যুগে যুগে ইহুদিদের বিশ্বাসঘাতকতা

 

 





পৃথিবীতে ইহুদিদের মোট সংখ্যা দেড় কোটির মতো । এদের বেশীরভাগ বাস করে ইসরায়েলে। পৃথিবী একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল। ইসরায়েলে ইহুদির প্রায় সংখ্যা ৫৪ লাখ অবশিষ্ট প্রায় এক কোটি ইহুদি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে। এর মধ্যে আমেরিকায় ৭০ লাখ, কানাডায় চার লাখ আর ব্রিটেনে তিন লাখ ইহুদি থাকে। ইহুদিরা মার্কিন জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ, আর পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.২ শতাংশ। অর্থাৎ পৃথিবীর প্রতি ৫০০ জনে একজন ইহুদি !  পৃথিবীতে ইহুদি এবং মুসলিমদের অনুপাত ১  ১০০অর্থাৎ একজন ইহুদির বিপরীতে এক শজন মুসলিম। এর পরও মুসলিমদের চেয়ে কয়েক শগুণ ক্ষমতাবান ইহুদিরা। এর কারণ হিসেবে বলা যায় সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সব দিক দিয়েই ইহুদিরা এগিয়ে। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তাদের ওপর আরোপ করা হলো লাঞ্ছনা ও পরমুখাপেক্ষিতা। ’ (সুরা বাকারা : ৬১) এ আয়াতের তাফসিরে তাফসিরকারগণ বলেন, ‘তারা যত ধন-সম্পদের অধিকারীই হোক না কেন, বিশ্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে তুচ্ছ ও নগণ্য বলে বিবেচিত হবে। যার সংস্পর্শ্বে আসবে সেই তাদের অপমানিত করবে এবং দাসত্বের শৃঙ্খলে জড়িয়ে রাখবে। ’ (তাফসিরে ইবনে কাসির, ১/২৮২)

 

বিশ্বের বুকে জাতি হিসেবে ইহুদিদের চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ,গাদ্দারি ও অপকর্মের ইতিহাস সর্বজনবিদিত। কোরআনে কারিমে তাদের অভিশপ্ত ও লাঞ্ছিত জাতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।সুদখোর ও ধনলিপ্সু জাতি হিসেবেও তাদের একটা পরিচয় রয়েছে। এ জাতি যুগ যুগ ধরে খোদাদ্রোহিতা, কুফরি ও তাদের খারাপ কর্মকাণ্ডের জন্য মানুষের কাছে অত্যন্ত ঘৃণাভরে পরিচিতি পেয়ে এসেছে। জন্মগতভাবেই এই জাতি খুবই চতুর ও ধুরন্ধর হওয়ায় বিভিন্ন ছলচাতুরী দিয়ে মানুষকে বশীভূত রাখার কৌশল অবলম্বন করে। এর মাধ্যমে তারা অন্যের ওপর দিয়ে যুগে যুগে তাদের নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।

এত সব অপকর্ম ও কুকীর্তি ইহুদিদের পরিণত করেছে আল্লাহর অভিশপ্ত জাতিতে। আল্লাহ তাআলা এ জন্য যুগে যুগে তাদের ওপর নাজিল করেছেন তাঁর আজাব। আর তারা বারবার আল্লাহর গজবের শিকার হয়ে লাঞ্ছিত হতে থাকে।কোরআনের ভাষায় আর তাদের ওপর আরোপ করা হলো লাঞ্ছনা ও পরমুখাপেক্ষিতা।’ (সুরা বাকারা আয়াত - ৬১)এ আয়াতের তাফসিরে তাফসিরকারগণ বলেন, ‘তারা যত ধন-সম্পদের অধিকারীই হোক না কেন, বিশ্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে তুচ্ছ ও নগণ্য বলে বিবেচিত হবে। যার সংস্পর্শ্বে আসবে সেই তাদের অপমানিত করবে এবং দাসত্বের শৃঙ্খলে জড়িয়ে রাখবে।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির, ১/২৮২)

এভাবে ক্রমাগত গজব ও লাঞ্ছনার শিকার হয়ে এরা বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিতে থাকে এবং পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু পৃথিবীর কোথাও এদের ঠাঁই হয়নি। পরিণামে তাদের শুধু শোচনীয় অবস্থার সম্মুখীনই হতে হয়েছে। পৃথিবীর কোথাও তারা কোনো দিনও স্থায়ীভাবে বাস করতে পারেনি। মধ্যপ্রাচ্য তো বটেই, শুধু ইউরোপেই তারা ৪৭ বার বহিষ্কৃত হয়েছে! সময়ের পরিক্রমায় তারা সারা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।

ইহুদি জাতির সঙ্কটকাল শুরু হয় ৫৮৭ খ্রিষ্টপূর্বে। এই বছর থেকেই শুরু হয় শক্তিশালী সাম্রাজ্যগুলোর শাসনামল। ইহুদিদের আদি বাসস্থান ভূমধ্যসাগরীয় এলাকাগুলো পর্যায়ক্রমে শাসন করে ব্যাবিলনীয়, পারসিক, আলেক্সান্ডার, টলেমি বংশ, মেক্কাবি, রোমান, বিজন্টিক সাম্রাজ্য, আরব মুসলমান, তুর্কি মুসলমান এবং ব্রিটিশরা।

দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে ইহুদিরা বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়। তবে কোনো দেশেই তারা স্থানীয় জনসাধারণের সাথে মিশে যায়নি। নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার প্রবণতা এবং সাধারণ খ্রিষ্টান কর্তৃক ইহুদিদের যিশুর হত্যাকারীরূপে চিহ্নিত করার ফলেই ইহুদিরা খ্রিষ্টানদের সাথে একত্রে সমাজ গড়ে তুলতে পারেনি। ভালো ব্যবসায়ী বলে এবং সুদব্যবসায়ের মাধ্যমে প্রায় প্রতিটি দেশেই ইহুদিরা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিজেদের প্রাধান্য বিস্তার করতে সমর্থ হয়। এটিও খ্রিষ্টানদের রোষের একটি কারণ ছিল।

ইহুদিরা এমন এক গাদ্দার জাতি, যাদের বিশ্বাসঘাতকতা, চুক্তি ভঙ্গ এবং রসূলুল্লাহ (সা:) কে হত্যার ব্যর্থ ষড়যন্ত্র ইত্যাদি দুষ্কর্মের বিবরণ সমস্ত সীরাত গ্রন্থে বিশদ ভাবে বর্ণিত হয়েছে। খোদ কোরআনুল কারীমের সূরা হাশরে বনি নজির এবং সূরা আহজাবে বনি কোরাযার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। রসূলুল্লাহ (সা:) ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র চক্রান্তের পরিণতিতে রসূলুল্লাহ (সা:)-এর যুগেই তারা মদিনা হতে সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত হয়ে যায়। যদিও ছিটেফোঁটা কিছু ইহুদি বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন স্থানে বসবাস করছিল, তাদের ব্যাপারে হাদিসে স্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে; ‘আখরিজুল ইহুদা মিন জাযিরাতিল আরবর্থাৎ জাযিরাতুল আরব হতে ইহুদিদের বিতাড়িত করো

১৯২০ সালে ইংল্যান্ড থেকে এদের বিতাড়িত করা হয়। ফ্রান্স একবার ১৩০৬ সালে, দ্বিতীয়বার ১৩৯৪ সালে, ১৩৭০ সালে বেলজিয়াম, ১৩৮০ সালে চেকোশ্লোভাকিয়া, ১৪৪৪ সালে হল্যান্ড, ১৫৪০ সালে ইতালি, ১৫৫১ সালে জার্মানি এবং ১৫১০ সালে রাশিয়া ইহুদিদের তাদের নিজ নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত করে। তার মধ্যে নির্মমভাবে বিতাড়িত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। জার্মানির হিটলার এদের পাইকারিভাবে হত্যা করে বাকিগুলোকে বিদায় করে দেন। হিটলারের নেতৃত্বে প্রায় ষাট লক্ষ ইহুদীকে হত্যা করে নাৎসী বাহিনী। ১৯৩৯ সালের দিকে সেখানে ছিল ৭০ লাখ ইহুদির বাস। সেখানে হত্যা করা হয় ৬০ লাখ ইহুদিকে। অধিকৃত পেল্যান্ডে হত্যা করা হয়েছিল ৩০ লাখ ও সোভিয়েত ইউনিয়নে ১০ লাখ ইহুদিকে। নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, বেলজিয়াাম, যুগোস্লাভিয়া ও গ্রিসে হত্যা করা হয় আরো হাজার হাজার ইহুদি। হিটলার বলেছিল, 'আমি চাইলে সব ইহুদীদের হত্যা করতে পারতাম। কিন্তু কিছু ইহুদী বাচিয়ে রেখেছি,,এই জন্যে যে, যাতে পৃথিবীর মানুষ বুঝতে পারে, আমি কেন ইহুদী হত্যায় মেতেছিলাম।'যেখানেই গেছে, সেখানেই ইহদিরা ঘৃণার পাত্র হয়েছে, কোনো কোনো সময় হয়েছে বিতাড়িত। হিটলার ইহুদিদের কেন এত বেশি ঘৃণা করতেন তা এখনো জানা যায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এখন পর্যন্ত গবেষকরা অনেক গবেষণা করেছেন কিন্তু কোনো সঠিক তথ্য উপস্থাপন করতে পারেননি। তবে এটা নিশ্চিত যে হিটলার ইহুদিদের বিশ্বাসঘাতক এবং বেইমান জাতি হিসাবে জানতেন।

ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৬১৬ সালে world zionist organaisation ব্রিটেনের পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গে আলোচনায় লিপ্ত হয় এবং এর ফলে ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার কুখ্যাত ব্যালফরঘোষণায় ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জাতীয় আবাসভূমি স্থাপনের দাবি সমর্থন করে। এই কুখ্যাত বেলফোরঘোষণায় ফিলিস্তিনে ১৯১৮ সালে ইহুদির সংখ্যা যেখানে ছিল মাত্র কয়েক হাজার, সেখানে ১৯৪১ সালে তা গিয়ে দাঁড়ায় দুই লাখ ৫০ হাজারে।

কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ অ্যামেরিকায় ওই ইহুদিদের বসবাসের ব্যবস্থা সম্ভব থাকলেও ব্রিটেনের কারণে ছয় লাখ ইহুদিকে আরবের প্রতিবাদ সত্ত্বেও ফিলিস্তিনে এনে বসানো হয়। এভাবে ফিলিস্তিন বিভক্ত হয়ে গেল। শুরু হলো অত্যাচারের স্টিমরোলার। ১০০ দিনের মধ্যে ১৭ হাজার মুসলিম নিহত। ২০ এপ্রিল ১৯৪৮ প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদে স্থগিত করা হয় সাময়িকভাবে। ১৪ মে ইহুদি নেতা বেন গুরিয়ান স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র ঘোষণা দেয় কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই। এর এক মিনিট পর আমেরিকা দেয় তাদের স্বীকৃতি।

ইসরায়েল রাষ্ট্রও তাদের লাঞ্ছনার একটি অংশ। যদিও বাহ্যিকভাবে তাদেরকে শক্তিধর ও সম্পদশালী ও সম্মানী মনে হয়, বাস্তব কথা হলো, এ রাষ্ট্র ইসরায়েলের নয়; বরং আমেরিকা ও ব্রিটেনের একটি ঘাঁটি ছাড়া আর কিছুই নয়।অনেকে ইসরায়েলকে আমেরিকার ৫১ তম স্টেট বলে থাকেন। এ রাষ্ট্র নিজস্ব শক্তির ওপর নির্ভর করে এক মাসও টিকতে পারবে কি না সন্দেহ। পাশ্চাত্যের খ্রিস্টান শক্তি ইসলামী বিশ্বকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে তাদের মাঝখানে ইসরায়েল নাম দিয়ে একটি সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করেছে। এ রাষ্ট্র আমেরিকা ও ইউরোপীয়দের দৃষ্টিতে একটি অগণিত আজ্ঞাবহ ষড়যন্ত্রকেন্দ্র ছাড়া অন্য কোনো গুরুত্ব বহন করে না। পাশ্চাত্য শক্তিবলয় বিশেষ করে আমেরিকার সঙ্গে নানা ধরনের প্রকাশ্য ও গোপন চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে তাদের মদদপুষ্ট ও আশ্রিত হয়ে নিছক ক্রীড়নকরূপে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। তা-ও অত্যন্ত লাঞ্ছনা ও অবমাননার ভেতর দিয়ে।

 

 

ইহুদিরা অভিশপ্ত হওয়ার কারণ

এক. ইহুদিরা যুগে যুগে সব নবী-রাসূলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে এবং হত্যাচেষ্টা করে। আল্লাহর নবী-রাসূলদেরকে ইহুদি জাতি ছাড়া অন্য কোনো জাতি হত্যা করেনি। তারা হজরত জাকারিয়া ও তদীয়পুত্র হজরত ইয়াহিয়া আ:কে হত্যা করেছে এবং হজরত ইলিয়াস আ:কে হত্যার চেষ্টা করে। ইহুদিরা হজরত মরিয়ম আ:কে ব্যভিচারের অভিযোগ দিয়েছে এবং হজরত ঈসা আ:কে হত্যা করার জন্য তায়তালানুসনামক এক পাপিষ্ঠকে পাঠিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে আসমানে উঠিয়ে নেন (মাজহারি  হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত হাদিসে রয়েছে  ইহুদিরা ৩০০ জন নবীকে হত্যা করেছে (ইবনে কাসির প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১০৯)

দুই. ইহুদিরা মহানবী সা:কে নানাভাবে কষ্ট দিয়েছে। মহানবী সা:-এর সময় মদিনায় বহু ইহুদি গোত্র ছিল। যেমন বনু নাজির, বনু কাইনুকা, বনি আউফ, খুজা, আউজ, খাজরাজ ইত্যাদি। তিনবার তারা মহানবী সা:কে হত্যার চেষ্টা করে। আল্লাহ আরো ইরশাদ করেন যখনই তাদের কাছে কোনো পয়গম্বর এমন নির্দেশ নিয়ে আসতেন যা তাদের মনে চাইত না, তখন তাদের অনেকের প্রতি তারা মিথ্যা আরোপ করত এবং অনেককে হত্যা করে ফেলত।  (আল মায়েদা-সূরা -৭১( 

তিন.আসমানি কিতাব বিকৃতি : ইহুদিরা তাদের কাছে প্রেরিত আসমানি কিতাবকে বিকৃত করেছে। আল্লাহর কালামে নিজেদের মনগড়াভাবে পরিবর্তন সাধন করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেনতারা কালামকে তার স্থান থেকে বিচ্যুত করে দেয়’।  (আল মায়েদা-সূরা -১৩( 

  চার. আল্লাহ তায়ালা ইহুদিদের অসংখ্য নিয়ামত দান করেছেন। যেমন সমগ্র বিশ্বের কর্তৃত্ব নেতৃত্ব দান। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেনহে বনি ইসরাইল! তোমাদের প্রতি প্রদত্ত আমার নিয়ামতের কথা স্মরণ করো। আর আমি তোমাদেরকে সমস্ত জগতের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি’। (সুরা বাকারা-৪৭) আল্লাহ ফিরাউনের জুলুম থেকে তাদেরকে রক্ষা করেছেন। আসমানি কিতাব দিয়েছেন। সিনাই বা তিহ ময়দানে প্রচণ্ড উত্তাপ থেকে বাঁচার জন্য ছায়া দান করেছেন। মান্না ও সালওয়া নামক আসমানি খাদ্য দান করেছেন। পাথর থেকে ঝর্ণার সৃষ্টি করেছেন। ফিরাউনের কবল থেকে বাঁচার জন্য লোহিত সাগরে ১২টি রাস্তা করে দিয়েছেন ইত্যাদি। কিন্তু তারা এসব নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করেনি।

পাঁচ.  ইহুদিরা তাওরাত ছাড়া অন্যান্য আসমানি গ্রন্থকে অস্বীকার করে এবং হজরত ইয়াহিয়া, জাকারিয়া, ঈসা আ:, হজরত মুহাম্মদ সা: প্রমুখের মুজিজাকে অস্বীকার করে। অথচ ঈমানের দাবি হলো সমস্ত আসমানি কিতাব ও -রাসূলকে বিশ্বাস করা এবং তাদের মুজিজাকে স্বীকার করা

 ইহুদিরা পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও অভিশপ্ত জাতি। আল্লাহর ঘোষণা অনুযায়ী তারা দুই অবস্থা ছাড়া সর্বত্র ও সদা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবে

 . আল্লাহ প্রদত্ত  ও অনুমোদিত আশ্রয়ের মাধ্যমে ও 

. শান্তিচুক্তির মাধ্যমে

 এ দুই পন্থায় তারা নিজেদেরকে এ অবমা ও লাঞ্ছনা থেকে মুক্ত রাখতে পারবে।

 

 

                                                    ইহুদিদের পরিচয়

ইহুদীদের ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের পুরনো। ইসলাম ধর্ম মতে তারা বনি ইসরাঈলের উত্তরসূরী। হযরত মূসা (আ)-এর অনুসারী। এমনকি বিপথগামী এই জাতির বৃত্তান্ত বর্ণনা করতে গিয়ে পবিত্র কুরআনে বনি ইসরাঈল নামে একটি সূরাই নাজিল করা হয়েছে। সংক্ষিপ্ত আলোচনায় ইহুদিদের সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করা সম্ভব নয়। সারা পৃথিবী থেকে বিতাড়িত হয়ে যাযাবর ন্যায় ঘুরতে থাকা এক জাতি বর্তমানে গোটা দুনিয়া নিয়ন্ত্রণ করছেসমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি, এবং বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রে রয়েছে ইহুদিরা। ১৯১৭ সালে  ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফোর এক ঘোষণার মধ্য দিয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিনে দখলদারি এক রাষ্ট্র তৈরি করেছে তারা। ১৯৪৮ সাল থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত তাদের দখলদারিতে নিষ্পেষিত হয়েছে লক্ষ লক্ষ আরব মুসলিম। ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে শত শত মসজিদ। এমনকি পবিত্র শহর জেরুজালেমও আজ তাদের দখলে। 

 

হযরত মুসা (আ.) এর জাতি বা কাওমের নাম ছিল বনী-ইসরাঈল। ইসরাঈল একটি হিব্রু শব্দ।  যার অর্থ–আল্লাহর বান্দা। হযরত ইয়াকুব (আ.)এর আরেকটি নাম হলো ইসরাঈল। কুরআনে ইহুদিদেরকে ইয়াকুব (আ.) এর বংশধর’ না বলে ইসরাঈলের বংশধর বলা হয়েছে, যেন ইহুদিরা এটা ভুলে না যায় যে, তারা আল্লাহর বান্দার বংশধর। তাদেরকে মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে  তারা যেন তাদের রাবাইদের উপাসনা না করে, শুধুমাত্র আল্লাহরই উপাসনা করে।আরেকটি ব্যাপার হলো বনী ইসরাঈল বলতে আজকের  ‘ইসরাঈল’ নামক দেশে যারা থাকে, তাদেরকে বুঝায় না। হিব্রু শব্দটি মূলত খাবিরু (khabiru) বা হাবিরু (habiru) থেকে এসেছে। যার অর্থ নিম্ন বংশীয় যাযাবর বা বিদেশি। অন্যমতে হিব্রু শব্দটি ইবার (eber) বা ইভার (ever) থেকে এসেছে। এগুলোর অর্থ মোটামুটি বিদেশি যাযাবর এর কাছাকাছি। (বিশ্বসভ্যতা, ড. এ কে এম শাহনেওয়াজ, পৃষ্ঠা-১৫৪) হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর এক পুত্রের নাম ছিল ইয়াহুদা। সেই নামের অংশবিশেষ থেকে ইহুদিনামকরণ করা হয়েছিল। (তাফসিরে মাওয়ারদি : ১/১৩১) ইয়াকুব (আ) এর ১২ জন সন্তান ছিল যাদের একজন ছিলেন ইউসুফ (আ.)। তিনিও একজন নবী ছিলেন এবং পরবর্তীতে মিশরে বন্দিদশা থেকে প্রথমে মন্ত্রী এবং পরে বাদশা হন। ইয়াকুব (আ) এর বড় ছেলের নাম ছিল ইয়াহুদাইয়াহুদা সিরিয়া ফিলিস্তিন অঞ্চলে বসবাস করতে থাকে। এই ইয়াহুদা এর বংশধর পরবর্তীতে ইহুদি জাতি হিসেবে নিজেদেরকে পরিচিত করে। (তাফসির ইবনে কাসীর সুরা বাকারা ৬২ নং আয়াতের ব্যাখ্যা) মূলত শব্দটি ছিল ইয়াহুজা। জালকে দাল দিয়ে পরিবর্তন করে আরবি করা হয়েছে। ইয়াহুদা শব্দের অর্থ তাওবাকারী। গো বৎসপূজা থেকে তাওবা করার কারণে তার নাম হয়েছে ইয়াহুজা। অর্থাৎ তাওবাকারী। (কুরতুবি প্রথম খণ্ড পৃষ্ঠা-৩৩৮)

ইয়াহুদা নামক রাষ্ট্রের নামানুসারে বনি ইসরাইল ইহুদি নামে পরিচিত হয়। ইয়াহুদ শব্দ বলে ইহুদি জাতিকে বোঝানো হয়ে থাকে। পবিত্র কোরআনে ৯ বার এই ইহুদি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এ জাতির হেদায়েতের জন্য আল্লাহ হযরত মুসা (আ.)-কে তাওরাত দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। বনি ইসরাইল পরবর্তীতে ইহুদি জাতি নামে পরিচিত হয়। ইহুদি নাম মুসা (আ.)-এর মৃত্যুর অনেক পরে হয়েছিল। ইহুদিরা হজরত মূসা আ:কে নবী মানলেও তাঁর কোনো আদর্শ তাদের মধ্যে নেই। এমনটি তারা তাওরাত কিতাবকে বিকৃত করেছে এবং হজরত উজাইর আ: কে আল্লাহর পুত্র বলে মনে করে। সুতরাং এটি কোনোভাবেই বলা যাবে না যে, ইহুদি ধর্ম হযরত মুসা বা ইবরাহীম  (আ.) প্রবর্তিত। কারণ তারা দুজনসহ সকল নবীই ইসলামের অনুসারী ছিলেন। ইবরাহীম (আ.) সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ইবরাহীম ইহুদিও ছিলেন না, নাসারাও ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলিম। আর তিনি মুশরিকদেরও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। (সূরা আল ইমরান : ৬৭)। তেমনিভাবে হযরত মুসা (আ.) সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, মুসা বলল, হে আমার কওম, তোমরা যদি আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে থাক তাহলে তারই ওপর তাওয়াক্কুল কর, যদি তোমরা মুসলিম হয়ে থাকে(সূরা ইউনুস : ৮৪)।

মুসলমানদের সবচাইতে বড় দুশমন হচ্ছে ইহুদি সম্প্রদায়। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, তুমি মুমিনদের বিরুদ্ধে ইহুদি ও মুশরিকদের কঠোরতম দুশমন হিসাবে দেখতে পাবে। (সূরা মায়েদা : ৬৪)।কোরআন মাজিদের বিভিন্ন সূরা ও আয়াতে বনি ইসরাইল তথা ইহুদিদের সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বহু আয়াত নাযিল হয়েছে। কোরআনের মোট ১১৪টি সূরার মধ্যে ৫০টিতেই ইহুদিদের সম্পর্কে সরাসরি এবং পরোক্ষ ইশারা-ইঙ্গিতে আলোচনা করা হয়েছে। তাদের সম্পর্কে এত বেশি আলোচনার উদ্দেশ্য হলো, মুসলমানগণ তাদের ব্যাপারে যেন যথেষ্ট সতর্ক থাকে। নবী-রাসুলদের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে। হজরত আবু যর গিফারি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদা আরজ করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! নবী-রাসুলদের সংখ্যা কত? তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, নবী হলেন, এক লাখ চব্বিশ হাজার, আর রাসুল হলেন ৩১৩ জন। ’ (কুরতুবি, ষষ্ঠ খণ্ড, ১৫ পৃষ্ঠা)  হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আমি আট হাজার নবীর নিদর্শনের ওপর প্রেরিত হয়েছি, তন্মধ্যে চার হাজার হলো বনি ইসরাঈল গোত্র থেকে এসেছেন।

মুসা (আ.)

