েকে বারবার দুধে পানি মিশাতে বলছে, কিন্তু মেয়েটি বলছে- খলিফা দুধে পানি মিশানো বেআইনী ঘোষণা করে ফরমান জারি করেছেন। মা বলল, খলিফা এতো রাতে তো এসে দেখছে না। একথা শুনে মেয়েটি বলল- খলিফা না দেখতে পারেন, আল্লাহ তো দেখছেন। এ মেয়েটির কাছ থেকে তাকওয়ার এ চমৎকার শিক্ষা নিলে আমরাও পেতে পারি নির্ভেজাল স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য। খাদ্যে ভেজাল দেওয়া এক প্রকার প্রতারণা ও তার তারা উপার্জিত অর্থ হারাম। এই হারাম উপার্জনের দ্বারা ইবাদত করলে আল্লাহ কবুল করবেন না। হযরত আবূ হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে নবী (স.) বলেন- “এক ব্যক্তি দীর্ঘ সফরে থাকা অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধূলিধূসরিত দেহ নিয়ে আকাশের দিকে দুহাত তুলে হে প্রভূ! বলে দোয়া করে, অথচ সে যা খায় তা হারাম, যা পান করে তা হারাম, যা পরিধান করে তা হারাম এবং হারামের দ্বারাই সে পুষ্টি অর্জন করে। তার মুনাজাত কিভাবে কবুল হতে পারে”! (সাহিহ মুসলিম, হাদিস -১০১৫)। হযরত সাদ (রা.) রাসূল (স.) এর নিকট আরজ করলেন- হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, যেন আমার দোয়া কবুল হয়। রাসূল (স.) বললেন- হে সাদ! তোমার উপার্জনকে হালাল রাখো, তোমার দোয়া কবুল হবে। মনে রেখো, কেউ যদি হারাম খাদ্যের এক লোকমাও মুখে নেয় তাহলে চল্লিশদিন যাবত তার দোয়া কবুল হবে না। (আল ইমাম আত তাবারানি, মুজামুল আওসাত )।খাদ্যে ভেজাল দেয়ার অর্থ হলো সত্যের সাথে মিথ্যার সংমিশ্রণ। আল্লাহ বলেন- তোমরা সত্যের সাথে অসত্যের মিশ্রণ ঘটাবে না। জেনেশুনে সত্য গোপন করো না। (সূরা বাকারাহ, আয়াত নম্বর- ৪২)।
ওজনে কম দেওয়া কিছু ব্যবসায়ীর আরেকটি নেতিবাচক দিক। নিজের মুনাফা বৃদ্ধির জন্য অন্যকে ঠকাতে এরা সিদ্ধহস্ত। এরশাদ হচ্ছে আল্লাহ পাক বলেন - যারা ওজনে কম দেয় তাদের জন্য ধ্বংস। তারা যখন লোকদের কাছ থেকে কিছু মেপে নেয়, তখন পুরোপুরি নেয়। আর যখন তাদের মেপে বা ওজন করে দেয়, তখন কম করে দেয়। তারা কি ভেবে দেখে না যে, তারা সেই কঠিন দিনে পুনরুত্থিত হবে, যেদিন সব মানুষ স্বীয় প্রতিপালকের সামনে দণ্ডায়মান হবে।' (মুতাফফিফীন ১-৫)।অনেক সময় লেনদেন করার পর ক্রেতা বুঝতে পারেন, তাকে ঠকানো হয়েছে। ওজনে কম দেওয়া হয়েছে। মানের দিকেও খারাপ জিনিস দেওয়া হয়েছে। তখন ক্রেতা বাসায় গিয়ে হায় হায় করে। আর আফসোস করতে থাকে। অথচ এভাবে ঠকানোর বিষয়ে আল্লাহ পবিত্র কোরআনে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, 'তোমরা ন্যায্য ওজন কায়েম করো এবং ওজনে কম দিয়ো না' (সুরা আর রহমান আয়াত- ৯)।অথচ আল্লাহ পাক ওজন পূর্ণ ও ন্যায় বিচার ও সুবিবেচক হওয়ার তাকিদ দিয়েছেন। আল্লাহপাক আরও বলেন, 'ওজন ও মাপ পূর্ণ করো ন্যায় সহকারে। আমি কাউকে তার সাধ্যের অতীত কষ্ট দিই না। যখন তোমরা কথা বলো, তখন সুবিচার করো, যদি সে আত্মীয়ও হয়। আল্লাহর অঙ্গীকার পূর্ণ করো' [সুরা আনয়াম আয়াত-১৫২)।ভারতীয় উপমহাদেশের শাসক আলাউদ্দিন খলজি তার শাসনকালে জনগণের সুবিধার জন্য মূল নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ও ওজনে কম দিলে যে পরিমাণ কম দেবে ঠিক সে পরিমাণ মাংস দোকানীর দেহ থেকে কেটে নেওয়ার ঘোষণা দেন। এতে করে ব্যবসায়ীদের ভেতর সততা তৈরি হয়েছিল।ওজনে কম দেয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালা হযরত শোয়াইব (আ) এর কাওম মাদাইনবাসিকে ধ্বংস করে দিয়েছেন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল