সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বৈশ্বিক শিক্ষক মর্যাদা ও কিছু প্রাসঙ্গিক কথা

শিক্ষক জাতি বিনির্মাণে কারিগর। সুদিনে শিক্ষক থাকে জাতির গাইড হিসেবে। দুর্দিনেও শিক্ষক সমাজ থাকে জাতির পাশে সঠিক পরামর্শক ও নির্দেশক হিসেবে। সেই শিক্ষক সমাজ আজ বাংলাদেশে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে চরমভাবে অবহেলিত।অথচ একটি জাতি সমুন্নত ও শির উচুঁ করে দাঁড়িয়ে রাখার অবদান শিক্ষক সমাজের।
চাণক্য শ্লোকে আছে, ‘এক অক্ষরদাতা গুরুকেও গুরু বলিয়া মান্য করিবে। এক অক্ষরদাতা গুরুকে যে গুরু বলিয়া মান্য করে না, সে শতবার কুকুরের যোনীতে জন্মগ্রহণ করে চণ্ডালত্ব লাভ করিবে।
পিতা জন্ম দেন শারিরীক ভাবে। আর শিক্ষাগুরু জন্মদেন সার্বিক ভাবে। পিতা মাতার পর শিক্ষকের আসন। সমাজ পরিবর্তনে তিন শ্রেণীর ভূমিকা মুখ্য।ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবুল কালামের সেই অমৃত বচন -" যদি একটা দেশকে সম্পূণর্রূপে দুর্নীতিমুক্ত ও একটা জাতিকে সুন্দর মনের অধিকারী করতে হয়, তাহলে আমি বিশ্বাস করি, তিনজন ব্যক্তি এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারেন- বাবা, মা ও শিক্ষক।"
বিশ্বের দিকে তাকালে দেখতে পাই যে জাতি যত শিক্ষিত সে জাতি তত উন্নত। তার প্রমাণ বর্তমান  বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রেসমূহ।ইউরোপ,  দক্ষিণ আমেরিকায় শিক্ষকদের সম্মান দেওয়ার বিষয়  খুব বেশি গুরুত্ব পায়না যতটা পায় এশিয়ায়। বিশেষ করে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান বা মালয়েশিয়ায় শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা অনেক ওপরে। আন্তর্জাতিকভাবে যেসব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা হয়, সেখানে এই দেশের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে ভালো করছে। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে, শিক্ষকের মর্যাদা এবং ভালো শিক্ষক পাওয়া এবং ধরে রাখাও সহজ হয় এসব দেশে। শিক্ষকরা সবেচেয়ে বেশি মর্যাদা পান এমন শীর্ষ ১০টি দেশে :১ চীন ২. মালয়েশিয়া ৩. তাইওয়ান ৪. রাশিয়া ৫. ইন্দোনেশিয়া ৫. দক্ষিণ কোরিয়া ৭. তুরস্ক. ৮. ভারত. ৯. নিউজিল্যান্ড ১০. সিঙ্গাপুর

অতীব কষ্টের  এদেশের শিক্ষকদের প্রায় দাবি আদায়ে রাজপথে নামতে হয় কিন্তু পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে শিক্ষকদের দাবি আদায়ের এরকম ঘটনা বিরল।শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য ইতিবাচক হলেও শিক্ষার গুণগত মান অর্জনে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে রয়েছে এবং পরিতাপের বিষয় হলো শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে তেমন কোনো বলিষ্ঠ পদক্ষেপ অদ্যবধি নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশের শিক্ষা বাজেটের গতি প্রকৃতি লক্ষ্য করলেই তা সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে। বিগত সাত বছরের শিক্ষা বাজেটে গড় বরাদ্দ ছিল মোট বাজেটের ১৩.৭%, যা ২০১০ সালে ছিল সর্বোচ্চ (১৬.৩%)। অন্যদিকে গত দুই দশকে জিডিপি’র মাত্র ২% শিক্ষা খাতে ব্যয় হয়েছে। অথচ ইউনেস্কো’র পরামর্শ অনুযায়ী শিক্ষা বাজেটে বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের নূন্যতম ২০ শতাংশ হওয়া ব্যঞ্চনীয় এবং শিক্ষা খাতে ব্যয় মোট জিডিপি’র নূন্যতম ৬ শতাংশ হওয়া উচিত। কিন্তু তা করা হচ্ছে না।
এদিকে শিক্ষকের ক্ষমতা ও আর্থিক স্বচছলতা না থাকায় তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন।প্রায় শিক্ষকদের শারীরিক মানসিকভাবেও হেনস্তা করার প্রবণতা এদেশে  পরিলক্ষিত হয়।  সাম্প্রতিক সময়ে পাবনায় কলেজ শিক্ষকের উপর প্রকাশ্যে দিবালোকে যেভাবে একজন  শিক্ষককে ফ্লাইং কিক দেওয়া হয় তা রীতিমতো সভ্যতা ও ভদ্রতা বিবর্জিত চরম গর্হিত কাজ। চরম শত্রুকেও কেউ এভাবে নাজেহাল করার দুঃসাহস দেখাতে পারে না। সেই দুঃসাহস আমরা দেখিয়েছি একজন শিক্ষককে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। অবশ্য যারা এ ন্যাক্কারজন ঘটনা ঘটিয়েছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে। এখন দেখার বিষয় এসব দুস্কৃতকারীর উপযুক্ত শাস্তি হয় কি না। না আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসে। যদিও এদেশের সিংহভাগ মানুষ বর্তমানে দেশের আইন আদালতের প্রতি আস্থাহীন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হওয়া ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি মানুষকে এ ধারণা পোষণে বাধ্য করছে।
ব্রিটেন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ইকোনোমিক এবং সোশ্যাল রিসার্চ ৩৫টি দেশে ৩৫,০০০ মানুষের ওপর এক গবেষণা চালিয়ে যে "শিক্ষক মর্যাদা সূচক" প্রকাশ করেছে, চীন, মালয়েশিয়া ও তাইওয়ান সবচেয়ে এগিয়ে।
ভার্কি ফাউন্ডেশন নামে যে দাতব্য প্রতিষ্ঠানটি এই গবেষণায় পয়সা জুগিয়েছে, সেটির প্রতিষ্ঠাতা সানি ভার্কি বলেন, "এই গবেষণায় একটি প্রচলিত বিশ্বাস প্রমাণিত হলো যে যেসব সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা বেশি, সেখানে শিক্ষার্থীরা ভালো শিক্ষা পায়।"
সব যুগে সব সব সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা অতি উচ্চ। যারা জাতি হিসাবে বড় হয়েছে তারাই  শিক্ষকদের উচ্চ আসনে রেখেই বড় হয়েছে।
যারা রাখেনি তারা পিছিয়ে পড়েছে। বাহ্যিক উন্নয়নে আত্মিক উন্নয়নে সকল ক্ষেত্রেই।
আমাদের শিক্ষকদের মান ভাবতেও কষ্ট হয়। কি প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে বেতন যত সামান্য বাড়লেও সার্বিক জীবন যাপন ব্যয় বিবেচনায় তা অপর্যাপ্তও বটে!শিক্ষক সমাজের যাবতীয় সমস্যা দূরীকরণ পূর্বক, শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বাজেটে বরাদ্দ ও তা যথাযথ ব্যয় নিশ্চিত করা সময়ের দাবী। সেই সঙ্গে শিক্ষা ব্যবস্থার অাধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী করে সিলেবাস প্রণয়ন ও নৈতিকতা ও ধর্মীয় শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিয়ে পাঠ দান করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে শিক্ষক সমাজকে সাথে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সুফফা ইসলামের প্রথম আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

মো.আবু রায়হান:  সুফফা মসজিদে নববির একটি স্থান। যেখানে একদল নিঃস্ব মুহাজির যারা মদিনায় হিজরত করেন এবং বাসস্থানের অভাবে মসজিদে নববির সেই স্থানে থাকতেন।এটি প্রথমদিকে মসজিদ উত্তর-পূর্ব কোণায় ছিল এবং রাসুলের আদেশে এটাকে পাতার ছাউনি দিয়ে ছেয়ে দেয়া হয় তখন থেকে এটি পরিচিতি পায় আল-সুফফা বা আল-জুল্লাহ নামে। ( A Suffah is a room that is covered with palm branches from date trees, which was established next to Al-Masjid al-Nabawi by Islamic prophet Muhammad during the Medina period.)। মোটকথা রাসুল (সা) মসজিদে-নববির চত্ত্বরের এক পাশে আস সুফফা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুফফা হলো ছাদবিশিষ্ট প্রশস্ত স্থান। সুফফার আকৃতি ছিল অনেকটা মঞ্চের মতো, মূল ভূমির উচ্চতা ছিল প্রায় অর্ধমিটার। প্রাথমিক পর্যায়ে এর দৈর্ঘ্য ছিল ১২ মিটার এবং প্রস্থ ছিল ৮ মিটার। মসজিদে নববির উত্তর-পূর্বাংশে নির্মিত সুফফার দক্ষিণ দিকে ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের অবস্থানের হুজরা এবং সংলগ্ন পশ্চিম পাশে ছিল মেহরাব।আসহাবে সুফফা অৰ্থ চত্বরবাসী। ঐ সকল মহৎ প্ৰাণ সাহাবি আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত, যারা জ্ঞানার্জনের জন্য ভোগবিলাস ত্যা...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

কাবা ঘর নির্মাণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

মো. আবু রায়হানঃ কাবা মুসলমানদের কিবলা, অর্থাৎ যে দিকে মুখ করে নামাজ পড়ে বা সালাত আদায় করে, পৃথিবীর যে স্থান থেকে কাবা যে দিকে মুসলমানগণ ঠিক সে দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করেন। হজ্জ এবং উমরা পালনের সময় মুসলমানগণ কাবাকে ঘিরে তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করেন।কাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ মুকাআব অর্থ ঘন থেকে।কাবা একটি বড় ঘন আকৃতির ইমারত। (The Kaaba, meaning cube in Arabic, is a square building elegantly draped in a silk and cotton veil.)।যা সৌদি আরবের মক্কা শহরের মসজিদুল হারাম মসজিদের মধ্যখানে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে মসজিদটি কাবাকে ঘিরেই তৈরি করা হয়েছে।কাবার ভৌগোলিক অবস্থান ২১.৪২২৪৯৩৫° উত্তর ৩৯.৮২৬২০১৩° পূর্ব।পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর বায়তুল্লাহ বা পবিত্র কাবা ঘর ।আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য নির্মিত হয়েছে তা মক্কা নগরীতে। (সুরা আল ইমরান - ৯৬)। “প্রথম মাসজিদ বায়তুল্লাহিল হারাম তারপর বাইতুল মাকদিস, আর এ দুয়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান হলো চল্লিশ বছরের”।(মুসলিম- ৫২০)। ভৌগোলিকভাবেই গোলাকার পৃথিবীর মধ্যস্থলে কাবার অবস্থান। ইসলামের রাজধানী হিসেবে কাবা একটি সুপরিচিত নাম। পৃথিবীতে মাটির সৃষ্টি ...