আমি মুসাকে কিতাব দিয়েছিলাম ও তাকে করেছিলাম বনি ইসরাইলের জন্য পথনির্দেশক। আমি আদেশ করেছিলাম, তোমরা আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে কর্মবিধায়করূপে গ্রহণ কোরো না। (সুরা বনি ইসরাঈল-  ২)

হযরত মুসা (আ.) একজন নবি ও রাসুল।বাইবেলে তিনি মোজেস নামে পরিচিত। তাঁর ওপর আসমানী কিতাব তাওরাত নাযিল হয়েছিল। আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি কথা বলার জন্য তাঁকে কালিমুল্লাহ বলা হয়।তিনি  ইহুদি, খ্রিস্টান এবং ইসলাম ধর্মে স্বীকৃত রাসুল বা আল্লাহর  বার্তাবাহক। কোরআনে মুসা (আ.) এর নাম অন্য নবীদের তুলনায় বেশি উল্লেখ করা হয়েছে। ধারণা করা হয় যে মুসা (আ.) ১২০ বছর বেঁচে ছিলেন। হযরত মুসা (আ.) এর অসংখ্য মুজেজা ছিল। তন্মধ্যে উল্লেখ করার মতো মুজেজা হলো তাঁর হাতের লাঠি মাটিতে নিক্ষেপ করলে  বিশালাকার অজগর সাপে পরিণত হতো।

মুসা (আ.) হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর অষ্টম অধস্তন পুরুষ। মুসা (আ.)-এর বাবার নাম ছিল ইমরান ও মায়ের নাম ইউহানিব। তবে মায়ের নামের ব্যাপারে মতভেদ আছে। হজরত মারিয়াম (আ.)-এর বাবার নামও ছিল ইমরান। তিনি ছিলেন হজরত ঈসা (আ.)-এর নানা। মুসা ও ঈসা (আ.) উভয় নবীই ছিলেন বনি ইসরাইল বংশীয়উভয়েই বনি ইসরাইলের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেনমুসা (আ.)-এর জন্ম হয় মিসরে। তিনি লালিত-পালিত হয়েছেন মিসর সম্রাট ফেরাউনের ঘরে। তাঁর সহোদর ভাই হারুন (আ.) ছিলেন তাঁর চেয়ে তিন বছরের বড়। তিনি মুসা (আ.)-এর তিন বছর আগেই ইন্তেকাল করেন। উভয়ের মৃত্যু হয় মিসর ও সিরিয়ার মধ্যবর্তী তিহপ্রান্তরে।

কোনো কোনো তাফসিরবিদের মতে, মুসা (আ.) ৫০ বছর বয়সে নবী হয়েছেন। এরপর ফেরাউনের দরবারে পৌঁছেছেন। ২৩ বছর দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের পর ফেরাউন ডুবে মরে। আর বনি ইসরাইল মিসর থেকে বেরিয়ে যায়। এ সময় মুসা (আ.)-এর বয়স ছিল সম্ভবত ৮০ বছর। তবে মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ.)-এর মতে, জাদুকরদের সঙ্গে মোকাবিলার ঘটনার পর মুসা (আ.) ২০ বছর মিসরে অবস্থান করেন। এ সময় আল্লাহ তাআলা মুসা (আ.)-কে  ৯টি মোজেজা দান করেন।

হজরত আদম, ইয়াহ্ইয়া ও ঈসা (আ.) ছাড়া প্রায় সব নবীই ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ করেছিলেন। মুসা (আ.)ও ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ করেছিলেন বলে বেশির ভাগ ইতিহাসবিদ মত পোষণ করেছেন। সে হিসাবে মুসা (আ.)-এর বয়সের ধারাক্রম নিম্নরূপপ্রথম ৩০ বছর মিসরে, এরপর ১০ বছর মাদিয়ানেতারপর মিসরে ফেরার পথে তুর পাহাড়ের কাছে তুবাউপত্যকায় ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ। এরপর ২০ বছর মিসরে অবস্থান করে সেখানকার অধিবাসীদের তাওহিদের দাওয়াত প্রদান। তারপর ৬০ বছর বয়সে বনি ইসরাইলদের নিয়ে মিসর থেকে প্রস্থান ও ফেরাউনের সলিল সমাধি। অতঃপর বনি ইসরাইলকে নিয়ে ৪০ বছর ধরে তিহপ্রান্তরে উন্মুক্ত কারাগারে অবস্থান। সে হিসাবে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ থেকে ১০০ বছর। মুসা (আ.)-এর মৃত্যু হয় বায়তুল মুকাদ্দাসের সন্নিকটে। বায়তুল মুকাদ্দাসের উপকণ্ঠে তাঁকে কবরস্থ করা হয়।

 

তাওরাত

তাওরাতশব্দটি হিব্রু ভাষায় শিক্ষা দেওয়া, দিকনির্দেশনা প্রদান বা নীতি প্রণয়ন করার অর্থে ব্যবহৃত হয়। ইহুদি গোষ্ঠীর জীবনবিধান হিসেবে তা মুসা (আ.)-এর ওপর অবতীর্ণ হয়েছে। খ্রিস্টানদের ভাষ্য অনুযায়ী, এ গ্রন্থটি আল কিতাবুল মুকাদ্দাসবা বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট’ (Old testament বা আল আহদুল কদিম)-এর অন্তর্ভুক্ত। ৩৮টিরও বেশি অধ্যায়ে প্রণীত কিতাবুল মুকাদ্দাসসর্বমোট তিন ভাগে বিভক্ত।

এক. সফরের পাঁচটি অধ্যায়। গবেষক ও ইহুদিদের অনেক গোষ্ঠীর কাছে এটি তাওরাত হিসেবে সমাদৃত। তাওরাত মূলত পাঁচটি সফরবা গ্রন্থের সমন্বিত রূপ। দুই. সফরুল আনবিয়ার ২০টি অধ্যায়। তিন. মাকতুবাতের ১৩টি অধ্যায়। বাইবেলের এ অধ্যায়গুলো একসঙ্গে তানাক’ (tanakh) নামেও পরিচিত। আর ইহুদিদের একটি গোষ্ঠী ফিররিসরা তাদের বিভিন্ন বিধি-বিধান মৌখিকভাবেও সংরক্ষণ করেছিল, যা তালমুদনামে পরিচিত। (আল আকিদাতুল ইসলামিয়্যাহ, আবদুর রহমান হাবানকাহ; আল ইয়াহুদিয়্যাহ, ড. আহমাদ শিবলি)

কোরআনে তাওরাতশব্দটি উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি তাওরাত অবতীর্ণ করেছি, যাতে আছে পথনির্দেশনা ও আলো। আল্লাহর অনুগত নবীরা তদনুসারে ইহুদিদের পরিচালনা করত এবং খোদাভীরু ও জ্ঞানীরাও, কারণ তাদের আল্লাহর কিতাব সংরক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এবং এ ব্যাপারে তারা সাক্ষী ছিল। ’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৪৪) অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘অতঃপর আমি মুসা (আ.)-কে কিতাব দিয়েছিলাম সৎকর্মশীলদের প্রতি পরিপূর্ণ অনুগ্রহ করে, যা সব কিছুর বিশদ বিবরণ, পথনির্দেশ ও দয়াস্বরূপ ছিল, যাতে তারা তাদের প্রতিপালকের সাক্ষাতের ব্যাপারে বিশ্বাস করে। ’ (সুরা : আনয়াম, আয়াত : ১৫৪)

মুসলিম ঐতিহাসিকরা মনে করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আগমনের আগ পর্যন্ত তাওরাত ও ইঞ্জিলে মহানবী (সা.)-এর আগমনের সুসংবাদ ও তাঁর বৈশিষ্ট্যের আলোচনা এবং তাঁর সাহাবিদের বিবরণ ছিল। কেননা সে যুগের একাধিক পাদ্রি তাওরাত ও ইঞ্জিলের বিবরণ অনুসারে নবীজি (সা.)-কে শনাক্ত করেন এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনেন। যেমন আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.), সালমান ফারেসি (রা.) প্রমুখ। কিন্তু মহানবী (সা.)-এর আগমনের পর পাদ্রিরা এই পরম সত্য গোপন করে। তার সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি যাদের কিতাব দিয়েছি তারা তাকে সেরূপ জানে যেরূপ তারা নিজেদের সন্তানদের চেনে এবং তাদের একদল জেনে-শুনে সত্য গোপন করে থাকে। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৪৬)

শ্রেষ্ঠতম তাফসিরবিদ আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, গোটা তাওরাতের বিধানাবলি সুরা বনি ইসরাঈলের ১৫ আয়াতে সন্নিবেশিত করে দেওয়া হয়েছে। মহানবী (সা.) মিরাজ থেকে ফিরে আসার পর সুরা বনি ইসরাঈলের মাধ্যমে ১৫টি দফা মানুষের সামনে পেশ করেন। বর্তমানে ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের সংস্কারকল্পে এই ১৫টি দফা বিশেষ ভূমিকা রাখবে১. আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা যাবে না। ২. মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘...মা-বাবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো। তাঁদের একজন বা উভয়ে বৃদ্ধ অবস্থায় যদি তোমাদের সামনে উপনীত হন, তাহলে তাঁদের সঙ্গে উহ শব্দটি পর্যন্ত কোরো না। ’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ২৩) ৩. মা-বাবার সঙ্গে বিনম্র আচরণ করতে হবে। আর তাঁদের জন্য দোয়া করতে হবে, ‘হে আমার প্রতিপালক, তাঁদের প্রতি তেমনি দয়া করো, যেমনি তাঁরা শৈশবে আমাদের লালন-পালন করেছেন। ৪. নিজ কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে তাওবা করতে হবে। ৫. আত্মীয়স্বজনকে তাদের অধিকার দিয়ে দিতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘আত্মীয়স্বজনকে তাদের অধিকার দাও। আর মুসাফিরদের হক আদায় করো। ’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ২৬) ৬. অপব্যয় করা যাবে না। ৭. মানুষের অধিকার আদায়ে ব্যর্থ হলে বিনয়ের সঙ্গে তা প্রকাশ করতে হবে। ছলচাতুরী ও প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া যাবে না। ৮. ব্যয়ের ক্ষেত্রে বেহিসাবি হওয়া যাবে না। আবার কৃপণতাও প্রদর্শন কোরো না। ৯. সন্তানদের হত্যা করা যাবে না। এটি মহাপাপ। ১০. জেনা-ব্যভিচারের কাছেও যাওয়া যাবে না। কেননা এটি নিকৃষ্ট ও গর্হিত কাজ। ১১. কোনো প্রাণীকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা যাবে না। কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হলে তার উত্তরাধিকারীকে এই অধিকার দেওয়া হয়েছে যে সে চাইলে রক্তের বিনিময় চাইতে পারে। তবে প্রতিশোধের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা যাবে না। ১২. গ্রাস করার উদ্দেশ্যে এতিমের সম্পদের ধারেকাছেও যাওয়া যাবে না১৩. ওজনে কম দিয়ে মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। ১৪. যে বিষয়ে জ্ঞান নেই সে বিষয়ে মতামত দেওয়া অন্যায়। চোখ, কান, অন্তর সব কিছুই একদিন জিজ্ঞাসিত হবে। ১৫. জমিনে দম্ভসহকারে চলা যাবে না। এগুলো সবই মন্দ ও ঘৃণিত কাজ।

তাওরাতের বিকৃতি

তাওরাত আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হলেও তা কালক্রমে কিছু অসাধু ও ধর্মব্যবসায়ীর দ্বারা বিকৃত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে তাওরাতের বিকৃত হওয়ার কথাও বর্ণনা করেছেন। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘তাদের মধ্যে একদল লোক আছে, যারা কিতাবকে জিব দ্বারা বিকৃত করে, যাতে তোমরা তাকে আল্লাহর কিতাবের অংশ মনে করো; কিন্তু তা কিতাবের অংশ নয় এবং তারা বলে, এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে, অথচ তা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত নয়, তারা জেনেশুনে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা বলে। ’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৭৮)

সামান্য অর্থের বিনিময়ে ইহুদিদের তাওরাতের বিধি-বিধান পরিবর্তন সম্পর্কেও পবিত্র কোরআনে বর্ণনা এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতএব তাদের জন্য ধ্বংস, যারা নিজ হাতে কিতাব রচনা করে এবং সামান্য অর্থের জন্য বলে এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে, নিজ হাতে তারা যা রচনা করেছে এ জন্য তাদের ধ্বংস হোক, তারা যা উপার্জন করেছে এ জন্য তাদের ধ্বংস হোক। ’ (সুরা : বাকারাআয়াত : ৭৯)

ইহুদীরা তাদের এলাহী কিতাব তওরাতের শাব্দিক পরিবর্তন নবী মূসা (আঃ)-এর জীবদ্দশায় যেমন করেছিল, অর্থগত পরিবর্তনও তারা করেছিল। যেমন মূসা (আঃ) যখন তাদের ৭০ জন নেতাকে সাথে নিয়ে তূর পাহাড়ে গেলেন। অতঃপর আল্লাহর গযবে মৃত্যুবরণ করে পুনরায় তাঁর রহমতে জীবিত হয়ে ফিরে এল, তখনও এই গর্বিত জাতি তওরাত যে আল্লাহর নাযিলকৃত গ্রন্থ এ সাক্ষ্য দেওয়ার সাথে সাথে একথাও জুড়ে দিল যে, আল্লাহ তাআলা সবশেষে একথাও বলেছেন যে, তোমরা যতটুকু পার, আমল কর। আর যা না পার তা আমি ক্ষমা করে দিবঅথচ এটা ছিল সম্পূর্ণ বানোয়াট কথা। তাদের এই মিথ্যা সাক্ষ্যের ফলে লোকেরা বলে দিল যে, তওরাতের বিধান সমূহ মেনে চলা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।তখনই আল্লাহর হুকুমে ফেরেশতাগণ তূর পাহাড়ের একাংশ উপরে তুলে ধরে তাদের হুকুম দিলেন, হয় তোমরা তওরাত মেনে নাও, না হয় ধ্বংস হও। তখন নিরুপায় হয়ে তারা তওরাত মেনে নেয়।

মূসা (আঃ)-এর মৃত্যুর পরেও তওরাত, যবূর ও ইঞ্জীল গ্রন্থগুলিতে তারা অসংখ্য শব্দগত ও অর্থগত পরিবর্তন ঘটিয়েছে। ফলে এই কিতাবগুলি আসল রূপে কোথাও আর পৃথিবীতে অবশিষ্ট নেই। 

তাওরাত ও ইঞ্জিলের ওপর নির্ভর করা

কোরআন ছাড়া অন্যান্য আসমানি কিতাব কালক্রমে অপব্যাখ্যা ও বিকৃতির শিকার হয়েছে। ফলে হারিয়ে গেছে তার মৌলিকত্ব এবং যার সত্য-মিথ্যা নিরূপণ সত্যিই দুরূহ। এ জন্য রাসুল (সা.) সাহাবাদের সতর্ক করেন, যেন তাঁরা আগের কিতাবের প্রতি উত্সুক না হন। জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, একদিন ওমর (রা.) তাওরাতের একটি অংশ আরবিতে লিখে রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে পড়তে শুরু করেন। তা শুনে রাসুল (সা.)-এর চেহারা পরিবর্তিত হয়ে যায়। এক আনসারি সাহাবি বললেন, হে ওমর, তোমার ধ্বংস হোক, তুমি রাসুল (সা.)-এর চেহারা দেখছ না? তখন রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা আহলে কিতাবদের কিছু জিজ্ঞেস করবে না। তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হয়েছে। তারা কখনো তোমাদের সঠিক পথ দেখাবে না। নতুবা তোমরা হয়তো সত্যকে মিথ্যা সাব্যস্ত করবে কিংবা মিথ্যাকে সত্য বলবে। ওই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ, মুসা (আ.) এখন তোমাদের মাঝে এলে আমাকে বাদ দিয়ে তোমরা তাকে অনুসরণ করলে অবশ্যই তোমরা পথভ্রষ্ট হবে। মনে রেখো, তোমরা সব উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ উম্মত, আমি সব নবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নবী। ’ (মুসনাদে আহমাদ : ৪৩৯)

মোল্লা জিয়ুন (রহ.) বলেন, পূর্ববর্তী শরিয়তের যে অংশ কোরআন ও হাদিসে উদ্ধৃত হয়েছে তা আমরা গ্রহণ করব। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল যদি কোনো বিষয়কে ইতিবাচক হিসেবে উল্লেখ করেন, তবে তা ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করব এবং কোনো বিষয়কে নেতিবাচক হিসেবে উল্লেখ করেন তা থেকে বিরত থাকব। আর যে বিষয়গুলো কোরআন ও হাদিসে উদ্ধৃত হয়নি, আমরা তা থেকে বিরত থাকব। কেননা আমরা নিশ্চিত নই যে তা আল্লাহর বাণী কি না? কেননা ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মগুরুরা তাকে বিকৃতি সাধন করেছে। (নুরুল আনওয়ার, সুন্নাহ অধ্যায়)

                                                       ইহুদিদের চরিত্র

হে রাসুল! তাদের জন্য দুঃখ করবেন না, যারা দৌড়ে গিয়ে কুফরে পতিত হয়; যারা মুখে বলে, আমরা ইমান এনেছি, অথচ তাদের অন্তর ইমান আনেনি। আর যারা ইহুদি তারা মিথ্যা বলার জন্য গুপ্তচরবৃত্তি করে। (তাদের মধ্যে) যারা আপনার কাছে আসেনি তারা অন্য দলের গুপ্তচরতারা (আল্লাহর) কালামকে স্বস্থান থেকে পরিবর্তন (বিকৃত) করে। তারা বলে, যদি তোমরা এ নির্দেশ পাও, তবে তা গ্রহণ কোরো আর যদি এ নির্দেশ না পাও, তবে বিরত থেকো। আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করতে চান, তার জন্য আল্লাহর কাছে আপনি কিছুই করতে পারবেন না। তারা এমনই যে আল্লাহ তাদের অন্তরকে পবিত্র করতে চান না। তাদের জন্য দুনিয়ায়ও রয়েছে লাঞ্ছনা আর আখিরাতে রয়েছে বিরাট শাস্তি। (সুরা আল-মায়েদা - ৪১)

সুরা মায়েদার ৪১ নম্বর আয়াতে ইহুদিদের অনিষ্টতা ও দুশ্চরিত্রের কিছু বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে।

প্রথমত, ইহুদিরা মিথ্যা ও ভ্রান্ত কথাবার্তা শোনাতে অভ্যস্ত। তাদের পাদ্রিরা তাওরাত শরিফ বিকৃত করে যেসব বিধান ও অমূলক কিসসা-কাহিনী তাদের শোনাত, সাধারণ ইহুদিরা তা-ই মেনে নিত।

দ্বিতীয়ত, ইহুদিদের শ্রেণিভুক্ত মুনাফিকরা গুপ্তচরবৃত্তিতে লিপ্ত ছিল। ধর্ম অনুসরণের জন্য নয়, বরং প্রকৃতপক্ষে তারা বিভিন্ন বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি জেনে ইহুদিদের কাছে বলে দিত।

তৃতীয়ত, ইহুদিদের বদ অভ্যাস ছিল, ঐশী গ্রন্থের বিকৃতি সাধন। তারা আল্লাহর কালামকে যথার্থ স্থান থেকে সরিয়ে তার ভুল অর্থ করত। আর আল্লাহর নির্দেশকে বিকৃত করত। তারা আল্লাহর কালামের শব্দগত ও অর্থগত উভয় প্রকার বিকৃতিতেই অভ্যস্ত ছিল।

চতুর্থত, ইহুদিদের বদ অভ্যাস ছিল, ঘুষ ও উৎকোচ গ্রহণ। মূলত ইহুদিদের অনৈতিক অপরাধগুলো আলোচনা করে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের সেসব বিষয় থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।  (তাফসিরে মা'আরেফুল কোরআন ও ইবনে কাছির অবলম্বনে )

যুগে যুগে ইহুদিদের অপকর্ম ও  শাস্তি

 

আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'আমি বনি ইসরাইলের নিকট থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম এবং তাদের নিকট রাসুল প্রেরণ করেছিলাম। যখনই কোনো রাসুল তাদের নিকট এমন কিছু নিয়ে আসে, যা তাদের মনঃপূত নয়, তখনই তারা কতককে মিথ্যাবাদী বলে আর কতককে হত্যা করে। ' –( মায়েদা : ৭০)শুধু তাই নয়, নবী-রাসুল ছাড়াও তারা বহু ধর্মপ্রচারককে হত্যা করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'মানুষের মধ্যে যারা ন্যায়পরায়ণতার নির্দেশ দেয় তারা তাদেরকে হত্যা করে। ' –( আলে ইমরান : ১) আল্লাহর নবীদের ইহুদিরা ব্যতীত আর কেউ হত্যা করেনি। তারা জাকারিয়া (.) ও ইয়াহইয়া (.)-কে হত্যা করেছিল। তিন তিনবার আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। এ ছাড়া বহু নবী-রাসুলকে তারা প্রহার করেছিল এবং হত্যার চেষ্টা চালিয়েছিল। তাদের সেসব হত্যাকাণ্ডের বিবরণ পবিত্র কোরআনে বহু স্থানে বিবৃত হয়েছে। সুরা বাকারায় আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'তারা নবীগণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করত। ' – (বাকারা ৬১)

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত হাদিসে রয়েছে ইহুদিরা ৩০০ জন নবীকে হত্যা করেছে (ইবনে কাসির প্রথম খণ্ড

মুসা (আ.)

ইহুদি জাতিকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি কষ্টে ভুগেছেন হজরত মুসা (আ.)। কোরআন শরিফের বহু জায়গায় এর বিশদ বর্ণনা এসেছে। সুরা বাকারার শুরুর দিকে ইহুদি জাতির ওপর আল্লাহর রহমত এবং প্রায় ১২টি কুকর্ম ও আল্লাহর পক্ষ থেকে এর শাস্তির বিবরণ রয়েছে।

আল্লাহ তাদের মিসরের ফেরাউনের হাত থেকে রক্ষা করার পর মুসা (আ.) তুর পাহাড়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওরাত আনার জন্য গেলে তারা গরুর বাছুরের পূজা আরম্ভ করে। আল্লাহ তাদের এর শাস্তি দিয়ে ক্ষমা করার পর আবার তারা বায়না করে বসে আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখার জন্য। এ জন্য তাদের ওপর ফেরেশতার মাধ্যমে তুর পাহাড় উঠিয়ে শাস্তির ভয় দেখানো হয়।মুসা (আ.)-এর দোয়ায় তাদের জন্য কুদরতি খাবারের ব্যবস্থা করা হলে তারা অকৃতজ্ঞ হয়ে তা খেতে অস্বীকার করে। কখনো তারা মুসা (আ.)-এর ওপর খারাপ অসুস্থতা ও ব্যভিচারের অপবাদ দেয়। এভাবে হজরত মুসা (আ.) আজীবন তাদের নিয়ে কষ্ট করেন।

মূর্তি পূজার আবদার

বনু ইস্রাঈল কওম মূসা (আঃ)-এর মুজেযার বলে লোহিত সাগরে নির্ঘাত ডুবে মরা থেকে সদ্য নাজাত পেয়ে এসেছিল এবং গোটা ফেরাঊনী গোষ্ঠীকে সাগরে ডুবে মরার মর্মান্তিক দৃশ্য স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে এসেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সিরিয়া আসার পথে কিছুদূর অগ্রসর হতেই তারা এমন এক জনপদের উপর দিয়ে অতিক্রম করল, যারা বিভিন্ন মূর্তির পূজায় লিপ্ত ছিল। তাদের পূজা-অর্চনার জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান দেখে তাদের মন সেদিকে আকৃষ্ট হল এবং মূসা (আঃ)-এর কাছে গিয়ে আবেদন করলاجْعَل لَّنَا إِلَـهاً كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ ‘তাদের মূর্তিসমূহের ন্যায় আমাদের জন্যও একটা মূর্তি বানিয়ে দিনমূসা বললেনإِنَّكُمْ قَوْمٌ تَجْهَلُونَ ‘তোমরা দেখছি মূর্খতায় লিপ্ত জাতিতিনি বলেনإِنَّ هَـؤُلاء مُتَبَّرٌ مَّا هُمْ فِيهِ وَبَاطِلٌ مَّا كَانُوْا يَعْمَلُونَ ‘এরা যে কাজে নিয়োজিত রয়েছে, তা ধ্বংস হবে এবং যা কিছু তারা করছে, তা সব বাতিলতিনি আরও বললেনأَغَيْرَ اللهِ أَبْغِيْكُمْ إِلَـهاً ‘আমি কি তোমাদের জন্য আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য সন্ধান করব? অথচ তিনি তোমাদেরকে সারা বিশ্বের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন’ (রাফ ৭/১৩৮-১৪০)   (আসাদুল্লাহ গালিব )

 

গো-বৎস পূজা

 

মূসা যখন বনী ইস্রাঈলকে নিয়ে তূর পাহাড়ের দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন। তখন তিনি হারূণ (আঃ)-কে কওমের দায়িত্ব দিয়ে গেলেন এবং তাদেরকে পশ্চাতে আসার নির্দেশ দিয়ে নিজে আগে চলে গেলেন এবং সেখানে গিয়ে ৪০ দিন ছিয়াম ও ইতেকাফে কাটানোর পরে তওরাত লাভ করলেন। তাঁর ধারণা ছিল যে, তার কওম নিশ্চয়ই তার পিছে পিছে তূর পাহাড়ের সন্নিকটে এসে শিবির স্থাপন করেছে। কিন্তু তাঁর ধারণা ছিল সম্পূর্ণ ভুল।

আল্লাহ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন- ‘হে মূসা! তোমার সম্প্রদায়কে পিছনে ফেলে তুমি দ্রুত চলে এলে কেন?’ ‘তিনি বললেন, তারা তো আমার পিছে পিছেই আসছে এবং হে প্রভু! আমি তাড়াতাড়ি তোমার কাছে এলাম, যাতে তুমি খুশী হওআল্লাহ বললেন, ‘আমি তোমার সম্প্রদায়কে পরীক্ষা করেছি তোমার পর এবং সামেরী তাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে’ ( সুরা ত্বোয়াহা , ৮৩-৮৫)

একথা জেনে মূসা (আঃ) হতভম্ব হয়ে গেলেন এবং দুঃখে ও ক্ষোভে অস্থির হয়ে নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গেলেন। যেমন আল্লাহ বলেন,

 অতঃপর মূসা তার সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে গেলেন ক্রুদ্ধ ও অনুতপ্ত অবস্থায়। তিনি বললেন, হে আমার সম্প্রদায়! তোমাদের পালনকর্তা কি তোমাদের একটি উত্তম প্রতিশ্রুতি (অর্থাৎ তওরাৎ দানের প্রতিশ্রুতি) দেননি? তবে কি প্রতিশ্রুতির সময়কাল (৪০ দিন) তোমাদের কাছে দীর্ঘ হয়েছে? না-কি তোমরা চেয়েছ যে তোমাদের উপর তোমাদের পালনকর্তার ক্রোধ নেমে আসুক, যে কারণে তোমরা আমার সাথে কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করলে’? (৮৬) তারা বলল, আমরা আপনার সাথে কৃত ওয়াদা স্বেচ্ছায় ভঙ্গ করিনি। কিন্তু আমাদের উপরে ফেরাঊনীদের অলংকারের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অতঃপর আমরা তা নিক্ষেপ করে দিয়েছি এমনিভাবে সামেরীও  নিক্ষেপ করেছে(৮৭)অতঃপর সে তাদের জন্য (সেখান থেকে) বের করে আনলো একটা গো-বৎসের অবয়ব, যার মধ্যে হাম্বা হাম্বা রব ছিল। অতঃপর (সামেরী ও তার লোকেরা) বলল, এটাই তোমাদের উপাস্য এবং মূসারও উপাস্য, যা পরে মূসা ভুলে গেছে’ ( সুরা ত্বোয়াহা ,৮৬-৮৮)

ঘটনা ছিল এই যে, মিসর থেকে বিদায়ের দিন যাতে ফেরাঊনীরা তাদের পশ্চাদ্ধাবন না করে এবং তারা কোনরূপ সন্দেহ না করে, সেজন্য (মূসাকে লুকিয়ে) বনু ইস্রাঈলরা প্রতিবেশী ক্বিবতীদের কাছ থেকে অলংকারাদি ধার নেয় এই কথা বলে যে, আমরা সবাই ঈদ উৎসব পালনের জন্য যাচ্ছি। দুএকদিনের মধ্যে ফিরে এসেই তোমাদের সব অলংকার ফেরৎ দিব। কিন্তু সাগর পার হওয়ার পর যখন আর ফিরে যাওয়া হল না, তখন কুটবুদ্ধি ও মূসার প্রতি কপট বিশ্বাসী সামেরী মনে মনে এক ফন্দি আটলো যে, এর দ্বারা সে বনু ইস্রাঈলদের পথভ্রষ্ট করবে। অতঃপর মূসা (আঃ) যখন তার সম্প্রদায়কে হারূণের দায়িত্বে দিয়ে নিজে আগেভাগে তূর পাহাড়ে চলে যান, তখন সামেরী সুযোগ বুঝে তার ফন্দি কাজে লাগায়। সে ছিল অত্যন্ত চতুর। সাগর ডুবি থেকে নাজাত পাবার সময় সে জিব্রীলের অবতরণ ও তার ঘোড়ার প্রতি লক্ষ্য করেছিল। সে দেখেছিল যে, জিব্রীলের ঘোড়ার পা যে মাটিতে পড়ছে, সে স্থানের মাটি সজীব হয়ে উঠছে ও তাতে জীবনের স্পন্দন জেগে উঠছে। তাই সবার অলক্ষ্যে এ পদচিহ্নের এক মুঠো মাটি সে তুলে সযতনে রেখে দেয়।

মূসা (আঃ) চলে যাবার পর সে লোকদের বলে যে, ‘তোমরা ফেরাঊনীদের যেসব অলংকারাদি নিয়ে এসেছ এবং তা ফেরত দিতে পারছ না, সেগুলি ভোগ-ব্যবহার করা তোমাদের জন্য হালাল হবে না। অতএব এগুলি একটি গর্তে নিক্ষেপ করে জ্বালিয়ে দাওকথাটি অবশেষে হারূণ (আঃ)-এর কর্ণগোচর হয়। নাসাঈ-তে বর্ণিত হাদীছুল ফুতূনেহযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ)-এর রেওয়ায়াত থেকে জানা যায় যে, হযরত হারূণ (আঃ) সব অলংকার একটি গর্তে নিক্ষেপ করে জ্বালিয়ে দেবার নির্দেশ দেন, যাতে সেগুলি একটি অবয়বে পরিণত হয় এবং মূসা (আঃ)-এর ফিরে আসার পর এ সম্পর্কে করণীয় নির্ধারণ করা যায়। হযরত হারূণ (আঃ)-এর নির্দেশ মতে সবাই যখন অলংকার গর্তে নিক্ষেপ করছে, তখন সামেরীও হাতের মুঠি বন্ধ করে সেখানে পৌঁছল এবং হযরত হারূণ (আঃ)-কে বলল, আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হৌক- এই মর্মে আপনি দোআ করলে আমি নিক্ষেপ করব, নইলে নয়।হযরত হারূণ তার কপটতা বুঝতে না পেরে সরল মনে দোআ করলেন। আসলে তার মুঠিতে ছিল জিব্রীলের ঘোড়ার পায়ের সেই অলৌকিক মাটি। ফলে উক্ত মাটির প্রতিক্রিয়ায় হৌক কিংবা হযরত হারূণের দোআর ফলে হৌক- সামেরীর উক্ত মাটি নিক্ষেপের পরপরই গলিত অলংকারাদির অবয়বটি একটি গো-বৎসের রূপ ধারণ করে হাম্বা হাম্বা রব করতে থাকে। মুনাফিক সামেরী ও তার সঙ্গী-সাথীরা এতে উল্লসিত হয়ে বলে উঠল,  ‘এটাই হল তোমাদের উপাস্য ও মূসার উপাস্য। যা সে পরে ভুলে গেছে’ (ত্বোয়াহা ২০/৮৮)

মূসা (আঃ)-এর তূর পাহাড়ে গমনকে সে অপব্যাখ্যা দিয়ে বলল, মূসা বিভ্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে কোথাও চলে গিয়েছে। এখন তোমরা সবাই গো-বৎসের পূজা করকিছু লোক তার অনুসরণ করল। বলা হয়ে থাকে যে, বনু ইস্রাঈল এই ফিৎনায় পড়ে তিন দলে বিভক্ত হয়ে গেল। ফলে মূসা (আঃ)-এর পিছে পিছে তূর পাহাড়ে গমনের প্রক্রিয়া পথিমধ্যেই বানচাল হয়ে গেল।

হারূণ (আঃ) তাদেরকে বললেন- কওম! তোমরা এই গো-বৎস দ্বারা পরীক্ষায় পতিত হয়েছ। তোমাদের পালনকর্তা অতীব দয়ালু। অতএব তোমরা আমার অনুসরণ কর এবং আমার আদেশ মেনে চল(৯০)কিন্তু সম্প্রদায়ের লোকেরা বলল, ‘মূসা আমাদের কাছে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা এর পূজায় রত থাকব’ সুরা ত্বোয়াহা , ৯০-৯১)

অতঃপর মূসা (আঃ) এলেন এবং সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে সব কথা শুনলেন। হারূণ (আঃ)ও তাঁর বক্তব্য পেশ করলেন। সামেরীও তার কপটতার কথা অকপটে স্বীকার করল। অতঃপর মূসা (আঃ) আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী শাস্তি ঘোষণা করলেন। মূসা (আঃ) গো-বৎস পূজায় নেতৃত্ব দানকারী হঠকারী লোকদের মৃত্যুদন্ড দিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন মূসা তার সম্প্রদায়কে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা গো-বৎসকে উপাস্য নির্ধারণ করে নিজেদের উপরে যুলুম করেছ। অতএব এখন তোমাদের প্রভুর নিকটে তওবা কর এবং নিজেদেরকে পরস্পরে হত্যা কর। এটাই তোমাদের জন্য তোমাদের স্রষ্টার নিকটে কল্যাণকর’... ( সুরা বাক্বারাহ , ৫৪)এভাবে তাদের কিছু লোককে হত্যা করা হয়, কিছু লোক ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়। ( আসাদুল্লাহ আল গালিব )

গো-বৎস পূজার নায়ক সামেরি ছিল ইসরাইলী ইহুদি।জন্মগতভাবে সে ছিল পিতৃ পরিচয়হীন। বংশগতভাবে ছিল ইসরাইলি। তার মা লোক লজ্জা ও দুর্নামের ভয়ে পাহাড়ের গুহায় তাকে প্রসব করে সেখানেই ফেলে রেখে এসেছিল। আল্লাহ তাআলা তাকে হজরত জিবরিল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে লালন-পালন করে বড় করেছেন। সে ছিল পেশায় স্বর্ণকার। স্বর্ণালংকার তৈরি করেই তার জীবিকা নির্বাহ হতো। তার আসল নাম নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ বলেন, তার নাম ছিল মুসা, কেউ বলেন, সে ছিল কিবতী (ফেরাউন বংশীয়)। ইবনে কাসীরের বর্ণনা অনুযায়ী, ইসরাইলী গ্রন্থাবলীতে তার নাম হারুন লেখা আছে। প্রসিদ্ধ মতে, এ ব্যক্তি হযরত মুসা (আ.)এর যুগের মোনাফেক ছিল এবং মোনাফেকদের ন্যায় ধোকাবাজি ও প্রতারণার মাধ্যমে মুসলমানদের গুমরাহ ও বিভ্রান্ত করার ধান্দায় লিপ্ত থাকত। কেউ বলেন,পারস্য অথবা ভারতবর্ষের অধিবাসী সামেরী গো-পূজারী সম্প্রদায়ের লোক ছিল। পরে মিসরে পৌঁছে সে মুসা (আ.) এর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করে। অত্যন্ত চতুর এই ব্যক্তিটি পরে কপট বিশ্বাসী ও মুনাফিক হয়ে যায়। কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ না পাওয়ায় সে বনি ইসরাইলীদের সাথে সাগর পার হওয়ার সুযোগ পায়। মুসা (আ.) এর বিপুল নাম-যশ ও অলৌকিক ক্ষমতায় সে তার প্রতি মনে মনে ঈর্ষাপরায়ণ ছিল। মুসা (আ.) এর সান্নিধ্য ও নিজস্ব সুক্ষ্মদর্শিতার কারণে সে জিব্রাঈল ফেরেশতা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠে। সেই আগ্রহের কারণেই সাগর পার হওয়ার সময় সে জিব্রাইলকে চিনতে পারে ও তার ঘোড়ার পদচিহ্নের মাটি সংগ্রহ করে। তার ধারণা ছিল যে, মুসার যাবতীয় ক্ষমতার উৎস হল এই ফেরেশতা। অতএব তার স্পর্শিত মাটি দিয়ে সেও এখন মুসার ন্যায় অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হবে।কোন কোন মুফাসসির বলেন, সামেরি কোন ব্যক্তির নাম নয় বরং সে সময় সামেরি নামে এক গোত্র ছিল এবং তাদের এক বিশেষ ব্যক্তি ছিল বনী ইসরাঈলের মধ্যে স্বর্ণ নির্মিত গো-বৎস পূজার প্রচলনকারী এ সামেরী। সে তাদেরকে গো বৎস পূজার আহবান জানিয়েছিল এবং শিরকে নিপতিত করেছিল। (ফাতহুল কাদীর)।

আল্লাহকে দেখার জিদ

আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতে তাঁর দেয়া জীবন-ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করার জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবি-রাসুল প্রেরণ করেছেন। যখনই কালিমার দাওয়াত পেশ করা হতো, তখনই তারা নানা অজুহাত, শর্তারোপ করতো। যা ঘটেছে হজরত মুসা আলাইহিস সালামের ক্ষেত্রেও। আল্লাহর ওয়াদা অনুযায়ী মুসা আলাইহিস সালাম তার উম্মতের লোকদের নিয়ে তুর পাহাড়ে গেলে সেখানে যা ঘটেমূসা (আঃ) তূর পাহাড়ে তওরাৎ প্রাপ্ত হয়ে বনু ইস্রাঈলের কাছে ফিরে এসে তা পেশ করলেন এবং বললেন যে, এটা আল্লাহ প্রদত্ত কিতাব। তোমরা এর অনুসরণ কর। তখন কিছু সংখ্যক উদ্ধত লোক বলে উঠলো, যদি আল্লাহ স্বয়ং আমাদের বলে দেন যে, এটি তাঁর প্রদত্ত কিতাব, তাহলেই কেবল আমরা বিশ্বাস করব, নইলে নয়। হতে পারে তুমি সেখানে চল্লিশ দিন বসে বসে এটা নিজে লিখে এনেছ। তখন মূসা (আঃ) আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাদেরকে তাঁর সাথে তূর পাহাড়ে যেতে বললেন। বনু ইস্রাঈলরা তাদের মধ্যে বাছাই করা সত্তর জনকে মনোনীত করে মূসা (আঃ)-এর সাথে তূর পাহাড়ে প্রেরণ করল। সেখানে পৌঁছে তারা আল্লাহর বাণী স্বকর্ণে শুনতে পেল। এরপরেও তাদের অবাধ্য মন শান্ত হল না। শয়তানী ধোঁকায় পড়ে তারা নতুন এক অজুহাত তুলে বলল, এগুলো আল্লাহর কথা না অন্য কারু কথা, আমরা বুঝবো কিভাবে? অতএব যতক্ষণ আমরা তাঁকে সশরীরে প্রকাশ্যে আমাদের সম্মুখে না দেখব, ততক্ষণ আমরা বিশ্বাস করব না যে, এসব আল্লাহর বাণী। কিন্তু যেহেতু এ পার্থিব জগতে চর্মচক্ষুতে আল্লাহকে দেখার ক্ষমতা কারু নেই, তাই তাদের এই চরম ধৃষ্টতার জবাবে আসমান থেকে ভীষণ এক নিনাদ এল, যাতে সব নেতাগুলোই চোখের পলকে অক্কা পেল।

অকস্মাৎ এমন ঘটনায় মূসা (আঃ) বিস্মিত ও ভীত-বিহবল হয়ে পড়লেন। তিনি প্রার্থনা করে বললেন, হে আল্লাহ! এমনিতেই ওরা হঠকারী। এরপরে এদের এই মৃত্যুতে লোকেরা আমাকেই দায়ী করবে। কেননা মূল ঘটনার সাক্ষী কেউ থাকল না আমি ছাড়া। অতএব হে আল্লাহ! ওদেরকে পুনর্জীবন দান কর। যাতে আমি দায়মুক্ত হতে পারি এবং ওরাও গিয়ে সাক্ষ্য দিতে পারে। আল্লাহ মূসার দোআ কবুল করলেন এবং ওদের জীবিত করলেন। এ ঘটনা আল্লাহ বর্ণনা করেন এভাবে- আর যখন তোমরা বললে, হে মূসা! কখনোই আমরা তোমাকে বিশ্বাস করব না, যতক্ষণ না আমরা আল্লাহকে প্রকাশ্যে দেখতে পাব। তখন তোমাদেরকে পাকড়াও করল এক ভীষণ নিনাদ (বজ্রপাত), যা তোমাদের চোখের সামনেই ঘটেছিলঅতঃপর তোমাদের মৃত্যুর পর আমরা তোমাদেরকে পুনর্জীবিত করলাম, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর’ (বাক্বারাহ , ৫৫-৫৬)    (আসাদুল্লাহ আল গালিব )

জিহাদ বিমুখ ও 

তৎকালীন সময়ে শামদেশ বলতে- বর্তমান সময়ের সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন ও ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে বুঝানো হতো।যেখানে বায়তুল মুক্বাদ্দাস অবস্থিত। মূসা (আঃ)-এর আগমনকালে বায়তুল মুক্বাদ্দাস সহ সমগ্র শাম এলাকা আমালেক্বা সম্প্রদায়ের অধীনস্থ ছিল। তারা ছিল কওমে আদ-এর একটি শাখা গোত্র। দৈহিক দিক দিয়ে তারা ছিল অত্যন্ত সুঠাম, বলিষ্ঠ ও ভয়াবহ আকৃতি বিশিষ্ট। তাদের সাথে যুদ্ধ করে বায়তুল মুক্বাদ্দাস অধিকার করার নির্দেশ মূসা (আঃ) ও তাঁর সম্প্রদায়কে আল্লাহ দিয়েছিলেন। সাথে সাথে এ সুসংবাদও দিয়েছিলেন যে, শামের ভূখন্ড তাদের ভাগ্যে লেখা হয়ে গেছে (মায়েদাহ /২১)কাজেই তোমাদের বিজয় সুনিশ্চিত। কিন্তু এইসব বিলাসী কাপুরুষেরা আল্লাহর কথায় দৃঢ় বিশ্বাস আনতে পারেনি। তারা আল্লাহ তাআলার কথা মানত না। আল্লাহ তাআলা যখন হজরত মুসা (আ.)-কে আমালেকা সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেন, তখন তিনি বনি ইসরাইলের ১২ গোত্রের ১২ জন নেতাকে আমালেকা সম্প্রদায়ের রণাঙ্গনের অবস্থা দেখার জন্য প্রেরণ করেন। বায়তুল মাকদাসের অদূরে শহরের বাইরে আমালেকা সম্প্রদায়ের এ ব্যক্তির সঙ্গে তাদের দেখা হয়। সে একাই ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে তাদের বাদশাহর কাছে নিয়ে গিয়ে বলে, এরা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসেছে। রাজদরবারে নানা পরামর্শের পর তাদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়, যাতে তারা স্বজাতির কাছে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমালেকা জাতির শৌর্য-বীর্যের কথা বর্ণনা করতে পারে। ফলে আক্রমণ করা তো দূরের কথা, এদের দিকে মুখ করার দুঃসাহসও না দেখায়।বনি ইসরাইলের  ১২ জন সর্দার আমালেকা গোত্রের কয়েদখানা থেকে মুক্ত হয়ে ইউশা বিন নুন ও কালিব বিন ইউকান্না ছাড়া অন্যরা সবাই স্বজাতির কাছে সব বলে দেয়, অথচ তাদের সব কথা মুসা (আ.)-এর কাছে বলতে বলেছিলেন। তারা মুসা (আ.)-কে গিয়ে বলল, ‘আপনি ও আপনার পালনকর্তা যান ও উভয়ে যুদ্ধ করুনআমরা এখানে বসলাম। ’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ২৪) নবীর অবাধ্যতার ফলস্বরূপ এই জাতিকে ৪০ বছর তীহ্ প্রান্তরের উন্মুক্ত কারাগারে বন্দী থাকতে হয় (মায়েদাহ /২৬)এই উন্মুক্ত কারাগারে না ছিল কোন প্রাচীর, না ছিল কোন কারারক্ষী। তারা প্রতিদিন সকালে উঠে মিসর অভিমুখে রওয়ানা হত। আর সারাদিন চলার পর রাতে আবার সেখানে এসেই উপস্থিত হ, যেখান থেকে সকালে তারা রওয়ানা হয়েছিল। কিন্তু কোনভাবেই তারা অদৃশ্য কারা প্রাচীর ভেদ করে যেতে পারত না। এভাবে চল্লিশ বছর পর্যন্ত হতবুদ্ধি অবস্থায় দিগ্বিদিক ঘুরে এই হঠকারী অবাধ্য জাতি তাদের দুনিয়াবী শাস্তি ভোগ করতে থাকে। যেমন ইতিপূর্বে নূহ (আঃ)-এর অবাধ্য কওম দুনিয়াবী শাস্তি হিসাবে প্লাবণে ডুবে নিশ্চিহ্ন হয়েছিল। বস্ত্ততঃ চল্লিশ বছরের দীর্ঘ সময়ের মধ্যে হারূণ ও মূসা (আঃ)-এর তিন বছরের বিরতিতে মৃত্যু হয়। অতঃপর শাস্তির মেয়াদ শেষে পরবর্তী নবী ইউশাবিন নূন-এর নেতৃত্বে জিহাদের মাধ্যমে তারা বায়তুল মুক্কাদ্দাস জয়ে সমর্থ হয় এবং সেখানে প্রবেশ করে। বর্ণিত হয়েছে যে, ১২ জন নেতার মধ্যে ১০ জন অবাধ্য ও ভীরু নেতা এরি মধ্যে মারা যায় এবং মূসার অনুগত ইউশাও কালেব দুই নেতাই কেবল বেঁচে থাকেন, যাদের হাতে বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজিত হয় (কুরতুবী, ইবনু কাছীর, তাফসীর মায়েদাহ ২৬)

বনু ইস্রাঈলের এই চূড়ান্ত বেআদবী ছিল কুফরীর নামান্তর এবং অত্যন্ত পীড়াদায়ক। যা পরবর্তীতে প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়ে গেছে। বদরের যুদ্ধের সময়ে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) কিছুটা অনুরূপ অবস্থায় পতিত হয়েছিলেন। অপর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা ও ক্ষুৎ-পিপাসায় কাতর অল্প সংখ্যক সবেমাত্র মুহাজির মুসলমানের মোকাবেলায় তিনগুণ শক্তিসম্পন্ন সুসজ্জিত বিরাট কুরায়েশ সেনাবাহিনীর আগমনে হতচকিত ও অপ্রস্ত্তত মুসলমানদের বিজয়ের জন্য যখন নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর নিকটে সাহায্য প্রার্থনা করছিলেন, তখন মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ আনছারী (রাঃ) দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কস্মিনকালেও ঐকথা বলব না, যা মূসা (আঃ)-এর স্বজাতি তাঁকে বলেছিলতুমি ও তোমার প্রভু যাও যুদ্ধ করগে। আমরা এখানে বসে রইলাম’ (মায়েদাহ ৫/২৪)বরং আমরা আপনার ডাইনে, বামে, সামনে ও পিছনে থেকে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করব। আপনি নিশ্চিন্তে যুদ্ধের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করুনবিপদ মুহূর্তে সাথীদের এরূপ বীরত্বব্যঞ্জক কথায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) অত্যন্ত প্রীত হয়েছিলেন।

ইউসুফ হতে মূসা পর্যন্ত দীর্ঘ চার/পাঁচশবছর মিসরে অবস্থানের পর এবং নিজেদের বিরাট জনসংখ্যা ছাড়াও ফেরাঊনীদের বহু সংখ্যক লোক গোপনে অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও এবং মূসা (আঃ)-এর মত শক্তিশালী একজন নবীকে পাওয়া সত্ত্বেও বনু ইস্রাঈলকে কেন রাতের অন্ধকারে মিসর থেকে পালিয়ে আসতে হ? অতঃপর পৃথিবীর কোথাও তারা আর স্থায়ীভাবে একত্রে বসবাস করতে পারেনি, তার একমাত্র কারণ ছিল জিহাদ বিমুখতাএই বিলাসী, ভীরু ও কাপুরুষের দল ফেরাঊন ও তার দলবলের ভয়ে এতই ভীত ছিল যে, তাদের নিষ্ঠুরতম নির্যাতনের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করত না। বরং মূসা (আঃ)-এর কাছে পাল্টা অভিযোগ তুলতো যে, তোমার কারণেই আমরা বিপদে পড়ে গেছিযেমন সূরা আরাফ ১২৯ আয়াতে এ বিষয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। অথচ ঐ সময় মিসরে মুসলমানের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১০ থেকে ২০ শতাংশ ছিল মিসর থেকে বেরিয়ে বায়তুল মুক্বাদ্দাস নগরী দখলের জন্যও তাদেরকে যখন জিহাদের হুকুম দেওয়া হ, তখনও তারা একইভাবে পিছুটান দিল। যার পরিণতি তারা সেদিনের ন্যায় আজও ভোগ করছে। বস্ত্ততঃ বিলাসী জাতি ভীরু হয় এবং জিহাদ বিমুখ জাতি কখনোই কোথাও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না।

মেঘ দ্বারা ছায়া প্রদান ও ঝর্ণাধারার প্রবাহ

ছায়াশূন্য তপ্ত বালুকা বিস্তৃত মরুভূমিতে কাঠফাটা রোদে সবচেয়ে প্রয়োজন যেসব বস্ত্তর, তন্মধ্যে ছায়াল সর্বপ্রধান। হঠকারী উম্মতের অবাধ্যতায় ত্যক্ত-বিরক্ত মূসা (আঃ) দয়াপরবশ হয়ে আল্লাহর নিকটে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রার্থনা নিবেদন করেছেন। দয়ালু আল্লাহ তাঁর দোআ সমূহ কবুল করেছেন এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে তাঁর বিশেষ রহমত সমূহ নাযিল করেছেন। তন্মধ্যে একটি হল উন্মুক্ত তীহ্ প্রান্তরের উপরে শামিয়ানা সদৃশ মেঘমালার মাধ্যমে শান্তিদায়ক ছায়া প্রদান করা। যেমন আল্লাহ এই অকৃতজ্ঞ জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন,‘স্মরণ কর সে কথা, যখন আমরা তোমাদেরকে ছায়া দান করেছিলাম মেঘমালার মাধ্যমে’ (বাক্বারাহ ২/৫৭)।

ছায়ার পরেই গুরুত্বপূর্ণ বস্ত্ত হল পানি। যার অপর নাম জীবন। পানি বিহনে তৃষ্ণার্ত পিপাসার্ত উম্মতের আহাজারিতে দয়া বিগলিত নবী মূসা স্বীয় প্রভুর নিকটে কাতর কণ্ঠে পানি প্রার্থনা করলেন। কুরআনের ভাষায়,আর মূসা যখন স্বীয় জাতির জন্য পানি চাইল, তখন আমি বললাম, তোমার লাঠি দিয়ে পাথরের উপরে আঘাত কর। অতঃপর তা থেকে বেরিয়ে এলো (১২টি গোত্রের জন্য) ১২টি ঝর্ণাধারা। তাদের সব গোত্রই চিনে নিল (অর্থাৎ মূসার নির্দেশ অনুযায়ী নির্ধারণ করে নিল) নিজ নিজ ঘাট। (আমি বললাম,) তোমরা আল্লাহর দেওয়া রিযিক খাও আর পান কর। খবরদার যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করে বেড়িয়ো না’ (বাক্বারাহ ২/৬০)।

বস্ত্ততঃ ইহুদী জাতি তখন থেকে এযাবত পৃথিবী ব্যাপী ফাসাদ সৃষ্টি করেই চলেছে। তারা কখনোই আল্লাহর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেনি। ( আসাদুল্লাহ)

 

মান্না ও সালওয়া

আর তোমাদের জন্য মান্না ও সালওয়া অবতীর্ণ করেছি। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৫৭)

তীহ্ স্থানটি ছিল উদ্ভিদ, বৃক্ষলতা ও পানিবিহীন এক শুষ্ক মরুভূমি। তারা তীহ্ ময়দানে একত্রিত হয়ে আবেদন করে। হে মুসা! সেখানে আমাদের আহারের ব্যবস্থা কিভাবে হবে? তখন আল্লাহ তাআলা তাদের জন্য মান্না ও সালওয়া নামের আসমানি খাদ্যের ব্যবস্থা করেন। অবাধ্য বনু ইস্রাঈলরা এগুলো সিরিয়ার তীহ্ প্রান্তরে ৪০ বছরের বন্দী জীবনে বিপুলভাবে পেয়েছিল আল্লাহর বিশেষ রহমতে। 

মান্না হলো এমন খাদ্য, যা রাতে কুয়াশার মতো পড়ে জমে যেত ও সুস্বাদু খাদ্যে পরিণত হতো। কারো কারো মতে, মান্না হলো ডুমুর। কারো কারো মতে, আঠালো সুমিষ্ট বস্তু। কারো মতে মধু, কারো মতে সুমিষ্ট পানীয়। কারো মতে, পাতলা রুটি। সালওয়া ছিল এক ধরনের পাখি, যা সূর্যাস্তের পর ঝাঁকে ঝাঁকে এসে ধরা দিত। তারা এদের গোশত ভক্ষণ করত। আধুনিক গবেষণায় বলা হয়েছে যে, মান্ন একপ্রকার আঠা জাতীয় উপাদেয় খাদ্য। যা শুকিয়ে পিষে রুটি তৈরী করে তৃপ্তির সাথে আহার করা যায়। সালওয়াএকপ্রকার চড়ুই পাখি, যা ঐসময় সিনাই এলাকায় প্রচুর পাওয়া যেত। ব্যাঙের ছাতার মত সহজলভ্য ও কাই জাতীয় হওয়ায় সম্ভবত একে মাশরূম-এর সাথে তুলনীয় মনে করা হয়েছে। তবে মাশরূম ও ব্যাঙের ছাতা সম্পূর্ণ পৃথক জিনিস। কয়েক লাখ বনু ইস্রাঈল কয়েক বছর ধরে মান্না ও সালওয়া খেয়ে বেঁচে ছিল। এতে বুঝা যায় যে, মান্ন ছিল চাউল বা গমের মত কার্বো-হাইড্রেট-এর উৎস এবং সালওয়া বা চড়ুই জাতীয় পাখির গোশত ছিল ভিটামিন ও চর্বির উৎস। সব মিলে তারা পরিপূর্ণ খাবার নিয়মিত খেয়ে বেঁচে থাকতে সক্ষম হয়েছিল। দক্ষিণ ইউরোপের সিসিলিতে, আরব উপদ্বীপের ইরাকে ও ইরানে, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতবর্ষে মান্না জাতীয় খাদ্য উৎপন্ন হয়।

দুনিয়ায় বসেই জান্নাতের খাবার, এ এক অকল্পনীয় অনির্বচনীয় আনন্দের বিষয়। কিন্তু এই হতভাগারা তাতেও খুব বেশীদিন খুশী থাকতে পারেনি। তারা গম, তরকারি, ডাল-পেঁয়াজ ইত্যাদি খাওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠলো। যেমন আল্লাহ বলেন,‘... আমরা তোমাদের জন্য খাবার পাঠিয়েছি মান্নাসালওয়া(আমরা বললাম) এসব পবিত্র বস্ত্ত তোমরা ভক্ষণ কর (কিন্তু ওরা শুনল না, কিছু দিনের মধ্যেই তা বাদ দেওয়ার জন্য ও অন্যান্য নিম্নমানের খাদ্য খাবার জন্য যিদ ধরলো)। বস্ত্ততঃ (এর ফলে) তারা আমার কোন ক্ষতি করতে পারেনি, বরং নিজেদেরই ক্ষতি সাধন করেছে’ (বাক্বারাহ ২/৫৭)।

আল্লাহ তাদের উদ্দেশ্যে বলেন,যখন তোমরা বললে, হে মূসা! আমরা একই ধরনের খাদ্যের উপরে কখনোই ধৈর্য ধারণ করতে পারব না। কাজেই তুমি তোমার প্রভুর নিকটে আমাদের পক্ষে প্রার্থনা কর তিনি যেন আমাদের জন্য এমন খাদ্য-শস্য দান করেন, যা জমিতে উৎপন্ন হয়; যেমন তরি-তরকারি, কাকুড়, গম, রসুন, ডাল, পেঁয়াজ ইত্যাদি। মূসা বললেন, তোমরা উত্তম খাদ্যের বদলে এমন খাদ্য পেতে চাও যা নিম্নস্তরের? তাহলে তোমরা অন্য কোন শহরে চলে যাও। সেখানে তোমরা তোমাদের চাহিদা মোতাবেক সবকিছু পাবে’ (বাক্বারাহ , ৬১)।

বনু ইস্রাঈলগণ যখন জান্নাতী খাদ্য বাদ দিয়ে দুনিয়াবী খাদ্য খাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে যিদ ধরে বসলো, তখন আল্লাহ তাদের পার্শ্ববর্তী জনপদে যেতে বললেন। যেখানে তাদের চাহিদামত খাদ্য-শস্যাদি তারা সর্বদা প্রাপ্ত হবে। উক্ত জনপদে প্রবেশের সময় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার জন্য তিনি কতগুলি আদব ও শিষ্টাচার মান্য করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তারা তাতে কর্ণপাত করল না। যেমন আল্লাহ বলেন,‘আর যখন আমরা বললাম, তোমরা প্রবেশ কর এ নগরীতে এবং এতে যেখানে খুশী খেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ কর এবং নগরীর ফটক দিয়ে প্রবেশ করার সময় সিজদা কর ও বলতে থাক (হে আল্লাহ!) আমাদিগকে ক্ষমা করে দাও’- তাহলে আমরা তোমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দেব এবং সৎকর্মশীলদের আমরা সত্বর অতিরিক্তভাবে আরও দান করব’ (বাক্বারাহ ২/৫৮)। কিন্তু এই অবাধ্য জাতি এতটুকু আনুগত্য প্রকাশ করতেও রাযী হয়নি। তাদেরকে শুকরিয়ার সিজদা করতে বলা হয়েছিল এবং আল্লাহর নিকটে ক্ষমা চেয়ে হিত্ত্বাহ আমাদের পাপসমূহ পুরোপুরি মোচন করুনবলতে বলতে শহরে প্রবেশের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বেআদবীর চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে তারা হিত্ত্বাহ-এর বদলে হিন্ত্বাহ অর্থাৎ গমের দানাবলতে বলতে এবং সিজদা বা মাথা নীচু করার পরিবর্তে পিছন দিকে পিঠ ফিরে প্রবেশ করল। এর মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে আল্লাহ পূজারীর বদলে পেটপূজারী বলে প্রমাণ করল।তীহ্ প্রান্তরে ৪০ বছর বন্দী জীবন কাটানোর পর নবী ইউশাবিন নূন-এর নেতৃত্বে জিহাদের মাধ্যমে তারা বিজয় লাভ করে ও নগরীতে প্রবেশ করে (ইবনু কাছীর)। এভাবে তাদের দীর্ঘ বন্দীত্বের অবসান ঘটে।

অথচ যদি প্রথমেই তারা মূসার হুকুম মেনে নিয়ে জিহাদে অবতীর্ণ হত, তাহলে তখনই তারা বিজয়ী হয়ে নগরীতে প্রবেশ করত। কিন্তু নবীর অবাধ্যতা করার কারণেই তাদের ৪০ বছর কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হল। পরিশেষে তাদেরকে সেই জিহাদই করতে হ, যা তারা প্রথমে করেনি ভীরুতা ও কাপুরুষতার কারণে। বস্ত্ততঃ ভীরু ব্যক্তি ও জাতি কখনো সম্মানিত হয় না। উল্লেখ্য যে, বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উক্ত প্রধান ফটককে আজও বাব হিত্ত্বাহবলা হয়ে থাকে (কুরতুবী)।অতঃপর যালেমরা সে কথা পাল্টে দিল, যা তাদেরকে বলতে বলা হয়েছিল। ফলে আমরা যালেমদের উপর তাদের অবাধ্যতার কারণে আসমান থেকে গযব নাযিল করলাম’ (বাক্বারাহ ৫৯)। তবে সেটা যে কি ধরনের গযব ছিল, সে বিষয়ে কুরআন পরিষ্কার করে কিছু বলেনি। ইতিহাসও এ ব্যাপারে নীরব। তবে সাধারণতঃ এগুলি প্লেগ-মহামারী, বজ্রনিনাদ, ভূমিকম্প প্রভৃতি হয়ে থাকে। যা বিভিন্ন নবীর অবাধ্য উম্মতদের বেলায় ইতিপূর্বে হয়েছে। ( আসাদুল্লাহ আল গালিব )

বালআম বাঊরার ঘটনা

ফিলিস্তিন দখলকারী আমালেক্বা সম্প্রদায়ের শক্তিশালী নেতারা মূসা (আঃ) প্রেরিত ১২ জন প্রতিনিধিকে ফেরৎ পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেনি। কারণ তারা মূসা (আঃ)-এর মুজেযার কারণে ফেরাঊনের সসৈন্যে সাগরডুবির খবর আগেই জেনেছিল। অতএব মূসা (আঃ)-এর বায়তুল মুক্বাদ্দাস অভিযান বন্ধ করার জন্য তারা বাঁকা পথ তালাশ করল। তারা অত্যন্ত গোপনে বনু ইস্রাঈলের ঐ সময়কার একজন নামকরা সাধক ও দরবেশ আলেম বালআম ইবনে বাঊরার কাছে বহু মূল্যবান উপঢৌকনাদিসহ লোক পাঠাল। বালআম তার স্ত্রীর অনুরোধে তা গ্রহণ করল। অতঃপর তার নিকটে আসল কথা পাড়া হল যে, কিভাবে আমরা মূসার অভিযান ঠেকাতে পারি। আপনি পথ বাৎলে দিলে আমরা আরও মহামূল্যবান উপঢৌকনাদি আপনাকে প্রদান করব। বালআম উঁচুদরের আলেম ছিল। যে সম্পর্কে তার নাম না নিয়েই আল্লাহ বলেন,আপনি তাদেরকে শুনিয়ে দিন সেই লোকটির অবস্থা, যাকে আমরা আমাদের নিদর্শন সমূহ দান করেছিলাম। অথচ সে তা পরিত্যাগ করে বেরিয়ে গেল। আর তার পিছনে লাগল শয়তান। ফলে সে পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল’ (রাফ ১৭৫)

কথিত আছে যে, বালআম ইসমে আযম জানত। সে যা দোআ করত, তা সাথে সাথে কবুল হয়ে যেত। আমালেক্বাদের অনুরোধ ও পীড়াপীড়িতে সে অবশেষে মূসার বিরুদ্ধে দোআ করল। কিন্তু তার জিহবা দিয়ে উল্টা দোআ বের হতে লাগল যা আমালেক্বাদের বিরুদ্ধে যেতে লাগল। তখন সে দোআ বন্ধ করল। কিন্তু অন্য এক পৈশাচিক রাস্তা সে তাদের বাৎলে দিল। সে বলল, বনু ইস্রাঈলগণের মধ্যে ব্যভিচার ছড়িয়ে দিতে পারলে আল্লাহ তাদের উপরে নারায হবেন এবং তাতে মূসার অভিযান বন্ধ হয়ে যাবেআমালেক্বারা তার পরামর্শ গ্রহণ করল এবং তাদের সুন্দরী মেয়েদেরকে বনু ইস্রাঈলের নেতাদের সেবাদাসী হিসাবে অতি গোপনে পাঠিয়ে দিল। বড় একজন নেতা এফাঁদে পা দিল। আস্তে আস্তে তা অন্যদের মধ্যেও সংক্রমিত হল। ফলে আল্লাহর গযব নেমে এল। বনু ইস্রাঈলীদের মধ্যে প্লেগ মহামারী দেখা দিল। কথিত আছে যে, একদিনেই সত্তর হাযার লোক মারা গেল। এ ঘটনায় বাকী সবাই তওবা করল এবং প্রথম পথভ্রষ্ট নেতাকে প্রকাশ্যে হত্যা করে রাস্তার উপরে ঝুলিয়ে রাখা হল। অতঃপর আল্লাহর গযব উঠে গেল। এগুলি ইসরাইলী বর্ণনা।

 

গাভী কুরবানীর হুকুম ও হত্যাকারী চিহ্নিত

বনু ইস্রাঈলের জনৈক যুবক তার একমাত্র চাচাতো বোনকে বিয়ে করে তার চাচার অগাধ সম্পত্তির একক মালিক বনতে চায়। কিন্তু চাচা তাতে রাযী না হওয়ায় সে তাকে গোপনে হত্যা করে। পরের দিন বাহ্যিকভাবে কান্নাকাটি করে চাচার রক্তের দাবীদার সেজে কওমের নেতাদের কাছে বিচার দেয়। কিন্তু সাক্ষীর অভাবে আসামী শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। ইতিমধ্যে মূসা (আঃ) অহী মারফত জেনে গিয়েছিলেন যে, বাদী স্বয়ং আসামী এবং সেই-ই একমাত্র হত্যাকারী। এমতাবস্থায় সম্প্রদায়ের নেতারা এসে বিষয়টি ফায়ছালার জন্য মূসা (আঃ)-কে অনুরোধ করল। মূসা (আঃ) তখন আল্লাহর হুকুম মোতাবেক যে ফায়ছালা দিলেন, সে বিষয়ে আল্লাহ বলেন,যখন তোমরা একজনকে হত্যা করে পরে সে সম্পর্কে একে অপরকে দায়ী করছিলে। অথচ আল্লাহ তা প্রকাশ করে দিলেন, যা তোমরা গোপন করতে চাচ্ছিলে’ (বাক্বারাহ ২/৭২)কিভাবে আল্লাহ সেটা প্রকাশ করে দিলেন, তার বিবরণ নিম্নরূপ:

যখন মূসা স্বীয় কওমকে বললেন, আল্লাহ তোমাদেরকে একটা গাভী যবেহ করতে বলেছেন। তারা বলল, আপনি কি আমাদের সাথে উপহাস করছেন? তিনি বললেন, জাহিলদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে আমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি’ (বাক্বারাহ ৬৭)তারা বলল, তাহলে আপনি আপনার পালনকর্তার নিকটে আমাদের জন্য প্রার্থনা করুন, যেন তিনি বলে দেন, গাভীটি কেমন হবে? তিনি বললেন, আল্লাহ বলেছেন গাভীটি এমন হবে, যা না বুড়ী না বকনা, বরং দুয়ের মাঝামাঝি বয়সের হবে। এখন তোমাদের যা আদেশ করা হয়েছে, তা সেরে ফেল’ (৬৮)তারা বলল, আপনার প্রভুর নিকটে আমাদের পক্ষ থেকে প্রার্থনা করুন যে, গাভীটির রং কেমন হবে। তিনি বললেন, আল্লাহ বলেছেন, গাভীটি হবে চকচকে গাঢ় পীত বর্ণের, যা দর্শকদের চক্ষু শীতল করবে’ (৬৯)লোকেরা আবার বলল, আপনি আপনার প্রভুর নিকটে আমাদের পক্ষে প্রার্থনা করুন, যাতে তিনি বলে দেন যে, গাভীটি কিরূপ হবে। কেননা একই রংয়ের সাদৃশ্যপূর্ণ গাভী অনেক রয়েছে। আল্লাহ চাহে তো এবার আমরা অবশ্যই সঠিক দিশা পেয়ে যাব’ (৭০)তিনি বললেন, আল্লাহ বলেছেন, সে গাভীটি এমন হবে, যে কখনো ভূমি কর্ষণ বা পানি সেচনের শ্রমে অভ্যস্ত নয়, সুঠামদেহী ও খুঁৎহীনতারা বলল, এতক্ষণে আপনি সঠিক তথ্য এনেছেন। অতঃপর তারা সেটা যবেহ করল। অথচ তারা (মনের থেকে) তা যবেহ করতে চাচ্ছিল না’ (বাক্বারাহ ২/৬৭-৭১)

আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর আমি বললাম, যবেহকৃত গরুর গোশতের একটি টুকরা দিয়ে মৃত ব্যক্তির লাশের গায়ে আঘাত কর। এভাবে আল্লাহ মৃতকে জীবিত করেন এবং তোমাদেরকে তাঁর নিদর্শন সমূহ প্রদর্শন করেন। যাতে তোমরা চিন্তা কর’ (বাক্বারাহ ২/৭৩)

বলা বাহুল্য, গোশতের টুকরা দিয়ে আঘাত করার সাথে সাথে মৃত লোকটি জীবিত হল এবং তার হত্যাকারী ভাতিজার নাম বলে দিয়ে পুনরায় মারা গেল। ধারণা করা চলে যে, মূসা (আঃ) সেমতে শাস্তি বিধান করেন এবং হত্যাকারী ভাতিজাকে হত্যার মাধ্যমে ক্বিছাছআদায় করেন।

 

ব্যাভিচারের অপবাদ

হযরত মুসা (আ)'র সমসাময়িক বনী ইসরাইলীদের মধ্যে কারুন নামে ধনাঢ্য ব্যাক্তি ছিল।কারুন সম্পর্কে হযরত মুসা (আ) এর চাচাতো ভাই ছিল।ইবন ইসহাক (রহ) তাকে মুসা (আ)-এর চাচা বলে মনে করেন। কিন্তু জুরাইজ (র) তা প্রত্যাখ্যান করেন ৷কাতাদা (র) বলেছেন, সুমধুর কণ্ঠে তাওরাত পাঠের জন্যে তাকে নুর বলে আখ্যায়িত করা হতো। তার কাছে প্রচুর স্বর্ণ, রৌপ্য ও হীরা ছিল। সম্পদের নেশায় সে মানুষকে, নীচ মনে করত৷ অতঃপর তার ধন সম্পদের কারণে তার দাম্ভিকতা তাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। শাহর ইবন হাওশ (র) বলেন, নিজ সম্প্রদায়ের উপর গর্ব করার উদ্দেশ্যে কারুন তার পবিধেয় কাপড়ের দৈর্ঘ এক বিঘত লম্বা করে দিয়েছিল ৷তার নিজ সম্প্রদায় বানী ইসরাইলের উপর যুলুম এই ছিল যে, সে ধন-সম্পদের আধিক্য-গর্বে তাদেরকে তুচ্ছজ্ঞান করত। আবার কেউ কেউ বলেন, সে ফেরআউনের পক্ষ থেকে বানী ইসরাইলের উপর গভর্নর নিযুক্ত ছিল এবং সে তাদের উপর অত্যাচার করত। আল্লাহ্ তাআলা কারুনের প্রচুর সম্পদের কথা কুরআনে উল্লেখ করেছেন। তার চাবিগুলো শক্তিশালী লোকদের একটি দলের জন্যে কষ্টকর বোঝা হয়ে যেতে৷কেউ কেউ বলেন, এ চাবিগুলে ছিল চামড়ার তৈরি।বলা হয়ে থাকে কারুনের সম্পদ রাখার গুদামঘরের চাবিগুলো আনা-নেয়ার জন্য ৬০টি খচ্চর ছিল। (তাফসিরে ইবনে আবি হাতেম -১১/৩৪৮; হাদিস - ১৭৮৩৭)।

হযরত মুসা (আ) তাকে তার সম্পদের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে , যাকাত দেবার জন্য বলতেন। আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে সে যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। কারুন তার সঙ্গীদের বলল দেখ, মুসার জন্য এখন আমাদের ধন-সম্পদ রাখায় দায় হয়ে পড়েছে। সে বলে কিনা মালদাররা মালের যাকাত না দিলে আল্লাহ নারাজ হবেন। সঙ্গীদের একজন বলল- গায়ে খেটে কষ্ট করে টাকা- পয়সা রোজগার করব, আবার তার থেকে বছর বছর যাকাত দিতে হবে! মুসা যতসব ঝামেলা শুরু করেছে। কারুন বলল, সত্যি বলতে কি জান? মুসা যাকাতের নাম করে আমাদের ধনে বড়লোক হতে চায়। একথা শুনে সঙ্গীরা বলে উঠে- ঠিক ঠিক। মুসার মতলব ভাল নয়। এর একটা বিহিত করতেই হবে। সঙ্গীদের একজন বলল- আমিও তাই বলতে চেয়েছিলাম।মুসার বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। আল্লাহর নবী বলে তাকে আর আশকারা দেওয়া ঠিক হবে না। আমার মতে মুসাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে ফেলাই উচিৎ। অন্যজন বলল- আমার মতে, খুন-খারাবীর দরকার নেই। এসব ঝামেলা করতে গেলে বিপদও হতে পারেতার চেয়ে জন সমাজে তাকে এমন ভাবে জব্দ করতে হবে, যাতে সে লজ্জিত হয়ে দেশ ছেড়ে চলে যায়। দ্বিতীয় সঙ্গীর কথা শুনে কারুন বলল- তোমার পরামর্শটা মন্দ নয়। এখন তুমিই এর একটা ব্যবস্থা করবে- কিভাবে মুসা কে জব্দ করা যায় এবং দেশ ছাড়া করা যায় সেই বুদ্ধি খাটাও। কারুনের অভয় পেয়ে সঙ্গীটি একটি অসৎ চরিত্রের মহিলাকে লোভ দেখিয়ে ডেকে নিয়ে এল। তাকে অনেক গহনা ও অর্থ দিয়ে বলল, "ধনকুবের কারুনের জন্য তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। মুসা যখন সভায় ওয়াজ-নসীহত করতে উঠবে, তখন আমরা তাকে চরিত্রহীন বলে ঠাট্টা বিদ্রুপ করব। সে সময় তুমি বলবে- হ্যাঁ, একথা সত্য। ব্যস, শুধু এতটুকু বললেই কাজ সমাধা হয়ে যাবে। এর জন্য দরকার হলে তুমি আরো অর্থ পাবে। মহিলাটি চুপ করে রইল। তারঃপর অনেক বলে কয়ে রাজী করালো। এদিকে কারুন ভাবল-মহিলাটি যদি প্রকাশ্যে মুসার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে , তাহলে সেই অপরাধের জন্য সমাজ তাকে ঘৃণা বরে পরিত্যাগ করবে। আর এর জন্য ক্ষোভে মুসা এদেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হবে। তখন আমাদের উদ্দেশ্যে সফল হবে।

একদিন ওয়াজ-নসীহতের সভা বসল। দলে দলে লোকজন এল হযরত মুসা (আ)-এর ওয়াজ- নসীহত শোনার জন্য জন্য। কারুনও তার দলবল নিয়ে এল। সভাস্থল কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল। হযরত মুসা (আ) ওয়াজ করার জন্য মঞ্চে উঠলেন। তিনি ওয়াজ শুরু করতে যাবেন, ঠিক এমন সময় পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মিথ্যাবাদী কারুনের লোকজন বলে উঠল- হে মুসা! তুমি চরিত্রহীন। উপস্থিত জনতা কে তারা বলল- আমাদের কথা বিশ্বাস না হয়, এই মহিলাকে জিজ্ঞেস করুন। এই বলে কারুন মেয়ে মহিলাকে দাঁড় করিয়ে দিল। একথা শুনে লোকজন তাজ্জব হয়ে গেল। মুসা (আ) চরিত্রহীন, এটা কি বিশ্বাস যোগ্য কথা? এ বিষয়টি নিয়ে সভাস্থলে নানা গুঞ্জনের শুরু হয়ে গেল। সবাই মহিলাটির কথা শুনার জন্য তার দিকে দৃষ্টি দিয়ে রইল। হযরত মুসা (আ) মহিলাটিকে বললেন, - "আমার বিরুদ্ধে কি নালিশ আছে- বলো! তবে যা বলবে , আল্লাহকে ভয় করে বলবে। মনে রেখ আল্লাহ সবকিছু দেখেন এবং শুনেন।" হযরত মুসা (আ)-এর কথায় মহিলাটির অন্তর কেঁপে উঠল। ফলে কারুন তাকে যে কথা শিখিয়ে দিয়েছিল, আল্লাহ পাকের ভয়ে সে তা ভুলে গেল এবং তার মুখ দিয়ে আল্লাহর কুদরতে একথা বের হল- "ভাইসব! আপনারা মন দিয়ে শুনুন, কারুন আমাকে লোভ দেখিয়ে নবী মুসা (আ)-এর বিরুদ্ধে কৎসিত কথা বলতে বলেছিল।" একথা বলে মহিলাটি কারুনের দেয়া গহনা খুলে ফেলে সভা থেকে চলে গেল। হযরত মুসা (আ) কারুনের এহেন জঘন্য ষড়যন্ত্রে ভীষণ কষ্ট পেলেন। আল্লাহ পাক তাঁকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করায় তিনি দয়াময়ের উদ্দেশ্যে সিজদা করলেন , অতঃপর দু'রাকাআ'ত শুকরিয়া নামায আদায় করেন। এরপর আল্লাহর দরবারে করজোড়ে ফরিয়াদ জানালেন-"হে পরওয়ার দেগার! জালিম ধনপতি কারুন থেকে আমাদেরকে রক্ষা কর। এই পাপী দুনিয়ার ধন-সম্পদের মোহে পড়ে আপনার উপর ঈমান হারিয়েছেআপনার হুকুম -আহকাম সে মানে না। তার খপপরে পড়ে রাজ্যের অন্যরাও বেদ্বীন ও বেঈমান হয়ে যাচ্ছে। তাই আমার একান্ত ফরিয়াদ-পাপাত্মা কারুন থেকে আমাদেরকে হেফাজত করুন।" দয়াময় আল্লাহ তাঁর প্রিয় নবির ফরিয়াদ মঞ্জুর করে ফেরেশতা জিব্রাঈলকে হযরত মুসা (আ)-এর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। জিব্রাঈল হযরত মুসা (আ)-কে বললেন, হে আল্লাহুর নবী ! আল্লাহ পাক আপনার ফরিয়াদ মঞ্জুর করেছেন। এই যমীন কারুনকে ধ্বংস করার হুকুম পালন করবে। জিব্রাঈলের মুখে আল্লাহর বাণী শুনে মুসা (আ) তাঁর কওমের লোকদের ডেকে বললেন, -"তোমরা শোন, আল্লাহ পাক ফেরাউন কে যে ভাবে ধ্বংস করেছেন। পাপী কারুনকেও সেই ভাবে ধ্বংস করবেন। সুতরাং বনী ইসরাইলের মধ্যে যারা আমার অনুসারী, তারা বেদ্বীন কারুনের দল থেকে ফিরে আসবে।"হযরত মুসা (আ)-এর অনুসারীরা তাঁর কথা মত বেদ্বীনের সংগ ত্যাগ করল। এর পর হযরত মুসা (আ)-এর আরজীতে আল্লাহ তাআলার হুকুমে যমীন কারুনের হাঁটু পর্যন্ত গ্রাস করে ফেলল। তখন কারুন ব্যাপারটিকে নিছক রসিকতা ভেবে হেসে ফেলল এবং বলল- হে মুসা! এটাতো দেখছি তোমার নতুন যাদু। এ যাদু তোমাকে কে শিখিয়েছে? হযরত মুসা (আ) তার কথার কোন জবাব দিলেন না। অতঃপর তাঁর আরজীতে আল্লাহুর হুকুমে যমীন এবার কারুনের জানু থেকে কোমর পর্যন্ত গ্রাস করল। কারন তখন নিজের বিপদ বুঝতে পারল। ব্যাপারটা খেলা নয় ভেবে, সে সুর পাল্টে বলল-মুসা! তুমি কি ঠাট্টা বুঝ না।তোমার যাদুর খেলা বন্ধ কর। এখন থেকে আমি তোমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করবোহযরত মুসা (আ) এবারও তার কথার কোন জবাব দিলেন না। আল্লাহর হুকুমে পাপের প্রায়শ্চিত তাকে অবশ্যই ভোগ করতে হবে। অতঃপর হযরত মুসা (আ)-এর আরজীতে আল্লাহর হুকুমে জমিন কারুনের বুক পর্যন্ত গ্রাস করল। নাদান কারুন এত দিনে তার ভুল বুঝতে পারল। সে বুঝল মুসা সত্যি, আল্লাহর নবী। তাঁর নসীহত না শুনে সত্যি সে অনেক বড় ভুল করেছে। মরণ যন্ত্রনায় সে চিৎকার করে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে কারুন বলতে লাগল, ভাই মুসা! আমার অপরাধ ক্ষমা করো। আমি না বুঝে তোমার উপর যুলুম করেছি। আমার ধন-দৌলত সব তুমি নাও। শুধু আমাকে প্রাণে বাঁচাও। কিন্তু কাঁদলে কি হবে, সময় ফুরিয়ে আল্লাহর হুকুম যখন এসে যায়, তখন আর কোন সুযোগ থাকে না।।আল্লাহ বলেন, অতঃপর আমি কারুন ও তার প্রাসাদকে মাটিতে দাবিয়ে দিলাম। তখন তার জন্য এমন কোনো দল ছিল না, যে আল্লাহর মোকাবিলায় তাকে সাহায্য করতে পারত এবং সে নিজেও নিজেকে সাহায্য করতে সক্ষম ছিল না।' (সূরা কাসাস আয়াত-৮১)।কাতাদা (র) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন কারুন ও তার সম্প্রদায় কিয়ামত পর্যন্ত প্রতিদিন একটি মানব দেহের পরিমাণ তলিয়ে যেতে থাকবে৷ আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, সপ্ত জমিন পর্যন্ত ভুমি তাদেরকে ভুগর্ভস্থ করেছিল ৷

হজরত দাউদ (আ.)

হজরত  দাউদ বাইবেলে যাকে ডেভিড নামে অভিহিত করা হয়েছে। বাইবেলের পুরানো নিয়মে (ওল্ড টেস্টামেন্ট) দাউদ (.) কে বলা হয়েছে সেন্ট লুইস ডেভিড।বাইবেলের বর্ণনা অনুসারে, তিনি ছিলেন একজন ইসরায়েল রাজতন্ত্রের দ্বিতীয় রাজা এবং বাইবেলের নূতন নিয়ম অনুসারে গালাতীয়দের প্রতি পত্র ও লূকলিখিত সুসমাচার মতে যীশুর পুর্বপুরুষ ইয়াকুবের পুত্র, ইয়াহুদার অধস্তন বংশধর । তার পিতার নাম জেসি।তার পিতামাতার অনেক পুত্র সন্তানের মধ্যে দাউদ ছিলেন পিতার কনিষ্ঠ সন্তান।বাইবেলের বিবরণে, ডেভিড একজন অল্প বয়সী মেষপালক ছিলেন, যিনি প্রথম একজন সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন এবং গলিয়াত দ্বারা মৃত্যুবরণ করেন। ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রথম রাজা ছিলেন তালুত, যাকে বাইবেলে বলে সল ( Saul)দাউদ রাজা সল প্রিয় ছিলেন এবং সলের ছেলে যোনাথনের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন। 

আল্লাহ বলেন, আর তোমাদের মধ্যে যারা শনিবার সীমালংঘন করেছিল তাদেরকে তোমরা নিশ্চিতভাবে জেনেছিলে । ফলে আমরা তাদেরকে বলেছিলাম, তোমরা ঘৃণিত বানরে পরিণত হও।(সুরা বাকারাহ,আয়াত-৬৫)। আয়াতে বর্ণিত এ ঘটনাটি দাউদ আলাইহিস সালাম-এর আমলেই সংঘটিত হয়। বানরে রুপান্তরিত এলাকা বা বস্তি বা জনপদের নাম ছিল 'আইলাহ'ওটা কূলযূম সাগরের (লোহিত সাগর) তীরে অবস্থিত ছিল।মুহাম্মদ ইবনে ইসাহাক, দাউদ ইবনূল হুসাইন (রহ) থেকে এবং তিনি ইকরিমাহ (রহ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে,সূরা বাকারাহ আয়াত ৬৫ এবং সূরা আরাফ আয়াত ১৬০-১৬৭ আয়াতসমূহে নদী বা সমুদ্রের তীরবর্তী যে জনপদের কথা বলা হয়েছে সেই বিষয়ে হযরত ইবনে আব্বাস (রা)-এর বর্ণনানুযায়ী সেই জনপদের নাম ছিল আইলাহ যাহা মাদায়েন ও তূরের (সিনাইয়ে অবস্থিত) মাঝখানে অবস্থিত ছিল।

ইসরাঈল-বংশধরদের জন্য শনিবার ছিল পবিত্র এবং সাপ্তাহিক উপাসনার জন্য নির্ধারিত দিন।হযরত দাউদ (আ.) প্রতি শনিবার আল্লাহর কিতাব জবুর পাঠ করতেন, ওই সময় সমুদ্রের মাছও কিনারে এসে তাঁর তেলাওয়াত শুনত।এ দিন মাছ শিকার নিষিদ্ধ ছিল। ইবনে আব্বাস (রা) হতে বর্নিত,'শনিবার দিন ঐ মাছগুলো স্বাধীনভাবে পানির উপর ভেসে উঠতো এবং কিনারায় ছড়িয়ে পড়তো। কিন্তু শনিবার ছাড়া অন্য কোন দিন নদীর তীরে কখনোই আসতো না।' ইহুদিরা সমুদ্রোপকূলের অধিবাসী ছিল বলে মাছ শিকার ছিল তাদের প্রিয় কাজ। তাফসীরে কুরতুবীতে বলা হয়েছে যে, ইহুদীরা প্রথমে গোপনে ও বিভিন্ন কৌশলে এবং পরে ব্যাপকভাবে নিষিদ্ধ দিনে মৎস্য শিকার করতে থাকে। এতে তারা দুই দলে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল ছিল সৎ ও বিজ্ঞ লোকদের। তারা এ অপকর্মে বাধা দিলেন। কিন্তু প্রতিপক্ষ বিরত হলো না। অবশেষে তারা এদের সাথে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করে পৃথক হয়ে গেলেন। এমনকি বাসস্থানও দুই ভাগে ভাগ করে নিলেন। একভাগে অবাধ্যরা বসবাস করতো আর অপর ভাগে সৎ ও বিজ্ঞজনেরা বাস করতেন। অবাধ্য ইহুদিরা ওই সময় মাছগুলো ধরে নিত। আল্লাহর পক্ষ থেকে ওই দিন মাছ ধরা নিষিদ্ধ হলে তারা আল্লাহর বিধানেও তাদের কূটবুদ্ধির অবতারণা করে, তারা শনিবার মাছ ঘেরাও করে রেখে রবিবার তা ধরত।সৎ ও বিজ্ঞজনেরা একদিন অবাধ্যদের বস্তিতে অস্বাভাবিক নীরবতা লক্ষ্য করলেন।অতঃপর সেখানে পৌছে দেখলেন যে, সবাই বিকৃত হয়ে বানরে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। তিন দিনের মাথায় ওই বানরের দল সব মারা যায়। সূরা আরাফের ১৬৪-৬৫ আয়াতের বর্ণনায় প্রতীয়মান হয় যে, সেখানে তৃতীয় আরেকটি দল ছিল, যারা উপদেশ দানকারীদের উপদেশ দানে বিরত রাখার চেষ্টা করত। বাহ্যত এরা ছিল শান্তিবাদী , অলস এবং সুবিধাবাদী। এরাও ফাসেকদের সাথে শূকর-বানরে পরিণত হয় ও ধ্বংস হয়ে যায়।

আর যখন তাদের মধ্যে থেকে এক সম্প্রদায় বলল, কেন সে লোকদের সদুপদেশ দিচ্ছেন, যাদেরকে আল্লাহ ধ্বংস করে দিতে চান কিংবা আযাব দিতে চান কঠিন আযাব? সে বললঃ তোমাদের পালনকর্তার সামনে দোষ ফুরাবার জন্য এবং এজন্য যেন তারা ভীত হয়।। তারপর যখন তারা এগিয়ে যেতে লাগল সে কর্মে যা থেকে তাদের বারণ করা হয়েছিল, তখন আমি নির্দেশ দিলাম যে, তোমরা লাঞ্ছিত বানর হয়ে যাও।(সরা আরাফ আয়াত- ১৬৪-১৬৫)।মহান আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বনি ইসরাঈলীদের মাছ শিকারের ঘটনাটিকে- মহান আল্লাহ মদিনার ইহুদীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন , " তোমরা তাদেরকে ভালরূপে জেনেছ, যারা শনিবারের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করেছিল। আমি বলেছিলাম: তোমরা লাঞ্ছিত বানর হয়ে যাও। অতঃপর আমি এ ঘটনাকে তাদের সমসাময়িক ও পরবর্তীদের জন্য দৃষ্টান্ত এবং আল্লাহভীরুদের জন্য উপদেশ গ্রহণের উপাদান করে দিয়েছি।" (সুরা বাকারাহ আয়াত৬৫-৬৬)।হযরত কাতাদাহ বলেন, অবাধ্যদের যুবকরা বানরের আর বৃদ্ধরা শুকরের পরিণত হয়ে গেছে। রূপান্তরিত বানররা তাদের নিজ নিজ আত্মীয় স্বজনদের চিনত এবং তাদের কাছে এসে অঝোরে অশ্রু বিসর্জন করতো। (কুরতুবী, মারেফুল কুরআন, জালালাইন)।হাদিসে এসেছে, জনৈক সাহাবী একবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের যুগের বানর ও শুকরগুলো কি সেই রূপান্তরিত ইয়াহুদী সম্প্রদায়? তিনি বললেন, আল্লাহ্ তা'আলা যখন কোন সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেন অথবা তাদেরকে শাস্তি দিয়ে থাকেন তখন তিনি তাদের অবশিষ্ট বংশধর রাখেন না। বস্তুতঃ বানর ও শূকর পৃথিবীতে তাদের পূর্বেও ছিল। (মুসলিম- ২৬৬৩)সুতরাং বর্তমান বানরদের সাথে রূপান্তরিত বানর ও শূকরের কোন সম্পর্ক নেই। যেমনিভাবে এ ধারণা করারও কোন সুযোগ নেই যে, মানুষ কোন এক সময় বানরের বংশধর ছিল।

শনিবারের দিন ইহুদীদেরকে মাছ ধরতে এবং অন্যান্য যে কোনও পার্থিব কাজ করতে নিষেধ করা হয়েছিল। কিন্তু তারা একটি বাহানা বানিয়ে আল্লাহর নির্দেশকে লঙ্ঘন করল। শনিবারের দিন (পরীক্ষা স্বরূপ) মাছ সংখ্যায় অনেক বেশী আসত। তারা খাল কেটে নিল, তাতে মাছগুলো আটকা পড়ে যেত এবং পরদিন রবিবারে সেগুলো ধরে নিত। শনিবারের ব্যাপারে ইহুদিরা সীমা লংঘন করেছিল- যার জন্য মহান আল্লাহ রাসুল (সাঃ)-এর যূগের ইহুদিদেরকে পূর্ববর্তী ইহুদিদের ঘটনা জানিয়ে দেওয়ার জন্যই কুরআনুল কারীমে সুরা বাকারাহঃ ৬৫ এবং সূরা আরাফ,১৬০-১৬৭ আয়াতসমূহে ইহুদিদের অবাধ্যতা এবং তাদের উপর আযাবের কথা বলা হয়েছে।অবাধ্যদের জন্য এ আয়াতটি অবাধ্যতা থেকে তাওবা করে ফিরে আসার উপকরণ স্বরূপ।আনুগত্যদের জন্য এ আয়াত আনুগত্যের উপর অটল থাকার জন্য উপদেশপ্রদ ঘটনা।রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন, ইহুদিরা যা করেছিল তোমরা তা করো না। ফন্দি করে হারামকে (অবৈধ) হালালরূপে (বৈধ) গ্রহণ করো না। অর্থাৎ শরীয়তের নির্দেশাবলীর (আল্লাহর হুকুমের) ক্ষেত্রে ফন্দি ও কৌশল হতে বেঁচে থাকো।

হজরত সুলাইমান (আ.)

সুলাইমান (.) হজতর দাউদ আলাইহিস সালামের ১৯ সন্তানের মধ্যে একজন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনের প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে নবুয়ত লাভ করেন আল্লাহ তাআলা তাঁকে প্রজ্ঞা, জ্ঞান নবুয়ত দান করেন তিনি শাম ইরাক অঞ্চলে তাঁর পিতার রেখে যাওয়া রাজ্যের বাদশাহি লাভ করেনহজরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম পিতার মৃত্যুর পর শৈশবেই মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি রাজত্বের দায়ভার গ্রহণ করেন রাজত্ব লাভের চতুর্থ বৎসর হতে তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস নির্মাণ কাজ শুরু করেন তিনি ৫৩ বছরের দুনিয়ার জিন্দেগিতে ৪০ বছর যাবত রাজ্য পরিচালনা করেন তবে কত বৎসর বয়সে তিনি নবুয়ত লাভ করেছিলেন, তা সঠিক জানা যায়নি শাম ইরাক অঞ্চলে পিতার রেখে যাওয়া রাজ্যের তিনি বাদশাহ ছিলেন তাঁর রাজ্য তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে সুখী শক্তিশালী রাজ্য ছিল কুরআনে তাঁর সম্পর্কে ৭টি সূরায় ৫১টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে

হারূত মারূত ফেরেশতাদ্বয়ের কাহিনী

আসাদুল্লাহ বলেন,

সুলায়মান (আঃ)-এর রাজত্বকালে বেঈমান জিনেরা লোকদের ধোঁকা দিত এই বলে যে, সুলায়মান জাদুর জোরে সবকিছু করেন। তিনি কোন নবী নন। শয়তানদের ভেল্কিবাজিতে বহু লোক বিভ্রান্ত হচ্ছিল। এমনকি শেষনবী (ছাঃ)-এর সময়েও যখন তিনি সুলায়মান (আঃ)-এর প্রশংসা করেন, তখন ইহুদী নেতারা বলেছিল, আশ্চর্যের বিষয় যে, মুহাম্মাদ সুলায়মানকে নবীদের মধ্যে শামিল করে হক ও বাতিলের মধ্যে সংমিশ্রণ ঘটাচ্ছেন। অথচ তিনি ছিলেন একজন জাদুকর মাত্র। কেননা স্বাভাবিকভাবে কোন মানুষ কি বায়ুর পিঠে সওয়ার হয়ে চলতে পারে(ইবনু জারীর)

এক্ষণে সুলায়মান (আঃ) যে সত্য নবী, তিনি যে জাদুকর নন, জনগণকে সেটা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য এবং নবীগণের মুজেযা ও শয়তানদের জাদুর মধ্যে পার্থক্য বুঝাবার জন্য আল্লাহ পাক হারূত ও মারূত নামে দুজন ফেরেশতাকে বাবেলশহরে মানুষের বেশে পাঠিয়ে দেন। বাবেলল ইরাকের একটি প্রাচীন নগরী, যা ঐসময় জাদু বিদ্যার কেন্দ্র ছিল। ফেরেশতাদ্বয় সেখানে এসে জাদুর স্বরূপ ও ভেল্কিবাজি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে থাকেন এবং জাদুকরদের অনুসরণ থেকে বিরত হয়ে যেন সবাই সুলায়মানের নবুঅতের অনুসারী হয়, সেকথা বলতে লাগলেন।

জাদু ও মুজেযার পার্থক্য এই যে, জাদু প্রাকৃতিক কারণের অধীন। কারণ ব্যতীত জাদু সংঘটিত হয় না। কিন্তু দর্শক সে কারণ সম্পর্কে অবহিত থাকে না বলেই তাতে বিভ্রান্ত হয়। এমনকি কুফরীতে লিপ্ত হয় এবং ঐ জাদুকরকেই সকল ক্ষমতার মালিক বলে ধারণা করতে থাকে। আজকের যুগে ভিডিও চিত্রসহ হাযার মাইল দূরের ভাষণ ঘরে বসে শুনে এবং দেখে যেকোন অজ্ঞ লোকের পক্ষে নিঃসন্দেহে বিভ্রান্তিতে পড়া স্বাভাবিক। তেমনি সেযুগেও জাদুকরদের বিভিন্ন অলৌকিক বস্ত্ত দেখে অজ্ঞ মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়ত।

পক্ষান্তরে মুজেযা কোন প্রাকৃতিক কারণের অধীন নয়। বরং তা সরাসরি আল্লাহর নির্দেশে সম্পাদিত হয়। নবী ব্যতীত আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের প্রতি তাঁর কারামতবা সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টিও একইভাবে সম্পাদিত হয়। এতে প্রাকৃতিক কারণের যেমন কোন সম্পৃক্ততা নেই, তেমনি সম্মানিত ব্যক্তির নিজস্ব কোন ক্ষমতা বা হাত নেই। উভয় বস্ত্তর পার্থক্য বুঝার সহজ উপায় এই যে, মুজেযা কেবল নবীগণের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। যারা আল্লাহভীতি, উন্নত চরিত্র মাধুর্য এবং পবিত্র জীবন যাপন সহ সকল মানবিক গুণে সর্বকালে সকলের আদর্শ স্থানীয় হন।

আর নবী ও অলীগণের মধ্যে পার্থক্য এই যে, নবীগণ প্রকাশ্যে নবুঅতের দাবী করে থাকেন। কিন্তু অলীগণ কখনোই নিজেকে অলী বলে দাবী করেন না। অলীগণ সাধারণভাবে নেককার মানুষ। কিন্তু নবীগণ আল্লাহর বিশেষভাবে নির্বাচিত বান্দা, যাদেরকে তিনি নবুঅতের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করে থাকেন। নবীগণের মুজেযা প্রকাশে তাদের নিজস্ব কোন ক্ষমতা বা কৃতিত্ব নেই। পক্ষান্তরে দুষ্ট লোকেরাই জাদুবিদ্যা শিখে ও তার মাধ্যমে নিজেদের দুনিয়া হাছিল করে থাকে। উভয়ের চরিত্র জনগণের মাঝে পরিষ্কারভাবে পার্থক্য সৃষ্টি করে।

বস্ত্ততঃ সুলায়মান (আঃ)-এর নবুঅতের সমর্থনেই আল্লাহ তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে হারূত ও মারূত ফেরেশতাদ্বয়কে বাবেল শহরে পাঠিয়ে ছিলেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

‘(ইহুদী-নাছারাগণ) সবের অনুসরণ করে থাকে, যা সুলায়মানের রাজত্বকালে শয়তানরা আবৃত্তি করত অথচ সুলায়মান কুফরী করেননি, বরং শয়তানরাই কুফরী করেছিল তারা মানুষকে জাদু বিদ্যা শিক্ষা দিত এবং বাবেল শহরে হারূত মারূত দুই ফেরেশতার উপরে যা নাযিল হয়েছিল, তা শিক্ষা দিত বস্ত্ততঃ তারা (হারূত-মারূত) উভয়ে একথা না বলে কাউকে শিক্ষা দিত না যে, আমরা এসেছি পরীক্ষা স্বরূপ কাজেই তুমি (জাদু শিখে) কাফির হয়ো না কিন্তু তারা তাদের কাছ থেকে এমন জাদু শিখত, যার দ্বারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে অথচ আল্লাহর আদেশ ব্যতীত তদ্বারা তারা কারু ক্ষতি করতে পারত না লোকেরা তাদের কাছে শিখত ঐসব বস্ত্ত যা তাদের ক্ষতি করে এবং তাদের কোন উপকার করে না তারা ভালভাবেই জানে যে, যে কেউ জাদু অবলম্বন করবে, তার জন্য আখেরাতে কোন অংশ নেই যার বিনিময়ে তারা আত্মবিক্রয় করেছে, তা খুবই মন্দ, যদি তারা জানতোযদি তারা ঈমান আনত আল্লাহভীরু , তবে আল্লাহর কাছ থেকে উত্তম প্রতিদান পেত, যদি তারা জানত’ (বাক্বারাহ /১০২-১০৩) (  আসাদুল্লাহ)

সুলায়মানের আংটি চুরি রাজত্ব হরণ

এবং সুলায়মানের রাজত্বে শয়তানগণ যা আবৃত্তি করত, তারা (ইহুদীরা) তার অনুসরণ করত  (সুরা বাক্বারাহ ১০২)

সুলায়মান (আঃ)-এর অতুলনীয় সাম্রাজ্যে ঈর্ষান্বিত শয়তানেরা সর্বত্র রটিয়ে দেয় যে, জিন-ইনসান পশু-পক্ষী সবার উপরে সুলায়মানের একাধিপত্যের মূল কারণ তাঁর পঠিত কিছু কালেমা, যার কিছু কিছু আমরা জানি যারা এগুলি শিখবে তার উপরে আমল করবে, তারাও অনুরূপ ক্ষমতা অর্জন করতে পারবে তখন লোকেরা ঐসব জাদু বিদ্যা শিখতে ঝুঁকে পড়ল তাদের অনুসারী এবং কুফরী করতে শুরু করল বর্ণিত আয়াতে এর প্রতিবাদ করা হয়েছে এবং সুলায়মান (আঃ)-এর নির্দোষিতা ঘোষণা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, সুলায়মান জাদুর বলে নয়, বরং আল্লাহর দেওয়া ক্ষমতা বলে দেশ শাসন করেন মূল কথা , ইহুদীরা সকল নবীকে গালি দিয়েছে এবং সেভাবে সুলায়মান (আঃ)-কেও তোহমত দিয়েছে

ইহুদি জাতি হজরত সুলাইমান (আ.)-এর ওফাতের পর পারস্পরিক বিভক্তি এবং ধর্মদ্রোহিতা ও কুকর্মের পথ অবলম্বন করে। কোনো কোনো নবী এসে আল্লাহর নির্দেশে ইহুদিদের এ ধরনের কার্যকলাপের শোচনীয় পরিণাম সম্পর্কে সতর্কবাণী শোনালেও তারা তাঁর কথা না মেনে উল্টো নবীর সঙ্গে বিদ্রোহ করে। তখন আল্লাহর গজব হিসেবে তাদের ওপর মিসরের জনৈক সম্রাট চড়াও হয়ে ব্যাপক হত্যা ও লুণ্ঠন চালায়।

 

 

 

 

হজরত ইলিয়াস  (আ.)

 

 

 

জাকারিয়া হজরত ইয়াহইয়া  (আ.)

যাকারিয়া ইয়াহইয়া সুলায়মান পরবর্তী দুই নবী পরস্পরে পিতা-পুত্র ছিলেন এবং বায়তুল মুক্বাদ্দাসের অধিবাসী ছিলেন ইয়াহইয়া ছিলেন পরবর্তী নবী ঈসা (আঃ)-এর আপন খালাতো ভাই এবং বয়সে ছয় মাসের বড়হযরত যাকারিয়া ইয়াহ্ইয়া (আঃ) সম্পর্কে ৪টি সূরার ২২টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে তন্মধ্যে সূরা আনআমে কেবল ১৮জন নবীর নামের তালিকায় তাঁদের নাম উল্লেখিত হয়েছে বাকী অন্য সূরাগুলিতে খুবই সংক্ষেপে কেবল ইয়াহ্ইয়ার জন্ম বৃত্তান্ত সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে হজরত ইয়াহইয়া (আ.) ইহুদিদের অশ্লীল কার্যকলাপের বিরোধিতা করলে তারা তাঁকে দ্বিখণ্ডিত করে কতল করে।

হজরত মরিয়ম (আ.)-কে নিয়ে ইহুদিদের অপবাদ ও মিথ্যাচার

এবং তারা তাদের অবিশ্বাসের জন্য ও মারয়্যামের প্রতি জঘন্য অপবাদ আরোপ করার জন্য (অভিশপ্ত হয়েছিল) (সুরা নিসা- ১৫৬)

আয়াতের ব্যাখ্যায় হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, 'ইহুদিরা হজরত মরিয়ম (আ.)-এর বিরুদ্ধে ব্যভিচারের মিথ্যা অভিযোগ তুলেছিল। আয়াতের স্বাভাবিক ব্যাখ্যা হলো, তারা হজরত মরিয়ম (আ.)-কে ব্যভিচারিণী ও তাঁর পুত্র হজরত ঈসা (আ.)-কে জারজ সন্তান বলে আখ্যায়িত করেছিল। তাদের কেউ কেউ আবার এও বলেছিল যে মরিয়ম (আ.) স্রাব নির্গমনরত অবস্থায় ব্যভিচার করেছিল। (নাউজুবিল্লাহ)। - ইবনে কাছির

খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে ইহুদিদের ষড়যন্ত্র

হজরত ঈসা (আ.) তাদের বিরাগভাজন হন, তাদের ক্রোধের আগুনে পড়ে মিথ্যা মামলার আসামি হয়ে ফাঁসির আদেশপ্রাপ্ত হন। কিন্তু আল্লাহ নিজ মহিমায় হজরত ঈসা (আ.)-কে তাদের হাত থেকে রক্ষা করে আসমানে উঠিয়ে নেন।

 হযরত ঈসা (আঃ) ছিলেন বনু ইস্রাঈল বংশের সর্বশেষ নবী কিতাবধারী রাসূল তিনিইনজীলপ্রাপ্ত হয়েছিলেন তাঁরপর থেকে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আবির্ভাব পর্যন্ত আর কোন নবী আগমন করেননি ঈসা (.) খ্রিস্টধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বাইবেলের নতুন নিয়মে যিশু নামে পরিচিত। মূসা (আঃ)-এর অনুসারী হওয়ার দাবীদার ইহুদীরা তাঁকে নবী বলেই স্বীকার করেনি অত্যন্ত লজ্জাষ্করভাবে তারা তাঁকে জনৈক ইউসুফ মিস্ত্রীর জারজ সন্তান বলে আখ্যায়িত করেছে (নাঊযুবিল্লাহ) অন্যদিকে ঈসা (আঃ)-এর ভক্ত অনুসারী হবার দাবীদার খৃষ্টানরা বাড়াবাড়ি করে তাঁকেআল্লাহর পুত্র’ (তওবাহ /৩০) বানিয়েছে হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের মোট ১৫টি সূরায় ৯৮টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে

 

ইসলাম ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী ঈসা (.)-কে আল্লাহ পাক আসমানে তুলে নেন।হাদিসমতে, ঈসা (.) চতুর্থ আসমানে রয়েছেন। কিয়ামতের পূর্বে তিনি দুনিয়ায় আসবেন হযরত মুহাম্মাদ (সা.)–এর উম্মত হয়ে, অতঃপর তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করবেন এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.)–এর রওজার পাশেই তাঁর দাফন হবে।ইহুদিরা ঈসা (.)-কে হত্যাও করতে পারেনি, শুলেও চড়াতে পারেনি, আসলে ওরা সন্দেহে পতিত হয়েছিল। কিন্তু তাদের সন্দেহ কি ছিল এ ব্যাপারে বিভিন্ন বর্ণনা এসেছে, সব বর্ণনার সার কথা হচ্ছে, ইহুদিরা যখন ঈসা (.)-কে হত্যা করতে বদ্ধপরিকর হলো, তখন তার ভক্ত সাথীরা এক স্থানে সমবেত হলেন। যাদের সংখ্যা ১২ অথবা ১৭ জন ছিল। ঈসা (.)-ও সেখানে উপস্থিত হলেন। তখন চার হাজার ইয়াহুদী দূরাচার একযোগে গৃহ অবরোধ করলো। এমতাবস্থায় ঈসা (.)-স্বীয় ভক্ত অনুচরগণকে সম্বোধন করে বললেন, তোমাদের মধ্য থেকে কেউ এই ঘর থেকে বের হতে ও নিহত হতে এবং আখেরাতে জান্নাতে আমার সাথী হতে প্রস্তুত আছো কি? জনৈক নিজের জীবন উৎসর্গের জন্য উঠে দাঁড়ালেন। ঈসা (.)-নিজের জামা ও পাগড়ী তাকে পরিধান করালেন। অতঃপর তাকে ঈসা (.)-এর সাদৃশ করে দেয়া হলো। ঈসা (.)-কে আল্লাহর নির্দেশে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হল। এরপর ইহুদিরা এসে ঐ যুবককে নিয়ে গেল এবং ক্রুসবিদ্ধ করল, যাঁকে মহান আল্লাহ ঈসা (.)-এর মত আকৃতি দান করেছিলেন। আর ইহুদিদের ধারণা হল যে, তারা ঈসাকেই ক্রুসবিদ্ধ করতে কৃতকার্য ও সক্ষম হয়েছে। অথচ তিনি ঐ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন না; বরং তাঁকে জীবিত অবস্থায় সশরীরে নিরাপদে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। (ফাতহুল ক্বাদীর, ইবনে কাসীর)

তৎকালীন রোম সম্রাট ছাতিয়ূনুস-এর নির্দেশে (মাযহারী) ঈসা (আঃ)-কে গ্রেফতারের জন্য সরকারী বাহিনী ইহুদী চক্রান্তকারীরা তাঁর বাড়ী ঘেরাও করে তারা জনৈক নরাধমকে ঈসা (আঃ)-কে হত্যা করার জন্য পাঠায় কিন্তু ইতিপূর্বে আল্লাহ ঈসা (আঃ)-কে উঠিয়ে নেওয়ায় সে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যায় কিন্তু এরি মধ্যে আল্লাহর হুকুমে তার চেহারা ঈসা (আঃ)-এর সদৃশ হয়ে যায় ফলে ইহুদীরা তাকেই ঈসা ভেবে শূলে বিদ্ধ করে হত্যা করে

ঈসা (.)-এর মত আকৃতিবিশিষ্ট লোকটিকে হত্যা করার পর ইহুদিদের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়, একদল বলে, ঈসাকে হত্যা করা হয়েছে। অন্য একদল বলে, ক্রুসবিদ্ধ ব্যক্তি ঈসা নয়, বরং অন্য কোন ব্যক্তি। এরা ঈসা (.)-কে হত্যা ও ক্রুসবিদ্ধ করার কথা অস্বীকার করে। আবার অন্য একদল বলে, তারা ঈসা (.)-কে আসমানে চড়তে স্বচক্ষে দেখেছে। কিছু মুফাসসির বলেন, উক্ত মতভেদ থেকে উদ্দেশ্য হল, স্বয়ং নাসারাদের নাস্তরিয়া নামক একটি ফির্কা বলে যে, ঈসা (.)-কে তাঁর মানবিক দেহ হিসাবে ক্রুসবিদ্ধ করা হয়েছে; কিন্তু ঈশ্বর হিসাবে নয়। আবার মালকানিয়া নামক একটি ফির্কা বলে, মানবিক ও ঐশ্বরিক উভয়ভাবেই তাঁকে হত্যা ও ক্রুসবিদ্ধ করা হয়েছে। (ফাতহুল ক্বাদীর) যাই হোক তারা মতবিরোধ, সংশয় ও সন্দেহের শিকার। আল্লাহ বলেন, আর আমরা আল্লাহর রাসূল মারইয়াম তনয় ঈসা মসীহকে হত্যা করেছিতাদের এ উক্তির জন্য। অথচ তারা তাকে হত্যা করেনি এবং ক্রুশবিদ্ধও করেনি; বরং তাদের জন্য (এক লোককে) তার সদৃশ করা হয়েছিল।আর নিশ্চয় যারা তার সম্বন্ধে মতভেদ করেছিল, তারা অবশ্যই এ সম্বন্ধে সংশয়যুক্ত ছিল; এ সম্পর্কে অনুমানের অনুসরণ ছাড়া তাদের কোন জ্ঞানই ছিল না। আর এটা নিশ্চিত যে, তারা তাকে হত্যা করেনি, (সুরা নিসা আয়াত -১৫৭)অন্য এক বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, ইয়াহুদীরা এক লোককে ঈসা আলাইহিস সালাম-কে হত্যা করার জন্য পাঠিয়েছিল। কিন্তু ইতোপূর্বে আল্লাহ্ তায়ালা তাকে আকাশে তুলে নেয়ায় সে তার নাগাল পেল না। বরং ইতোমধ্যে তার নিজের চেহারা ঈসা (.)-এর মত হয়ে গেল। ব্যর্থ মনোরথ হয়ে সে যখন ঘর থেকে বেরিয়ে এল তখন অন্যান্য ইহুদিরা তাকেই ঈসা () মনে করে পাকড়াও করলো, এবং শুলে বিদ্ধ করে হত্যা করলো। উক্ত বর্ণনা দুটির মধ্যে যে কোনটিই সত্য হতে পারে। কুরআনুল কারীম এ সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু ব্যক্ত করেনি। অতএব, প্রকৃত ঘটনার সঠিক খবর একমাত্র আল্লাহ্ তায়ালাই জানেন।

 

উপস্থিত লোকদের মধ্যেই চরম মতভেদ ও বিবাদের সৃষ্টি হয়েছিলকুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে যে, যারা ঈসা (.)- সম্পর্কে নানা মত পোষন করে নিশ্চয় এ ব্যাপারে তারা সন্দেহে পতিত হয়েছে। তাদের কাছে এ সম্পর্কে কোন সত্যনির্ভর জ্ঞান নেই। তারা শুধু অনুমান করে কথা বলে। আর তারা যে ঈসা (.)-কে হত্যা করেনি, এ কথা সুনিশ্চিত। বরং আল্লাহ্ তায়ালা তাকে নিরাপদে নিজের কাছে তুলে নিয়েছেন। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, সম্বিত ফিরে পাওয়ার পর কিছু লোক বললো, আমরা তো নিজেদের লোককেই হত্যা করে ফেলেছি। কেননা, নিহত ব্যক্তির মুখমণ্ডল ঈসা (.)-এর মত হলেও তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অন্য রকম। তদুপরি এ ব্যক্তি যদি ঈসা (.)-হয়, তবে আমাদের প্রেরিত লোকটি গেল কোথায়? আর এ ব্যক্তি আমাদের হলে ঈসা (.)ই বা কোথায় গেলেন? মোটকথা: ঈসা (.)-সম্পর্কে ইহুদিরা ও নাসারা যারাই কথা বলে তারাই বিভ্রান্তিতে লিপ্ত। তাদের কাছে এ ব্যাপারে কোন জ্ঞান নেই।আল্লাহ বলেন,বরং আল্লাহ তাকে তার নিকট তুলে নিয়েছেন এবং আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।( সুরা নিসা আয়াত-১৫৮)

 

আল্লাহ তায়ালা মহাপরাক্রমশালী ও বিজয়ী, তাঁর ইচ্ছাকে কেউ রদ করতে পারে না। যে তাঁর আশ্রয়ে চলে আসবে, তার বিরুদ্ধে যে যতই ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করুক না কেন, তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। তিনি হচ্ছেন মহাপ্রজ্ঞাময়, তাঁর প্রতিটি কাজের ভিতরে হিকমত, যুক্তি ও নিগূঢ় রহস্য বিদ্যমান রয়েছে।জড়পূজারী বস্তুবাদীরা যদি ঈসা (.)--কে সশরীরে আকাশে উত্তোলনের সত্যটি উপলব্ধি করতে না পারে, তবে তা তাদেরই দুর্বলতার প্রমাণ।উপরিউক্ত আয়াত দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ তায়ালা নিজের অলৌকিক শক্তি দ্বারা ঈসা (.)-কে জীবিত অবস্থায় সশরীরে আসমানে তুলে নিয়েছেন। কুরআনের ইয়াহুদীদের ভ্রান্ত বিশ্বাস খণ্ডন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে ইহুদিরা নিশ্চিতই ঈসাকে হত্যা করেনি, বরং আল্লাহ তাকে নিজের কাছে তুলে নিয়েছেন।” (সূরা আন নিসা- ১৫৮)নিজের কাছে তুলে নেয়াসশরীরে তুলে নেয়াকেই বলা হয়।আবু হুরায়রাহ, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, উসমান বিন আবুল আ, আবু উমামা, নাওয়াস বিন সামআন, আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আ, মুজাম্মেবিন জারিয়াহ, আবূ সারীহাহ এবং হুযাইফা বিন উসায়েদ (রা.) প্রমুখ সাহাবাবৃন্দ বহুধা সূত্রে বর্ণিত হাদীসেও এ কথা প্রমাণিত আছে। এ সকল রাবির হাদীস হাদীসের সমস্ত গ্রন্থ ছাড়াও বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে। সে সব হাদীসে ঈসা (.)-কে আসমানে তুলে নেওয়া ছাড়াও পুনরায় কেয়ামতের আগে পৃথিবীতে তাঁর অবতরণ এবং আরো বহু কথা তাঁর ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়েছে। ইমাম ইবনে কাসীর (রহঃ) এই সমস্ত হাদীসগুলিকে বর্ণনা করার পর শেষে লিখেছেন যে, উল্লিখিত হাদীসগুলি রাসূল (সা) হতে বহুধা সূত্রে প্রমাণিত। মুহাম্মদ (সা.) -এর একজন উম্মত বা অনুসারী হিসেবে পুনরায় পৃথিবীতে অবতরণ করবেন . এই সমস্ত হাদীসে তিনি কোথায় ও কিভাবে অবতরণ করবেন তা উল্লেখ করা হয়েছে। ঈসা (.)-দিমাশকের মিনারা শারক্বিয়াতে ফজরের নামাজের ইকামতের সময় অবতরণ করবেন। তিনি শূকর হত্যা করবেন, ক্রুস ভেঙ্গে ফেলবেন ও জিযিয়া কর বাতিল করে দিবেন। তাঁর শাসনামলে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ মুসলমান হয়ে যাবে। তিনিই দাজ্জালকে হত্যা করবেন, তাঁর যুগেই ইয়াজুজ ও মাজুজ ও তাদের ফিতনা-ফাসাদের প্রকাশ ঘটবে এবং তাঁর দ্বারা তারা বিনাশ ও ধ্বংস হয়ে যাবে। অবশেষে ঈসা (.)-স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করবেন।আল্লাহ বলেন, স্মরণ করুন, যখন আল্লাহ্‌ বললেন, হে ঈসা নিশ্চয় আমি আপনাকে পরিগ্রহণ করব। আমার নিকট আপনাকে উঠিয়ে নিব এবং যারা কুফর করে তাদের মধ্য থেকে আপনাকে পবিত্র করব। আর আপনার অনুসারিগণকে কেয়ামত পর্যন্ত কাফেরদের উপর প্রাধান্য দিব, তারপর আমার কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন। অতঃপর যে বিষয়ে তোমাদের মতান্তর ঘটেছে আমি তোমাদের মধ্যে তার মীমাংসা করে দিব। (সুরা ইমরান আয়াত-৫৫)

ঈসা (আঃ) তাঁর উপরে বিশ্বাসী সে যুগের পরবর্তী যুগের সকল খৃষ্টানের পাপের বোঝা নিজে কাঁধে নিয়ে প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ শূলে বিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে খৃষ্টানদের দাবী স্রেফ প্রতারণা অপপ্রচার বৈ কিছুই নয়

ইহুদীদের উপর প্রেরিত গযব তার কারণ সমূহ

ঈসা (আঃ)-এর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করার কারণে আল্লাহ ইহুদী কাফিরদের উপরে নানাবিধ দুনিয়াবী গযব নাযিল করেন তাদেরকে কেন শাস্তি দেওয়া হয়েছিল- সে বিষয়ে অনেকগুলি কারণের মধ্যে আল্লাহ বলেন,‘তারা যে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছিল, তা ছিল () তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে, () অন্যায়ভাবে রাসূলগণকে হত্যা করার কারণে এবং () তাদের এই উক্তির কারণে যে, ‘আমাদের হৃদয় আচ্ছন্ন’... (নিসা ১৫৫)আর () তাদের কুফরীর কারণে এবং () মারিয়ামের প্রতি মহা অপবাদ আরোপের কারণে’ (১৫৬)আর তাদের () একথার কারণে যে, ‘আমরা মারিয়াম-পুত্র ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি, যিনি ছিলেন আল্লাহর রাসূল অথচ তারা না তাঁকে হত্যা করেছিল, না শূলে চড়িয়েছিল বরং তাদের জন্য ধাঁধার সৃষ্টি করা হয়েছিল বস্ত্ততঃ তারা ব্যাপারে নানাবিধ কথা বলে তারা বিষয়ে সন্দেহের মাঝে পড়ে আছে শুধুমাত্র ধারণার অনুসরণ করা ব্যতীত বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞানই নেই আর নিশ্চিতভাবেই তারা তাকে হত্যা করেনি’ (১৫৭)বরং তাকে আল্লাহ নিজের কাছে উঠিয়ে নিয়েছেন আর আল্লাহ লেন মহা পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময়’ (নিসা /১৫৫-১৫৮)

হজরত ঈসা (আ.)-কে আসমানে ওঠানোর পর ঈসা (আ.)-এর ধর্মের পতন হয়। এরপর ঈসা (আ.)-এর সঙ্গীদের ফাঁদে ফেলে খ্রিস্টধর্মের নামে নতুন ধর্ম প্রণয়ন করে এক কট্টরপন্থী ইহুদি। তার নাম ছিল শাওলপরে সে নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখে পৌলপৌলনামের এই ইহুদি ঈসা (আ.)-এর চরম দুশমন ছিল। এর জের ধরেই সে ছদ্মবেশে খ্রিস্টানদের ভেতর ঢুকে খ্রিস্টধর্মকে বিকৃত করে ফেলে। খ্রিস্টানরা তার ফাঁদে পা দেয় এবং সে এ কাজে শতভাগ সফল হয়। বলা যায়, বর্তমান খ্রিস্টধর্ম ঈসা (আ.)-এর রেখে যাওয়া খ্রিস্ট ধর্ম নয়, বরং এটা হলো পৌল ধর্ম। (সূত্র : ঈসাইয়্যাত কিয়া হ্যায়, পৃ. ১০৩-১০৬)

 

  বায়তুল মোকাদ্দাস

অতঃপর এই দুইয়ের প্রথমটির নির্ধারিত সময় যখন উপস্থিত হলো, তখন আমি তোমাদের বিরুদ্ধে পাঠিয়েছিলাম যুদ্ধে অতিশয় শক্তিশালী আমার বান্দাদের। তারা ঘরে ঘরে প্রবেশ করে সব কিছু ধ্বংস করে দেয়। আর (আমার) প্রতিশ্রুতি কার্যকর হয়েই থাকে। (সুরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ৫)

আগের আয়াতে ইহুদিদের দুবার বিপর্যস্ত হওয়া সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল।প্রথমবার তাদের কী পরিণতি হয়েছিল, আলোচ্য আয়াতে সে ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। ইতিহাসে অনেক ঘটনা পাওয়া যায়, যেগুলো বনি ইসরাইল তথা ইহুদিদের চরম বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়। তাফসিরে মাআরেফুল কোরআনে সংক্ষেপে এ ধরনের ছয়টি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

যথা-

১. মসজিদে আকসার প্রতিষ্ঠাতা হজরত সোলায়মান আ:-এর ওফাতের পর প্রথম ঘটনাটি সংঘটিত হয়। বায়তুল মোকাদ্দাসের শাসনকর্তা ধর্মদ্রোহিতা ও কুকর্মের পথ অবলম্বন করেন। মিসরের জনৈক সম্রাট তার ওপর চড়াও হয়ে বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে স্বর্ণ ও রৌপ্যের আসবাবপত্র লুট করে নিয়ে যান, কিন্তু নগরী ও মসজিদকে বিধ্বস্ত করেননি।

২. এর প্রায় ৪০০ বছর পরে সংঘটিত হয় দ্বিতীয় ঘটনাটি। বায়তুল মোকাদ্দাসে বসবাসকারী কিছু ইহুদি মূর্তিপূজা শুরু করে দেয় এরং অবশিষ্টরা অনৈক্যের শিকার হয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত হয়পরিণামে পুনরায় মিসরের জনৈক সম্রাট তাদের ওপর আক্রমণ চালান এবং নগরী ও মসজিদ প্রাচীরেরও কিছুটা ক্ষতিসাধন করেন। এরপর এদের অবস্থার যৎকিঞ্চিত উন্নতি হয়।

৩. এর কয়েক বছর পর তৃতীয় ঘটনাটি ঘটে। যখন বাবেল সম্রাট বুখতা নছর বায়তুল মোকাদ্দাস আক্রমণ এবং শহরটি পদানত করে প্রচুর ধনসম্পদ লুট করে নেন। তিনি অনেক লোককে বন্দী করে সাথে নিয়ে যায় এবং সাবেক সম্রাট পরিবারের জনৈক ব্যক্তিকে নিজের প্রতিনিধিরূপে নগরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন।

৪. এর কারণ নতুন সম্রাট ছিল মূর্তিপূজক ও অনাচারী। তবে সে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে বুখতা নছর পুনরায় বায়তুল মোকাদ্দাস আক্রমণ করেন। এবার তিনি হত্যা ও লুটপাটের চূড়ান্ত করে দেন। আগুন লাগিয়ে সমগ্র শহরকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেন। এ দুর্ঘটনাটি হজরত সোলায়মান আ: কর্তৃক মসজিদ নির্মাণের প্রায় ৪১৫ বছর পর সংঘটিত হয়। এরপর ইহুদিরা এখান থেকে নির্বাসিত হয়ে বাবেলে স্থানান্তরিত এবং সেখানে চরম অপমান, লাঞ্ছনা ও দুর্গতির মাঝে  ৭০ বছর অতিবাহিত হয়। অতঃপর ইরানের সম্রাট বাবেলে চড়াও হয়ে বাবেল অধিকার করে নেন। তিনি নির্বাসিত ইহুদিদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে তাদের পুনরায় সিরিয়ায় পৌঁছে দেন এবং তাদের লুণ্ঠিত দ্রব্যসামগ্রীও তাদের হাতে প্রত্যার্পণ করেন। এ সময় ইহুদিরা নিজেদের কুকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে এবং নতুনভাবে বসতি স্থাপন করে ইরান সম্রাটের সহযোগিতায় আগের নমুনা অনুযায়ী মসজিদে আকসা পুনঃনির্মাণ করে।

৫. ইহুদিরা সেখানে পুনরায় সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করে অতীতকে সম্পূর্ণ ভুলে যায়। তারা আবার ব্যাপকভাবে পাপ কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। হজরত ঈসা আ:-এর জন্মের ১৭০ বছর আগে এ ঘটনাটি সংঘটিত হয়। আন্তাকিয়া শহরের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট ইহুদিদের ওপর চড়াও হন। তিনি ৪০ হাজার ইহুদিকে হত্যা এবং ৪০ হাজারেরও বেশি বন্দী ও গোলাম বানিয়ে সাথে নিয়ে যান। তিনি মসজিদেরও অবমাননা করেন, কিন্তু মসজিদের মূল ভবনটি রক্ষা পায়। পরবর্তী পর্যায়ে এ সম্রাটের উত্তরাধিকারীরা শহর ও মসজিদকে সম্পূর্ণ ময়দানে পরিণত করে দেন। এর কিছু দিন পর বায়তুল মোকাদ্দাস রোম সম্রাটের দখলে চলে যায়। তারা মসজিদের সংস্কার সাধন করেন এবং ৮ বছর পর হজরত ঈসা আ: দুনিয়াতে আগমন করেন।

৬. হজরত ঈসা আ:-এর সশরীরে আকাশে উত্থিত হওয়ার ৪০ বছর পর ষষ্ঠ ঘটনাটি ঘটে। ইহুদিরা রোম সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ফলে রোমকরা শহর ও মসজিদ পুনরায় বিধ্বস্ত করে আগের মতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। তখনকার সম্রাটের নাম ছিল তাইতিস। তিনি ইহুদি বা খ্রিষ্টানও ছিলেন না। কেননা, তার অনেক পর কনস্টানটাইন প্রথম খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। এরপর থেকে খলিফা হজরত ওমর রা:-এর আমল পর্যন্ত মসজিদটি বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। হজরত ওমর রা: এটি পুনঃনির্মাণ করেন।

ইহুদিদের কাছে উজাইর

ইহুদিরা বলে, উজাইর আল্লাহর পুত্র এবং খ্রিস্টানরা বলে, মসিহ আল্লাহর পুত্র। তা তাদের মুখের কথা। আগে যারা কুফরি করেছিল তারা তাদের মতো কথা বলে। আল্লাহ তাদের ধ্বংস করুন। আর কোন দিকে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা আল্লাহ ছাড়া তাদের পণ্ডিতদের ও সংসার বিরাগীদের তাদের প্রভুরূপে গ্রহণ করেছে এবং মারিয়ামের পুত্র মাসিহকেও। কিন্তু তারা এক ইলাহের ইবাদত করার জন্যই আদিষ্ট হয়েছিল। তিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তারা যাকে শরিক করে তা থেকে তিনি কত পবিত্র। ’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ৩০-৩১)

খ্রিস্টপূর্ব ৪৫৭ সালে উজাইর নামে ইহুদিদের একজন পাদ্রি ছিলেন। ইহুদিদের কাছে তিনি উজরা নামে পরিচিত। তিনি ইহুদি ধর্ম পুনর্জীবিত করেছেন। প্রসিদ্ধ ধর্মগ্রন্থ কিতাবুল মুকাদ্দাস সংকলন করেছেন। নতুনভাবে তিনি ইহুদি ধর্মের ব্যাপক প্রচার-প্রসার ঘটিয়েছেন। ইহুদিরা তাঁকে খুবই ভক্তি ও শ্রদ্ধা করে। এমনকি কেউ কেউ তাঁকে আল্লাহর পুত্র হিসেবে আখ্যায়িত করে। ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত, এমনকি খোদ ইহুদিরাও স্বীকার করে যে মুসা (আ.) যে তাওরাত শরিফ লিপিবদ্ধ করেছেন এবং তাবুত নামের সিন্দুকে সংরক্ষণ করেছেন, সেটি সুলাইমান (আ.)-এর আমলের আগেই হারিয়ে গিয়েছিল। বনি ইসরাইলের ওপর আমালাকা গোত্র, মতান্তরে বুখতে নছর বাদশাহ যখন চড়াও হয়েছিল, তখন এ ঘটনা ঘটেছে। সুলাইমান (আ.)-এর শাসনামলে যখন তিনি ওই সিন্দুক খোলেন, তখন তিনি কেবল ১০টা উপদেশ দেখতে পান। বর্তমানে তাদের ধর্মীয় গ্রন্থের 'রাজাদের কাহিনী'তেও এ-সংক্রান্ত বিবরণ পাওয়া যায়। বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পর উজাইর বা উজরা ইবরানি ভাষার পাশাপাশি কিলদানি অক্ষরে তাওরাত ও অন্যান্য পুস্তক লিখেছেন। এনসাইক্লোপেডিয়া অব ব্রিটেনিকার মতে, উজরার সংকলিত পুস্তকগুলোতে বর্ণনাকারীদের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য দেখা যায়। (তাফসিরে মুনির : ১/১৮২)।

রাসুল আগমনের আগে মদিনার ইহুদি

মহানবী (সা.)-এর আগমনের আগে মদিনার রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামোতে স্থিতি ও ভারসাম্য ছিল না। বরং সর্বগ্রাসী নৈরাজ্য তাঁকে একটি রোগগ্রস্তপবিত্র কোরআনের একটি আয়াতে মদিনার তৎকালীন সামাজিক অবস্থার ধারণা পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ কর ! তোমাদের আল্লাহর অনুগ্রহ। যখন তোমরা ছিলে পরস্পরের শত্রু। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরে হৃদ্যতা তৈরি করেছেন। ফলে আল্লাহর অনুগ্রহে তোমরা ভাই ভাইয়ে পরিণত হয়েছ। আর তোমরা ছিলে অগ্নি গহ্বরের প্রান্ত সীমায়। আল্লাহ তোমাদের তা থেকে রক্ষা করেছেন। এভাবে আল্লাহ তোমাদের সামনে তাঁর নিদর্শনাবলি বর্ণনা করেন, যেন তোমরা সুপথ লাভ করো।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১০৩)

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আগমনের আগে ধর্মীয় বিশ্বাসের বিবেচনায় মদিনাবাসী দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। এক. ইহুদি, দুই. মুশরিক। মদিনার ইহুদিরা ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট দ্বারা বিতাড়িত হয়ে মদিনায় আশ্রয় নিয়েছিল। প্রকৃত দ্বিন ও আসমানি কিতাবের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক খুব ক্ষীণ হয়ে এলেও তাদের ভেতর ধর্মচর্চা ছিল। ইবাদত ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করত এবং তাদের শিক্ষাব্যবস্থাও ছিল ধর্মভিত্তিক। তাদের ভেতর জাদুবিদ্যা ও গণনা শাস্ত্রের ব্যাপক চর্চা ছিল।

অন্যদিকে মদিনার মুশরিকরা মক্কাকে তাদের ধর্মীয় কেন্দ্র মনে করত। মক্কার মুশরিকরা যেসব দেবীর উপাসনা করত এবং যেসব প্রতিমাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল মদিনাবাসীও তাদের উপাসনা করত এবং তা ঘরে রাখত। মানাতছিল মদিনার সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রতিমা। মক্কা ও মদিনার মধ্যবর্তী কুদাইদউপত্যকায় মানাতের মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল। তবে পূজা-আর্চনা ও ধর্মীয় প্রভাব বিস্তারে মদিনার মুশরিকদের অবস্থান ছিল মক্কাবাসীর পরেই।

মদিনার অধিবাসীদের সবাই ছিল বহিরাগত। ইহুদিরা এসেছিল ফিলিস্তিন থেকে, আর মুশরিক তথা আউস ও খাজরাজরা এসেছিল ইয়ামেন থেকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় আগমন করা পর্যন্ত ইহুদিদের ওপর আরব পৌত্তলিকদের প্রাধান্য বজায় ছিল। মদিনায় ইহুদিদের তিনটি গোত্র বাস করত : বনু কায়নুকা, বনু নাজির ও বনু কুরায়জা। ধর্মে সবাই ইহুদি হলেও তাদের ভেতর বিরোধ ছিল অত্যন্ত প্রবল। তারা পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতো এবং সুযোগ পেলে বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করত। শুধু তা-ই নয়, এক গোত্র অপর গোত্রের বিরুদ্ধে শত্রুদের সহযোগিতা করত। পবিত্র কোরআনে তাদের রাজনৈতিক বিরোধ এভাবে চিত্রিত হয়েছেযখন আমি তোমাদের অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম যে তোমরা পরস্পর রক্তপাত কোরো না, তোমরা নিজেদের বসত (স্বদেশ) থেকে বের করে দেবে না। তোমরা তা স্বীকার করেছিলে এবং তোমরা তার সাক্ষী। অতঃপর তোমরাই তারা, যারা পরস্পরকে হত্যা করছ এবং তোমাদের একদল অপর দলকে তোমাদের বসত থেকে বের করে দিয়েছ। তোমরা নিজেরা তাদের বিরুদ্ধে অন্যায় ও সীমা লঙ্ঘন করে পরস্পরের পৃষ্ঠপোষকতা করেছ এবং তারা যখন বন্দিরূপে তোমাদের কাছে উপস্থিত হয়, তখন তোমরা মুক্তিপণ দাও। অথচ তাদের বহিষ্কারই তোমাদের জন্য অবৈধ ছিল।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ৮৪-৮৫)

মদিনার অর্থনীতিতে ইহুদিদের প্রাধান্য ছিল। নগদ অর্থ, ধন-সম্পদ ও স্বর্ণ-রৌপ্য তাদের কাছেই বেশি থাকত। অন্যদিকে আরব মুশরিকদের অংশগ্রহণ বেশি ছিল কৃষি কাজে। অপরাপর জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের বেশির ভাগ আর্থিক সম্পর্ক ছিল বন্ধক ও সুদভিত্তিক। কেননা কৃষকদের কৃষিকাজের জন্য ঋণের প্রয়োজন হতো। বন্ধক হিসেবে ইহুদিরা শুধু মূল্যবান জিনিসপত্র ও স্থাবর সম্পদ রাখত না; বরং তারা নারী ও শিশুদেরও বন্ধক হিসেবে রাখত। সহিহ বুখারির একটি বর্ণনায় মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা (রা.)-এর সঙ্গে কাব ইবনে আশরাফের এক কথোপকথনে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। মদিনার অর্থনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখতে ইহুদিরা আউস ও খাজরাজ গোত্রকে যুদ্ধে লিপ্ত রাখার চেষ্টা করত। এ জন্য তারা প্রচুর অর্থবিত্তও ব্যয় করত।

 

 

 

                                                রাসুলের যুগে ইহুদি

ইহুদি জাতি তাদের আসমানি কিতাবগুলোতে শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিবরণ পেয়ে তারা তাঁর আগমনের অপেক্ষায় থাকত। তারা আশা করত, শেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (সা.) এলে তাঁর সঙ্গে যোগ দিলে তাদের দুর্গতি দূর হবে এবং তারা জালেমের অত্যাচার ও অনিষ্টতা থেকে মুক্তি পাবে। তাদের ধারণা ছিল, শেষ নবী ইহুদিদের গোত্র থেকে প্রেরিত হবেন। কিন্তু যখন তারা দেখল যে শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) মক্কার কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন, তখনই তাদের মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়।

এই ক্রোধে তারা তাঁকে মেনে নিতে পারল না। সে থেকেই এই ইহুদি জাতি শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে চলে যায় এবং শুরু করে দেয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র। (দেখুন : সুরা বাকারা, আয়াত : ৮৯)মক্কার কাফিরদের অনিষ্টতার কারণে আল্লাহর হুকুমে রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরত করেন। মদিনার অনুকূল পরিবেশে ইসলাম প্রতিকূল ও প্রতিপক্ষ শক্তির মোকাবিলায় ক্রমান্বয়ে প্রবল শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়। মুসলমানদের শক্তি সঞ্চয়কে মদিনার প্রতিক্রিয়াশীল ইহুদিগোষ্ঠী সহজে মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু মক্কার তুলনায় এখানে মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি হওয়ায় তারা সরাসরি চ্যালেঞ্জ ঘোষণায় সাহসী হয়নি। তাই তারা ভিন্নপথে অগ্রসর হয়। গোপন ষড়যন্ত্রই ছিল মদিনার ওই সব ইহুদির একমাত্র হাতিয়ার। মুনাফিকি আর গাদ্দারিই ছিল তাদের অবলম্বন।

                                                         মদিনার সনদ

মক্কার কাফিরদের অত্যাচার ও নির্যাতনের কারণে আল্লাহর হুকুমে রাসুলুল্লাহ (সা.) ৬২২ খ্রিস্টাব্দে  মদিনায় হিজরত করেন। মদিনায় আগে থেকেই বসবাসরত আওফ ও খাজরায নামক দুটি গোত্রসহ ইহুদিদের তিনটি প্রধান গোত্রের (বনু নযীর, বনু কায়নুকা ও বনু কোরাইযা) কাছে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইসলামের সুমহান দাওয়াত পৌঁছে দেন এবং মদিনাকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার পাশাপাশি সামাজিক ন্যায়বিচার ও শান্তির লক্ষ্যে ঐতিহাসিক মদিনা সনদঘোষণা করেন। এ সনদে ৪৭টি শর্ত ছিল। মদিনা সনদের ধারাবাহিকতা ধরেই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় পরবর্তী যুগে যথাক্রমে ১২১৫ সালের ম্যাগনাকার্টা, ১৬২৮ সালের পিটিশন অব রাইট, ১৬৭৯ সালের হেবিয়াস কার্পাস অ্যাক্ট, ১৬৮৯ সালের বিল অব রাইটস এবং ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকারঘোষিত হয়। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় এই দলিলকে মন্টোগোমারি ওয়াটতার মুহাম্মদ এট মদিনাগ্রন্থে বলেছেন, ‘The Constitution of Madina’ অর্থাৎ মদিনার সংবিধান।

 

 

 

মদিনার ইহুদিরাও ছিল এ সন্ধিচুক্তির অন্যতম শরিক। সন্ধিচুক্তি অনুসারে ইসলাম ও মুসলিম শক্তির বিরুদ্ধে কোনো অন্তর্ঘাত ও নাশকতামূলক কাজে লিপ্ত হওয়া কিংবা ইসলাম বৈরী কোনো শক্তির সঙ্গে কোনোরূপ যোগাযোগ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল এবং তা ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ।মুসলমানদের মধ্যে চিন্তা, বিশ্বাস, রাজনীতি ও ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মাধ্যমে একটি নতুন সমাজের ভিত্তি স্থাপন করেন। নবী করিম (সা.) চাচ্ছিলেন, সব মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করুক এবং মদিনা ও আশপাশের এলাকার মানুষ একটি সুস্থ প্রশাসনের আওতাভুক্ত হোক, তিনি উদারতা ও ন্যায়পরায়ণতার মাধ্যমে এমন আইন প্রণয়ন করেন, বর্তমানে যার কোনো দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায় না।এ সনদের ফলে আওফ ও খাজরায গোত্রের অধিকাংশ মানুষসহ কিছু সংখ্যক ইহুদি পণ্ডিত যাদের আসমানি কিতাব তাওরাত ও ইঞ্জিলের ওপর গভীর জ্ঞান ছিল তারা মুসলমান হয়ে যান। বাদবাকি ইহুদিরা মহানবী হজরত মুহাম্মদকে (সা.) হত্যা করার চক্রান্তে গোপনে মুনাফিকদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ইসলামের অগ্রযাত্রায় বাধাপ্রদান করাসহ ঐতিহাসিক মদিনা সনদের চুক্তিগুলো একের পর এক লঙ্ঘন করতে শুরু করে।

 

                              চুক্তির দফাসমূহ

১. বনু আউফের ইহুদিরা মুসলমানদের সঙ্গে মিলিত হয়ে একই উম্মত (একই জাতি) হিসেবে বিবেচিত হবে, ইহুদি ও মুসলমানরা নিজ নিজ দ্বিনের ওপর আমল করবে, বনু আউফ ছাড়া অন্য ইহুদিরাও একই রকমের অধিকার লাভ করবে।

২. ইহুদিরা নিজেদের সমুদয় ব্যয়ের জন্য দায়ী হবে এবং মুসলমানরা নিজেদের ব্যয়ের জন্য পৃথকভাবে দায়ী হবে।

৩. এই চুক্তির আওতাভুক্তদের কোনো অংশের সঙ্গে যারা যুদ্ধ করবে সবাই সম্মিলিতভাবে তাদের প্রতিহত করবে।

৪. এই চুক্তির অংশীদাররা সবাই পরস্পরের কল্যাণ কামনা করবে, তবে সেই কল্যাণ কামনা ও সহযোগিতা ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে, অন্যায়ের ওপর নয়।

৫. কোনো ব্যক্তি তার মিত্রের কারণে অপরাধী হবে না।

৬. মজলুমকে সাহায্য করা হবে।

৭. যত দিন যুদ্ধ চলতে থাকবে, তত দিন ইহুদিরাও মুসলিমদের সঙ্গে যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করবে।

৮. এই চুক্তির অংশীদারদের জন্য মদিনায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও রক্তপাত নিষিদ্ধ থাকবে।

৯. এই চুক্তির অন্তর্ভুক্তদের মধ্যে কোনো নতুন সমস্যা দেখা দিলে বা ঝগড়া-বিবাদ হলে আল্লাহর আইন অনুযায়ী রাসুল (সা.) তার মীমাংসা করবেন।

১০. কোরাইশ ও তাদের সাহায্যকারীদের আশ্রয় প্রদান করা হবে না।

১১. ইয়াসরেবের (মদিনার) ওপর কেউ হামলা করলে সেই হামলা মোকাবেলায় পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। সব পক্ষ নিজ নিজ অংশের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করবে।

১২. এই চুক্তির মাধ্যমে কোনো অত্যাচারী বা অপরাধীকে আশ্রয় দেওয়া হবে না। (সিরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫০৩, ৫০৪)

এই চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর মদিনা ও এর আশপাশের এলাকা নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠিত হয়, সেই রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল মদিনা

রাসুল (সা.) ছিলেন সেই রাষ্ট্রের মহানায়ক, এর মূল কর্তৃত্ব ছিল মুসলমানদের হাতে, এভাবে মদিনা ইসলামী রাষ্ট্রের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে নবী করিম (সা.) পরবর্তী সময়ে অন্য গোত্রের সঙ্গেও এ ধরনের চুক্তি করেন।মদিনার অনুকূল পরিবেশে ইসলাম প্রতিকূল ও প্রতিপক্ষ শক্তির মোকাবিলায় ক্রমান্বয়ে প্রবল শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়।প্রথম দিকে কিছুদিন তারা শান্ত ও নিরপেক্ষ জীবন যাপন করলেও অল্প দিনের ভেতর তাদের মুখোশ খসে পড়ে এবং তাদের চিরাচরিত অন্তর্ঘাত ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক রূপ ফুটে ওঠে।  মুসলমানদের শক্তি সঞ্চয়কে মদিনার প্রতিক্রিয়াশীল ইহুদিগোষ্ঠী সহজে মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু মক্কার তুলনায় এখানে মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি হওয়ায় তারা সরাসরি চ্যালেঞ্জ ঘোষণায় সাহসী হয়নি। তাই তারা ভিন্নপথে অগ্রসর হয়। গোপন ষড়যন্ত্রই ছিল মদিনার ওই সব ইহুদির একমাত্র হাতিয়ার। মুনাফিকি আর গাদ্দারিই ছিল তাদের অবলম্বন।তারা তাদের উদ্দেশ্য পূরণে একদিকে মদিনার মুনাফিক নেতা আবদুল্লাহ বিন উবাইয়ের সঙ্গে হাত মেলায়, অপর দিকে তারা ইসলাম ও মুসলমানদের প্রকাশ্য দুশমন মক্কার কুরাইশ কাফিরদের সঙ্গে হাত মেলায় এবং মদিনা আক্রমণ করে মুসলমানদের সমূলে উত্খাত করতে তাদের প্ররোচিত করে। তাদের প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানেরও আশ্বাস দেয়।অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। আর রাসুল (সা.) এমন ধরনের আশঙ্কা করেননি। কারণ আকিদাগত দিক দিয়ে অর্থাৎ তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাত নির্ভর বিশ্বাসের দিক দিয়ে মুসলমানরা ছিল ইহুদিদের নিকটতর। (সিরাতে ইবনে হিশাম : ১/৫১৯) পবিত্র কোরআনে তাদের মনোভাব এভাবে ব্যক্ত হয়েছে, ‘তারা সর্বদা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকবে যে পর্যন্ত তোমাদেরকে তোমাদের দ্বিন থেকে ফিরিয়ে না দেয়, যদি তারা সক্ষম হয়। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত -   ২১)

মদিনায় মুসলিমদের প্রতিবেশী ছিল ইহুদিরা। ইহুদিদের সঙ্গে মুসলিমদের সামাজিক যোগাযোগও ছিল। তাই মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে ইহুদিদের একাধিক সংলাপ হয়। এসব সংলাপে সমকালীন ইহুদি জাতির ধর্মবিশ্বাস, মদিনার সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট দারুণভাবে ফুটে উঠেছে।

এসব সংলাপে উত্থাপিত একাধিক প্রশ্নের উত্তর আল্লাহ ওহি নাজিলের মাধ্যমে দিয়েছেন।

ইহুদিদের সঙ্গে সংলাপের ধরন : ‘হিয়াউর রাসুল (সা.) মাআল ইয়াহুদিগ্রন্থে ড. মুহসিন বিন মুহাম্মদ ইহুদি জাতির সঙ্গে মহানবী (সা.)-এর সংলাপগুলো চার ভাগে বিভক্ত করেছেন। তা হলো,

বিতর্কমূলক সংলাপ : আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘একদা আমি নবী (সা.)-এর সঙ্গে মদিনার বসতিহীন এলাকা দিয়ে চলছিলাম। তিনি একটি খেজুরের ডালে ভর দিয়ে একদল ইহুদির কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তারা একজন অন্যজনকে বলতে লাগল, তাঁকে রুহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো। আরেকজন বলল, ‘তাঁকে কোনো প্রশ্ন কোরো না, সে হয়তো এমন কোনো জবাব দেবে, যা তোমরা পছন্দ করো না। আবার কেউ কেউ বলল, ‘তাঁকে আমরা প্রশ্ন করবই। অতঃপর তাদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, ‘হে আবুল কাসিম, রুহ কী?’ অল্লাহর রাসুল (সা.) চুপ করে রইলেন, আমি মনে মনে বললাম, তাঁর প্রতি ওহি অবতীর্ণ হচ্ছে। তাই আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। অতঃপর সে অবস্থা কেটে গেলে তিনি তিলাওয়াত করলেন, ‘তারা আপনাকে রুহ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বলুন, রুহ আমার প্রতিপালকের আদেশ ঘটিত এবং তাদের সামান্যই জ্ঞান দেওয়া হয়েছে। ’ (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ৮৫; সহিহ বুখারি, হাদিস : ১২৫)

অন্য বর্ণনায় এসেছে, তারা মহানবী (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করে আপনার কাছে এই উত্তর কে নিয়ে এসেছে? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে জিবরাইল এসেছেন। তারা বলল, তাঁকে তো আমাদের শত্রু উত্তর প্রদান করেছে।

আইন বিষয়ক সংলাপ : আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এক ইহুদি পুরুষ ও এক ইহুদি নারীকে আনা হলো। তারা দুজনই ব্যভিচার করেছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, এ সম্পর্কে তোমরা তোমাদের কিতাবে কী পেয়েছ? তারা বলল, আমাদের পাদ্রিরা চেহারা কালো করার ও দুজনকে গাধার পিঠে উল্টো বসিয়ে প্রদক্ষিণ করার নিয়ম চালু করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), তাদের তাওরাত নিয়ে আসতে বলুন। এরপর তা নিয়ে আসা হলো। তাদের একজন রজমের আয়াতের ওপর নিজের হাত রেখে দিল এবং এর আগে-পিছে পড়তে লাগল। তখন ইবনে সালাম (রা.) তাকে বললেন, তোমার হাত ওঠাও। দেখা গেল তার হাতের নিচে রয়েছে রজমের আয়াত। তারপর রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের দুজনের ব্যাপারে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যার আদেশ দিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, তাদের উভয়কে সমতল স্থানে রজম করা হয়েছে। তখন পুরুষটাকে দেখেছি স্ত্রীলোকটির ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৮১৯)

সামাজিক সংলাপ : আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.) নবী (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, আমি আপনাকে তিনটি প্রশ্ন করছি। এগুলোর ঠিক উত্তর নবী ছাড়া অন্য কেউ জানে না। ১. কিয়ামতের সর্বপ্রথম আলামত কী?, ২. জান্নাতবাসীদের সর্বপ্রথম খাদ্য কী? ৩. কী কারণে সন্তান আকৃতিতে কখনো পিতার মতো, কখনো মায়ের মতো হয়? নবী (সা.) বললেন, এ বিষয়গুলো সম্পর্কে এই মাত্র জিবরাইল (আ.) আমাকে জানিয়ে গেলেন। তা হলো : ১. কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার সর্বপ্রথম আলামত লেলিহান অগ্নি যা মানুষকে পূর্বদিক হতে পশ্চিম দিকে ধাবিত করে নিয়ে যাবে এবং সবাইকে একত্র করবে।

২. সর্বপ্রথম খাদ্য যা জান্নাতবাসী খাবে তা হলো মাছের কলিজার বাড়তি অংশ।

৩. যদি নারীর আগে পুরুষের বীর্যপাত ঘটে তবে সন্তান পিতার মতো হয়। আর যদি পুরুষের আগে নারীর বীর্যপাত ঘটে তবে সন্তান মায়ের মতো হয়। আবদুল্লাহ ইবনে সালাম বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহর রাসুল। এরপর তিনি ইহুদিদের ডেকে তাঁর সম্পর্কে জানার পরামর্শ দিলেন। নবী (সা.) তাদের ডাকলেন, তারা হাজির হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে সালাম কেমন লোক? তারা বলল, তিনি আমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি এবং সর্বোত্তম ব্যক্তির সন্তান। তিনি আমাদের সবচেয়ে মর্যাদাবান এবং সবচেয়ে মর্যাদাবান ব্যক্তির সন্তান। তখন আবদুল্লাহ ইবনে সালাম বেরিয়ে এলেন এবং কলেমা শাহাদাত পাঠ করলেন। তা শুনে ইহুদিরা বলতে লাগল, সে আমাদের মধ্যে খারাপ লোক এবং খারাপ লোকের সন্তান। তারা তাকে তুচ্ছ করার উদ্দেশ্যে আরো অনেক কথা বলল। আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমি এটাই আশঙ্কা করেছিলাম। (সংক্ষেপিত : সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৯৩৮)

রাজনৈতিক সংলাপ :  রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর একাধিকবার ইহুদি জাতির সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি মদিনা নগরীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঐক্যবদ্ধ সমাজ গঠনের লক্ষ্যে ইহুদিদের সঙ্গে ঐক্য আহ্বান করেন। ইহুদিরা মুসলমানের পক্ষে থাকার কথা বললেও বারবার সে অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, একবার আমরা মসজিদে নববীতে ছিলাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) মসজিদ থেকে বের হয়ে আমাদের বললেন, তোমরা চলো ইহুদিদের ওখানে যাই। আমরা তাঁর সঙ্গে বের হলামশেষে আমরা বায়তুল মিদরাসেপৌঁছলাম।

নবী (সা.) সেখানে দাঁড়িয়ে তাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, হে ইহুদি সম্প্রদায়, তোমরা ইসলাম কবুল কোরো, তোমরা নিরাপত্তা লাভ করবে। ইহুদিরা বলল, হে আবুল কাসিম, আপনার পৌঁছানোর দায়িত্ব আপনি পালন করেছেন। অতঃপর তিনি বললেন, আমার ইচ্ছা তোমরা ইসলাম গ্রহণ কোরো এবং শান্তিতে থাকো। তারা আবারও বলল, হে আবুল কাসিম, আপনার পৌঁছানোর দায়িত্ব আপনি পালন করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমি এ রকমই ইচ্ছা পোষণ করি। তৃতীয়বারও তিনি তাই বললেন। অবশেষে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, জেনে রেখো, জমিন একমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের। আমি তোমাদের এই এলাকা থেকে নির্বাসিত করতে চাই। কাজেই তোমাদের যাদের মালপত্র আছে, তা যেন সে বিক্রি করে দেয়। তা না হলে জেনে রেখো জমিন আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৩৪৮)

সংলাপের ফলাফল : রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে ইহুদি জাতির সংলাগুলোতে যেসব বিষয় স্পষ্ট হয়মহানবী (সা.) ইহুদিদের প্রতি ভ্রাতৃত্বের হাত বাড়িয়েছিলেন। তিনি তাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন, যদিও তাদের কার্যক্রম ছিল বিপরীতমুখী। মদিনার ইহুদিরা মুসলিম রাষ্ট্রের উত্থানকে কখনো ভালো চোখে দেখেনি। তারা মুসলিমদের তাদের চেয়ে নিম্নস্তরের মানুষ ভাবত এবং আসমানি জ্ঞানের ব্যাপারে তাদের ছিল সীমাহীন গর্ব ও অহংকার।

                                                          চুক্তি বাতিল

তাদের মধ্যে তুমি যাদের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ, তারা প্রতিবারই চুক্তি ভঙ্গ করে। এরা দায়িত্বনিষ্ঠ নয়।সুতরাং যুদ্ধকালে যদি তোমরা তাদের নাগালের মধ্যে পাও, তাহলে তাদের পেছনের মূল শক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন করে এমন শাস্তি দেবে, যাতে তাদের শিক্ষা হয়।তোমরা যদি কোনো সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে (চুক্তিভঙ্গজনিত) বিশ্বাসঘাতকতার আশঙ্কা করো, তাহলে তোমার চুক্তিও তুমি যথাযথ (ঘোষণা দিয়ে) বাতিল করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ চুক্তি ভঙ্গকারীদের পছন্দ করেন না। (সুরা আনফাল, আয়াত ৫৬-৫৮)

প্রথম আয়াতে মদিনা ও এর আশপাশে বসবাসকারী ইহুদিদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। মদিনায় আগমনের পর তাদের সঙ্গে নবী করিম (সা.)-এর চুক্তি হয়েছিল যে মদিনা রাষ্ট্রে ইহুদি, মুসলিম ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোক পারস্পরিক সহযোগিতা ও শান্তিতে বসবাস করবে। তারা একে অন্যের শত্রুদের সহযোগিতা করবে না। কিন্তু ইহুদিরা এ চুক্তি বারবার ভঙ্গ করেছে। বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তারা গোপনে মক্কার কাফেরদের যোগসাজশে ষড়যন্ত্র করেছে। বদর যুদ্ধে চুক্তি লঙ্ঘন করে ইহুদিরা মক্কার কোরাইশদের অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করেছে। যুদ্ধে কাফেরদের পরাজয় হলে তারা মহানবী (সা.)-এর কাছে এসে ক্ষমা চায়। মহানবী (সা.) তাদের ক্ষমা করে দেন। কিন্তু এর পরও ওহুদ যুদ্ধের প্রাক্কালে ইহুদিদের সরদার কাব বিন আশরাফ মক্কায় গিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে আক্রমণের উসকানি দেয় এবং কাফিরদের সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। এটা ছিল তাদের দ্বিতীয়বারের চুক্তি লঙ্ঘন।

দ্বিতীয় আয়াতে এসব বিশ্বাসঘাতক ষড়যন্ত্রকারীর বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, তারা যদি কোনো যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ময়দানে আসে, তাহলে তাদের সমুচিত জবাব দিতে হবে। এমন শাস্তি দিতে হবে, যাতে তাদের শিক্ষা হয়ে যায়।

শেষ আয়াতে বলা হয়েছে, যদি কাফেরদের বিশ্বাস ভঙ্গের কারণে মুসলিমদের বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে, এ ক্ষেত্রে তারা যেন পরিষ্কারভাবে চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেয়। সেই সঙ্গে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে, বিশ্বাসঘাতকতার আশঙ্কা দেখা দিলে আগেই তাদের বিরুদ্ধে চুক্তিবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাবে না। আগে চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দিতে হবে। অন্যথায় সেটা চুক্তিভঙ্গের কারণ হবে, যা আল্লাহ পছন্দ করেন না।

(তাফসিরে মা'আরেফুল কোরআন ও ইবনে কাছির)

                              ইহুদিরা কেন মুসলিমদের সঙ্গে এত শত্রুতা করে

মুসলমানদের সঙ্গে ইহুদিদের ভীষণ শত্রুতার কারণ হলো-

প্রথমত, তাদের অস্থিমজ্জা ও স্বভাবে রয়েছে একগুঁয়েমি, হিংসা ও জিঘাংসা।

দ্বিতীয়ত, তাদের ভেতর ছিল আলেম, দরবেশ ও ধর্মীয় পণ্ডিতের স্বল্পতা।

 তৃতীয়ত, সত্য প্রত্যাখ্যান তাদের চিরাচরিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। রাসুল (সা.) বলেছেন, 'কোনো ইহুদি যখন কোনো মুসলিমকে একাকী পায়, তখন তার মনে ওই মুসলিমকে হত্যা করার ইচ্ছার উদ্রেক হয়। '

 

                                ইহুদি ষড়যন্ত্র

ইহুদিরা মহানবী সা:কে নানাভাবে কষ্ট দিয়েছে। মহানবী সা:-এর সময় মদিনায় বহু ইহুদি গোত্র ছিল। যেমন বনু নাজির, বনু কাইনুকা, বনি আউফ, খুজা, আউজ, খাজরাজ ইত্যাদি। তিনবার তারা মহানবি  সা:কে হত্যার চেষ্টা করে।এমনকি একদিন মদিনাস্থ ইহুদিদের এক বাজারে একজন মুসলিম মহিলা সাহাবিকে কতিপয় ইহুদি কর্তৃক কৌশলে উলঙ্গ করার ঘটনা ঘটানো হয়। এ ঘটনাটি মহানবীর (সা.) কাছে পৌঁছালে তা এক পর্যায়ে বনু নযীর গোত্রের ইহুদিদের সঙ্গে মুসলমানদের এক ভয়াবহ যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি করে। এছাড়াও খন্দকের যুদ্ধের প্রাক্কালে মদিনা সনদের চুক্তিগুলো ভঙের প্রেক্ষাপটে বনু কোরাইযার সঙ্গেও মুসলমানদের আরেকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ দুটি যুদ্ধের পর বেঁচে যাওয়া ইহুদিদের এবং ইতিপূর্বে ক্ষমাপ্রাপ্ত ইহুদিদের মদিনার উত্তরে খায়বারের দিকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।পরে ওরা খায়বারে অবস্থান করেও নানামুখী চক্রান্তে লিপ্ত হলে অবশেষে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) খায়বর অভিযান পরিচালনা করেন এবং ইহুদিদের সব দুর্গ দখল করে মুসলমানদের অধীনে নিয়ে আসেন। পরের ধাপে সমগ্র আরব উপদ্বীপ থেকে কুচক্রী ইহুদিদের বিতাড়ন করা হলে বিতাড়িত ইহুদিরা তদানীন্তন রোমান সাম্রাজ্যের সিরিয়া সীমান্ত পাড়ি দিয়ে খ্রিস্টান জগতের বিভিন্ন দেশে পরগাছার মতো জীবন-যাপন করতে শুরু করে। এরপর থেকে ১৯৪৮ সালে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার আগ পর্যন্ত কোনো রাষ্ট্রীয় ঠিকানা ইহুদিদের ছিল না।

 

 রাসূল সা:-এর আমলে তাকে হত্যা, সুদ ব্যবস্থা ও বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের কারণে ইহুদিদের বনু কাইনুকা ও বনু জিয়র গোত্রকে বহিষ্কার করা হয়।  প্রথমে ২য় হিজরীর রামাযান মাসে বনু ক্বায়নুক্বা, অতঃপর ৪র্থ হিজরীর রবীউল আউয়ালে বনু নাযীর এবং সর্বশেষ ৫ম হিজরীর যিলহাজ্জ মাসে তৃতীয় ও সর্বশেষ ইহূদী গোত্র বনু কুরায়যার নির্মূলের ফলে মদীনা ইহূদীমুক্ত হয় এবং মুসলিম শক্তি প্রতিবেশী কুচক্রীদের হাত থেকে রেহাই পায়।

                                      ইহুদিদের প্রতারণার নমুনা

ইবনু ইসহাক্ব বর্ণনা করেছেন যে, শাস ইবনু ক্বায়স নামক একজন বৃদ্ধ ইয়াহুদী ছিল। তার পা যেন কবরে লটকানো ছিল (অত্যন্ত বৃদ্ধ ছিল)। সে মুসলিমদের প্রতি চরম শত্রুতা ও হিংসা পোষণ করত। সে একদা সাহাবীগণের (রাঃ) একটি মজলিসের পাশ দিয়ে গমন করছিল যে মজলিসে আউস ও খাযরাজ উভয় গোত্রেরই লোকেরা পরস্পর কথোপকথন করছিলেন। এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে তার অন্তর হিংসায় জ্বলে উঠল এবং তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার পথ সে অন্বেষণ করতে লাগল। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে ঐ দুসম্প্রদায়ের মধ্যে দীর্ঘকালব্যাপী বিরাজিত শত্রুতা ইসলাম পরবর্তীকালে প্রেম প্রীতিতে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল এবং এভাবে তাদের দীর্ঘ কালের দুঃখ-দুর্দশার অবসান হয়েছিল। সমবেত জনতাকে দেখে সে বলতে লাগল এখানে বনু কাইলার সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ একত্রিত হয়েছে। আল্লাহর কসম! এ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গের নিকট দিয়ে আমার গমন সঙ্গত হবে না। তাই সে তার এক যুবক সঙ্গীকে নির্দেশ দিল যে, সে যেন তাদের মজলিসে যায় এবং তাদের সঙ্গে বসে গিয়ে বুআস যুদ্ধ এবং তার পূর্ববর্তী অবস্থা আলোচনা করে এবং ঐ সময়ে উভয় পক্ষ হতে যে সকল কবিতা পাঠ করা হয়েছিল ওগুলোর কিছু কিছু পাঠ করে শুনিয়ে দেয়। ঐ যুবক ইহুদীকে যা যা বলা হয়েছিল ঠিক সে ঐ রূপই করল।

ঐ কবিতাগুলো শোনা মাত্রই উভয় গোত্রের লোকদের মধ্যে পুরনো হিংসা বিদ্বেষের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল এবং উভয় পক্ষের মধ্যে অনেক বাক বিতন্ডা হয়ে গেল। যুদ্ধের উন্মাদনা নিয়ে উভয় পক্ষের যোদ্ধাগণ হার্রাহ নামক স্থানে সমবেত হলেন।

এ দুঃসংবাদ পাওয়া মাত্রই রাসূলুল্লাহ () মুহাজির সাহাবীগণ (রাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে তাঁদের মাঝে আগমন করে বললেন,

হে মুসলিম সম্প্রদায়! আল্লাহ ক্ষমা করুন, এ কী হচ্ছে? আমার জীবদ্দশাতেই জাহেলিয়াতের চিৎকার? অথচ আল্লাহ তোমাদেরকে মুসলিম করেছেন, ইসলামের দ্বারা জাহেলিয়াতের মূলোৎপাটন করে তোমাদিগকে কুফর হতে মুক্ত করে তোমাদের পরস্পরের হৃদয়কে এক অপরের সাথে বেঁধে দিয়েছেন।

রাসূলুল্লাহ ()-এর এ কথা শুনে নিজেরা নিজেদেরকে সামলিয়ে নিলেন এবং অনুধাবন করলেন যে, এটা শয়তানের প্ররোচনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তারপর তাঁরা পরস্পর গলায়-গলায় মিলে ক্রন্দন এবং তওবাহ করলেন। এভাবে শাস ইবনু কায়েসের প্রতি হিংসার আগুন নির্বাপিত হল।

এটা হচ্ছে কুচক্রীপনা ও গন্ডগোলের একটা নমুনা যা ইহুদীরা মুসলিমদের মধ্যে সৃষ্টি করার চেষ্টা করতে থাকত। এ কাজের জন্যে তারা বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করত এবং মিথ্যা রটনা রটাতে থাকত। তারা সকালে মুসলিম হয়ে সন্ধ্যায় কাফির হয়ে যেত এবং এভাবে সরল প্রাণ মুসলিমদের অন্তরে সন্দেহের বীজ বপন করার চেষ্টায় লেগে থাকত। কোন মুসলমানের সাথে তাদের অর্থের সম্পর্ক থাকলে তারা তার জীবিকার পথ সংকীর্ণ করে দিত। আর তাদের উপর মুসলিমদের ঋণ থাকলে তারা তাদের ঋণ পরিশোধ করত না, বরং অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করত এবং বলত তোমাদের ঋণ তো আমাদের উপর ঐ সময় ছিল যখন তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষদের ধর্মের উপর ছিলে। কিন্তু এখন তোমরা ঐ ধর্ম যখন পরিবর্তন করেছো তখন আমাদের নিকট হতে ঋণ আদায়ের তোমাদের কোন পথ নেই।

প্রকাশ থাকে যে, ইহুদীরা এ সব কার্যকলাপ বদর যুদ্ধের পূর্বেই শুরু করেছিল এবং তাদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করার সূচনা করে ফেলেছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ () ও সাহাবীদের অবস্থা এই ছিল যে, তারা ইহুদীদের হিদায়াত প্রাপ্তির আশা করে তাদের এ সব কার্যকলাপের উপর ধৈর্য ধারণ করে চলছিলেন। এছাড়া এটাও উদ্দেশ্য ছিল যে, যেন ঐ অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তার কোন ব্যাঘাত না ঘটে। ( সফিউর রহমান )

বনু কাইনুকা  ( ২য় হিজরীর রামাযান মাসে )

বনু কাইনুকা ছিল ইহুদিদের তিনটি গোত্রের মধ্যে সর্বাধিক হিংসুটে একটি গোত্র। তারা সবাই মদিনায় অবস্থান করত এবং তাদের মহল্লাটি তাদের নামেই কথিত ছিল। পেশার দিকে থেকে তারা ছিল স্বর্ণকার, কর্মকার ও পাত্র নির্মাতা। রাসূলুল্লাহ বদর প্রান্তরে কুরাইশদেরকে পরাজিত করে যখন মদীনায় আগমন করলেন তখন বনু কাইনুকার বাজারে ইহুদীদের একত্রিত করে বললেন, ‘হে ইহুদী সমাজ, তোমরা আনুগত্য স্বীকার কর, অন্যথায় কুরাইশদের মতো তোমাদেরকেও বিপন্ন হতে হবে।

কিন্তু তারা তাঁর উপদেশ গ্রহণ করল না। চরম ধৃষ্টতা সহকারে তারা বলতে লাগল, ‘হে মুহাম্মাদ কতিপয় আনাড়ী কুরাইশকে হত্যা করেছ বলে গর্বিত হয়ো না। যুদ্ধ সম্বন্ধে তারা একেবারে অনভিজ্ঞ ছিল। কিন্তু আমাদের সঙ্গে যখন যুদ্ধ হবে তখন বুঝবে যে, ব্যাপারটি কত কঠিন।তাদের এ সবের জবাবে আল্লাহ তাআলা বলেন,‘‘যারা কুফরী করে তাদেরকে বলে দাও, তোমরা অচিরেই পরাজিত হবে আর তোমাদেরকে জাহান্নামের দিকে হাঁকানো হবে, ওটা কতই না নিকৃষ্ট আবাসস্থান! তোমাদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন আছে সেই দুদল সৈন্যের মধ্যে যারা পরস্পর প্রতিদ্বনদ্বীরূপে দাঁড়িয়েছিল (বাদ্র প্রান্তরে)। একদল আল্লাহর পথে যুদ্ধ করেছিল এবং অপরদল ছিল কাফির, কাফিররা মুসলিমগণকে প্রকাশ্য চোখে দ্বিগুণ দেখছিল। আল্লাহ যাকে ইচ্ছে স্বীয় সাহায্যের দ্বারা শক্তিশালী করে থাকেন, নিশ্চয়ই এতে দৃষ্টিমানদের জন্য শিক্ষা রয়েছে।’ (আলু-ইমরান : ১২-১৩)

মোট কথা, বনু কাইনুকাযে জবাব দিয়েছিল তাতে পরিস্কারভাবে যুদ্ধের ঘোষণাই ছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা.) ক্রোধ সম্বরণ করে ধৈর্য্য ধারণ করেন। অন্যান্য মুসলিমগণও ধৈর্য্য ধারণ করে পরবর্তী অবস্থার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।

এদিকে ঐ হিতোপদেশের পর বনু ক্বাইনুক্কার ইহুদীগণের ঔদ্ধত্য আরও বেড়ে যায় এবং অল্প দিনের মধ্যেই তারা মদীনাতে হাঙ্গামা শুরু করে দেয়। এর ফলশ্রুতিতে তারা নিজের কবর নিজের হাতেই খনন করে এবং নিজেদের জীবন বিপন্ন করে তোলে।

আবু আওন থেকে ইবনে হিশাম বর্ণনা করেছেন, একদিন জনৈকা মুসলিম নারী বনু কাইনুকা গোত্রের বাজারে দুধ বিক্রি করে বিশেষ কোনো প্রয়োজনে এক ইহুদি স্বর্ণকারের কাছে গিয়ে বসে পড়েন। কয়েকজন দুর্বৃত্ত ইহুদি তাঁর মুখের নেকাব খোলানোর অপচেষ্টা করে, তাতে ওই নারী অস্বীকৃতি জানান। ওই স্বর্ণকার গোপনে মুসলিম নারীটির (অগোচরে) পরিহিত বস্ত্রের এক প্রান্ত তার পিঠের ওপরে গিঁট দিয়ে দেয়, তিনি তা বুঝতেই পারলেন না। ফলে তিনি উঠতে গিয়ে বিবস্ত্র হয়ে পড়েন। এ ভদ্র মহিলাকে বিবস্ত্র অবস্থায় প্রত্যক্ষ করে নরপিশাচের দল হো হো করে হাততালি দিতে থাকল। মহিলাটি ক্ষোভে ও লজ্জায় মৃতপ্রায় হয়ে আর্তনাদ করতে লাগলেন। তা শুনে জনৈক (প্রতিবাদী) মুসলিম ওই স্বর্ণকারকে আক্রমণ করে হত্যা করেন। প্রত্যুত্তরে ইহুদিরা মুসলিম লোকটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে হত্যা করে।

এরপর নিহত মুসলিমটির পরিবারবর্গ চিৎকার করে ইহুদিদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের কাছে ফরিয়াদ করেন। এর ফলে মুসলিম ও বনু কাইনুকার ইহুদিদের মধ্যে সংঘাত বাধে এ ঘটনার পর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল (তিনি এর আগে তাদের অনেক অপরাধ ক্ষমা করেছিলেন)। তিনি মদিনার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব আবু লুবাবাহ ইবনে আবদুল মুনজির (রা.)-এর ওপর অর্পণ করে স্বয়ং হামজাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব (রা.)-এর হাতে মুসলিমদের পতাকা প্রদান করে আল্লাহর সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে বনু কাইনুকা গোত্রের দিকে ধাবিত হন। ইহুদিরা তাঁদের দেখামাত্র দুর্গের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে দুর্গের দ্বারগুলো ভালোভাবে বন্ধ করে দেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) কঠিনভাবে তাদের দুর্গ অবরোধ করেন। এই দিনটি ছিল শুক্রবার, হিজরি দ্বিতীয় সনের শাওয়াল মাসের ১৫ তারিখ। ১৫ দিন পর্যন্ত অর্থাৎ জুলকাদার নতুন চাঁদ উদয় হওয়া অবধি অবরোধ অব্যাহত থাকে। তারপর আল্লাহ তাআলা ইহুদিদের অন্তরে ভীতি ও সন্ত্রস্তভাব সৃষ্টি করলেন এবং তাঁর নীতি এটাই যে, যখন তিনি কোনো সম্প্রদায়কে পরাজিত ও লাঞ্ছিত করার ইচ্ছা করেন তখন তিনি তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করে থাকেন। অবশেষে বনু কাইনুকা গোত্র আত্মসমর্পণ করল এবং বলল যে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের জান-মাল, সন্তান-সন্ততি এবং নারীদের ব্যাপারে যা ফায়সালা করবেন তারা তা মেনে নেবে। তারপর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশক্রমে তাদের সবাইকে বন্দি করে নেওয়া হয়।  

কিন্তু এ স্থানে আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই তার কপট চাল চালবার সুযোগ গ্রহণ করল। সে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে অত্যন্ত অনুনয় বিনয় করে বলল, ‘হে মুহাম্মাদ (সা.) আপনি এদের প্রতি সদয় ব্যবহার করুন।প্রকাশ থাকে যে, বনু কাইনুকা গোত্র খাযরাজ গোত্রের মিত্র ছিল। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শনের ব্যাপারে বিলম্ব করলেন। সে পীড়াপীড়ি করতে থাকল। রাসুলুল্লাহ (সা.) তার হতে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। কিন্তু শেষে সে তাঁর  জামার বুকের অংশবিশেষ ধরে ফেলল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বিশেষ বিরক্তি ও ক্রোধ সহকারে পুনঃপুনঃ তাকে ছেড়ে দিতে বললেন, কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও সে পুনঃ পুনঃ উত্তর করতে লাগল আমি কোন মতেই ছাড়বো না যে পর্যন্ত না আপনি তাদের উপর দয়াপরবশ হন। চারশ জন খোলা দেহের যুবক এবং তিনশ জন বর্মপরিহিত যুবককে আপনি একই দিনের সকালে কেটে ফেলবেন, অথচ তারা আমাকে কঠিন বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিল। আল্লাহর কসম! আমি কালচক্রের বিপদের আশঙ্কা করছি।

অবশেষে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের ধন মাল হস্তগত করলেন যেগুলোর মধ্যে তিনটি কামান, দুটি বর্ম, তিনটি তরবারী এবং তিনটি বর্শা নিজের জন্যে বেছে নেন এবং গনীমতের মালের এক পঞ্চমাংশ বের করেন। মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা (রাঃ) গণীমত একত্রিত করার কাজ সম্পাদন করেন। (ইবনে হিশাম : ২/৪৭, আর রাহিকুল মাখতুম [বাংলা] : ২৪০-২৪২)

বনু নাজির  ( ৪র্থ হিজরীর রবীউল আউয়ালে বনু নাযীর )

বনু নাজির  যুদ্ধ ৪র্থ হিজরীর রবিউল আওয়াল মোতাবেক ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাসে সংঘটিত হয়েছিল। ইহুদি সম্প্রদায় বনু নাজির  গোত্রের সাথে একটি আলোচনা সভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে মহানবী সা: হজরত আবু বকর, হজরত ওমর ও হজরত আলী রা:-কে সাথে নিয়ে গমন করেন। মহানবীর সা: জীবননাশের একটি মোক্ষম সুযোগ বিবেচনা করে তারা আমর ইবন জাহাশ নামে এক ইহুদি আততায়ীকে এ কাজে নিযুক্ত করে। মহানবী সা: এ সময় একটি প্রাচীরের ছায়ায় বসেছিলেন। আমর প্রাচীরসংলগ্ন একটি ঘরের ছাদে উঠে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যার প্রস্তুতি নেয়। ইতোমধ্যে মহানবী সা: ওহির মাধ্যমে এ ষড়যন্ত্রের বিষয় জেনে ফেলেন। ফলে ঘাতকের কৃষ্ণ রোমশ হাত কুৎসিত কর্মটি সম্পাদন করার আগেই মহানবী স্থান ত্যাগ করেন এবং নিরাপদে মদিনায় বাসগৃহে ফিরে আসেন।  (সিরাত ইবনে হিশাম : ২/১৯০)

মদীনা প্রত্যাবর্তনের পর পরই রাসুলুল্লাহ (সা.) তাৎক্ষণিকভাবে মুহাম্মাদ বিন মাসলামাকে বনু নাজিরের নিকট এ নির্দেশসহ প্রেরণ করেন যে, তারা যেন অবিলম্বে মদীনা থেকে বেরিয়ে অন্যত্র চলে যায়। মুসলিমগণের সঙ্গে তারা আর বসবাস করতে পারবে না। মদীনা পরিত্যাগ করে যাওয়ার জন্য তাদের দশ দিন সময় দেয়া হল। এ নির্ধারিত সময়ের পরে তাদের মধ্য থেকে যাকে মদীনায় পাওয়া যাবে তার গ্রীবা কর্তন করা হবে। এ নির্দেশ প্রাপ্তির পর মদীনা পরিত্যাগ করে যাওয়া ছাড়া ইহুদীদের আর কোন গত্যন্তর রইল না।

নাবী কারীম (সা.)-এর পক্ষ থেকে নির্দেশ প্রাপ্তির পর মদীনা পরিত্যাগের জন্য তারা প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। কিন্তুমুনাফিক্ব নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই উল্লেখিত সময়ের মধ্যেই মদীনা ত্যাগ না করে আপন আপন স্থানে দৃঢ়তার সঙ্গে অবস্থান করতে থাকার জন্য পরামর্শ দেয়। সে বলে যে, তার নিকট দুই হাজার সাহসী সৈন্য রয়েছে, যারা তাদের দূর্গাভ্যন্তরে থেকে তাদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে তৈরি থাকবে। অধিকন্তু, যদি তাদের দেশ থেকে বের করে দেয়া হয় তাহলে তাদের সঙ্গে তারাও দেশত্যাগ করবে, যদি তাদের যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয় তারা তাদের সাহায্য করবে এবং তাদের কোন ব্যাপারেই তারা কারো নিকট মাথা নত করবে না। তাছাড়া বনু কুরাইযা এবং বনু গাত্বাফান যারা তোমাদের হালীফ’ (সহযোগী) তারাও তাদের সাহায্য করবেআল্লাহ তাআলা বলেন,

তোমরা যদি বহিস্কৃত হও, তাহলে অবশ্য অবশ্যই আমরাও তোমাদের সাথে বেরিয়ে যাব, আর তোমাদের ব্যাপারে আমরা কক্ষনো কারো কথা মেনে নেব না। আর যদি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয়, তাহলে আমরা অবশ্য অবশ্যই তোমাদেরকে সাহায্য করব।’ [আল-হাশর (৫৯) : ১১]

আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের পক্ষ থেকে এ প্রস্তাব পাওয়ার পর ইহুদীদের মনোবল বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে মদীনা পরিত্যাগ না করে বরং মুসলিমগণকে মোকাবেলা করবে। তাদের নেতা হুওয়াই বিন আখতাবের বিশ্বাস ছিল যে, মুনাফিক্ব নেতা যা বলেছে তা সে পূরণ করবে। এ কারণে প্রত্যুত্তরে সে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলে পাঠাল যে তারা কিছুতেই তাদের ঘরবাড়ি পরিত্যাগ করে যাবে না। তিনি যা করতে চান তা করতে পারেন।

এতে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, মুসলিমগণের জন্যে এ পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত স্পর্শকাতর। কারণ, ইতিহাসের সংকটপূর্ণ অধ্যায়ে শত্রুদের সঙ্গে মোকাবেলা করার ব্যাপারটি তেমন আশা কিংবা উৎসাহব্যঞ্জক ছিল না। এর পরিণতি যে অত্যন্ত ভয়াবহ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল তা অস্বীকার করা যায় না। তখন সমগ্র আরব জাহান ছিল মুসলিমগণের বিরুদ্ধে এবং মুসলিমগণের দুটি প্রচারক দলকে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হতে হয়েছিল। তাছাড়া বনু নাজিরের ইহুদীগণ এতই শক্তিশালী ছিল যে, তাদের হাত হতে অস্ত্রশস্ত্র নামানো মোটেই সহজ সাধ্য ছিল না। অধিকন্তু তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার ব্যাপারটিও বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আশঙ্কামুক্ত ছিল না। কিন্তু বীরে মাউনারবেদনাদায়ক ঘটনার পূর্বে ও পরে পরিস্থিতি যে ভাবে মোড় নিয়েছিল যার ফলশ্রুতি ছিল অঙ্গীকার ভঙ্গ ও মুসলিমগণকে নির্মমভাবে হত্যা এবং যা মুসলিমগণের মনে এ সকল অপরাধ সম্পর্কে অভূতপূর্ব এক সচেতনতা ও চৈতন্যের উন্মেষ ঘটিয়েছিল, তার ফলে মুসলিমগণের মনে প্রতিশোধ গ্রহণের অনুভূতি এবং ইচ্ছা ও হয়েছিল তীব্র।

এ কারণে তাঁরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যে, যেহেতু বনু নাজির  নাবী কারীম (সা.)-কে হত্যার এক ঘৃণ্য চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিল সেহেতু যে কোন মূল্যে যুদ্ধ করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। তাতে ফলাফল যাই হোক না কেন।

এমনি এক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে নাবী কারীম (সা.) যখন হুওয়াই বিন আখতাবের নিকট থেকে তার নির্দেশনার প্রত্যুত্তর প্রাপ্ত হলেন তখন তিনি এবং তাঁর উপস্থিত সাহাবীগণ (রাঃ) আল্লাহ আকবার ধ্বনিতে ফেটে পড়লেন। তৎক্ষণাৎ শুরু হয়ে গেলে যুদ্ধ প্রস্তুতি। আব্দুল্লাহ বিন উম্মু মাকতুমের উপর মদীনার প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্বভার অর্পণের পর বনু নাজির  অভিমুখে রওয়ানা হয়ে গেলেন মুসলিম বাহিনী। পতাকা ছিল আলী বিন আবূ ত্বালীবের হাতে। বনু নাযীর এলাকায় পৌঁছে মুসলিম বাহিনী তাদের দূর্গ অবরোধ করেন।

এদিকে বনু নাযীর দূর্গ অভ্যন্তরে অবস্থান গ্রহণ করে দূর্গ প্রাচীর থেকে তীর এবং প্রস্তর নিক্ষেপ করতে থাকে। যেহেতু খেজুর বাগানগুলো তাদের ঢাল বা যুদ্ধাবরণ হিসেবে বিদ্যমান ছিল সেহেতু সেগুলোকে কেটে ফেলার কিংবা পুড়িয়ে ফেলার জন্য নাবী কারীম (সা.) নির্দেশ প্রদান করেন।

তোমরা খেজুরের যে গাছগুলো কেটেছ আর যেগুলোকে তাদের মূলকান্ডের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দিয়েছ, তা আল্লাহর অনুমতিক্রমেই (করেছ)।[আল-হাশর - ৫]

যাহোক, যখন তাদের অবরোধ করা হল তখন বনু কুরাইযাহ তাদের থেকে পৃথক রইল। আব্দুল্লাহ বিন উবাইও প্রতিশ্রুতি পালন করল না। তাছাড়া, তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ গাত্বাফান গোত্রও সাহায্যার্থে এগিয়ে এল না। মোট কথা, তাদের এ সংকট কালে কেউই তাদের কোনভাবেই সাহায্য করল না। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা তাদের এ ঘটনার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে আয়াত নাযিল করেন,‘(তাদের মিত্ররা তাদেরকে প্রতারিত করেছে) শয়ত্বানের মত। মানুষকে সে বলে- কুফুরী করঅতঃপর মানুষ যখন কুফুরী করে তখন শয়ত্বান বলে- তোমার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই।’ [আল-হাশর (৫৯) : ১৬]

অবরোধ বেশী দীর্ঘদিন হয় নি, অবরোধ অব্যাহত ছিল ছয় রাত্রি মতান্তরে পনের রাত্রি। এর মধ্যেই আল্লাহ তাআলা তাদের অন্তরে ভীতির সঞ্চার করে দেন। যার ফলে তাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে এবং তারা অস্ত্র সংবরণ করতে সম্মত হয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) -এর নিকট তারা প্রস্তাব করে যে মদীনা পরিত্যাগ করে তারা অন্যত্র চলে যেতে প্রস্তুত রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদের প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করে এ নির্দেশ প্রদান করেন যে, অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া অন্যান্য যে সব দ্রব্য তারা উটের পিঠে বোঝাই করে নিয়ে যেতে পারবে তা নিয়ে যাবে। পরিবার পরিজনও তাদের সঙ্গে যেতে পারবে।

এ স্বীকৃতির পর বনু নাযীর অস্ত্র সমর্পণ করে। অতঃপর গৃহাদির জানালা দরজাগুলো যাতে উটের পিঠে বোঝাই করে নিয়ে যেতে পারে এ উদ্দেশ্যে নিজ হাতে নিজ নিজ ঘরবাড়িগুলো ধ্বংস করে ফেলেএদের কোন কোন লোককে ছাদের কড়া এবং দেয়ালের খুঁটি নিয়ে যেতেও দেখা যায়। অতঃপর শিশু ও মহিলাদের উটের পিঠে সওয়ার করিয়ে ছয়শত উটের উপর সব কিছু বোঝাই করে নিয়ে রওয়ানা হয়ে যায়। অধিক সংখ্যক ইহুদী এবং তাদের প্রধানগণ যেমন হুয়াই বিন আখতাব এবং সালাম বিন আবিল হুক্বাইক্ব খায়বার অভিমুখে যায়। এক দল যায় সিরিয়া অভিমুখে। শুধু ইয়ামিন বিন আমর এবং আবূ সাঈদ বিন ওয়াহাব ইসলাম গ্রহণ করে। কাজেই, তাদের মালামালের উপর হাত দেয়া হয় নি।

আরোপিত শর্তাদির পরিপ্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (সা) বনু নাযীরের অস্ত্রশস্ত্র, জমিজমা ও বাড়িঘর নিজ অধিকারভুক্ত করে নেন। অস্ত্রশস্ত্র মধ্যে ছিল ৫০টি লৌহ বর্ম, ৫০টি হেলমেট এবং ৩৪০টি তরবারী।

খন্দকের যুদ্ধ

এক বছরকালব্যাপী উপর্যুপরি সামরিক অভিযান এবং কর্মকান্ডের প্রেক্ষাপটে আরব উপদ্বীপে শান্তি ও স্বস্তির বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছিল এবং সর্বত্র সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তার পরিবেশ বিরাজমান ছিল। কিন্তু যে সকল ইহুদীকে নিজেদের দুষ্কর্ম ও চক্রান্তের কারণে নানা প্রকার অপমান ও লাঞ্ছনার আস্বাদ গ্রহণ করতে হয়েছিল তখনো তাদের চৈতন্যোদয় হয়নি। বিশ্বাসঘাতকতা, শঠতা, অঙ্গীকারভঙ্গ, ধোকাবাজি, আমানতের খেয়ানত ইত্যাদি নানাবিধ অপকর্মের অশুভ ফলাফল থেকে কোন শিক্ষাই তাদের হয়নি। কাজেই, মদীনা থেকে বহিস্কৃত হয়ে খায়বার যাওয়ার পর মুসলিম ও মূর্তিপূজকদের মধ্যে যে সামরিক টানাপোড়েন চলছিল তার ফলাফল কী দাঁড়ায় তা প্রত্যক্ষ করার জন্য তারা অপেক্ষমান থাকে। কিন্তু যখন তারা প্রত্যক্ষ করল যে, পরিস্থিতি ক্রমেই মুসলিমগণের অনুকূলে যাচ্ছে এবং তাঁদের শাসন ক্ষমতা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে তখন তারা হিংসার আগুনে জ্বলেপুড়ে মরতে লাগল এবং নানা প্রকার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল। শেষ বারের মতো মুসলিমগণকে এমন এক চরম আঘাত হানার জন্য তারা প্রস্তুতি শুরু করে দিল যাতে তাঁদের জীবন প্রদীপ চিরতরে নির্বাপিত হয়ে যায়। কিন্তু যেহেতু মুসলিমগণের সঙ্গে সরাসরি মোকাবেলা করার সাহস তাদের ছিল না সেহেতু এক অত্যন্ত বিপজ্জনক পন্থা অবলম্বন করলকুরাইশদের সাথে বনু নাজির ও বনু কাইনুকা জোট গঠন করে মদিনা আক্রমণ করেছিল। ইতিপূর্বে বনু নাজির ও বনু কাইনুকা গোত্রকে বিশ্বাসঘাতকতার কারণে মদিনা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তাই প্রতিশোধ হিসেবে তারা কুরাইশদের সাথে জোট গঠন করে।

বনু নাযীর গোত্রের ২০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি মক্কার কুরাইশগণের নিকট উপস্থিত হয়ে রাসূলুল্লাহ ()-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার জন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করতে থাকে এবং যুদ্ধে তাদের সাহায্য সহযোগিতা করার জন্যও নিশ্চয়তা প্রদান করে। সেহেতু উহুদ যুদ্ধের দিন কুরাইশরা পুনরায় মুসলিমগণের সঙ্গে বদরে মোকাবেলা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা পালন করতে ব্যর্থ হয় এবং এর ফলে যোদ্ধা হিসেবে তাদের যে সুখ্যাতির হানি হয় তা পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যেই বনু নাযীরের প্রস্তাব তাদের উৎসাহিত করে এবং তারা তা মেনে নেয়।

এরপর ইহুদীগণের এ দলটি বনু গাত্বাফান গোত্রের নিকট যায় এবং কুরাইশদের মতো তাদেরকেও যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে থাকে। এ প্রেক্ষিতে তারাও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। অধিকন্তু, এ প্রতিনিধি দলটি আরবের অবশিষ্ট গোত্রগুলোর নিকট ঘোরাফিরা করে তাদেরকেও যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ এবং উৎসাহিত করতে থাকে। যার ফলে তারা অনেকেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। এভাবে ইহুদীগণ অত্যন্ত কার্যকরভাবে নাবী কারীম (), ইসলামী দাওয়াত এবং মুসলিমগণের বিরুদ্ধে কাফির মুশরিকদের বড় বড় গোত্র এবং দলগুলোকে উত্তেজিত ও উদ্বুদ্ধ করে যুদ্ধের জন্য তৈরি করে নেয়।

অতঃপর নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী দক্ষিণদিক হতে কুরাইশ কিনানাহ এবং তুহামায় বসবাসরত দ্বিতীয় হালিফ (চুক্তিবদ্ধ) গোত্রসমূহ মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হয়ে যায়। এদের সংখ্যা ছিল চার হাজার এবং সার্বিক নেতৃত্বে ছিল আবূ সুফইয়ান। এ বাহিনী মাররুয যাহরান গিয়ে পৌঁছলে বনু সুলাইম গোত্র এসে তাদের সঙ্গে যোগদান করে। ঐ সময় পূর্বদিক হতে গাত্বাফানী গোত্র ফাযারা, মুররাহ এবং আশজা গোত্র রওয়ানা হয়ে যায়। ফাযারাহর সেনাপতি ছিলেন উয়াইনাহ বিন হাসান, মুররাহর গোত্রের নেতৃত্বে ছিল হারিস বিন আউফ এবং বনু আশজা গোত্রের নেতৃত্বে ছিল মিসআর বিন রুহাইলাহ। তাদের নেতৃত্বাধীনে বনু আসাদ এবং অন্যান্য বিভিন্ন গোত্রের অনেক লোকজনও এসেছিল।

উল্লেখিত গোত্রগুলো একটি নির্দিষ্ট সময় এবং নির্ধারিত কর্মসূচি মোতাবেক মদীনা অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছিল। এ প্রেক্ষিতে কয়েক দিনের মধ্যেই মদীনার আশপাশে দশ হাজার সৈন্যের এক দুর্ধর্ষ বাহিনী সমবেত হল। তারা এত বেশী সংখ্যক সৈন্য সংগ্রহ করেছিল যে মদীনার মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ ও যুবকের সমষ্টিগত সংখ্যার চাইতেও তাদের সৈন্য সংখ্যা ছিল বেশী। শত্রুপক্ষের এ সৈন্য সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ যদি আকস্মিকভাবে মদীনার দেয়াল পর্যন্ত পৌঁছে যেত তাহলে মুসলিমগণের জন্য তা হতো অত্যন্ত বিপজ্জনক। তখন এতে আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছুই থাকত না যে, মুসলিমগণের মূলোৎপাটন করে তাঁদের সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হত।

কিন্তু মদীনার নেতৃত্ব ছিল অত্যন্ত সজাগ ও সচেতন মস্তিস্ক এবং পরিচালনা ছিল নিচ্ছিদ্র যত্মশীল। তাঁর সচেতন হস্তের আঙ্গুলগুলো সর্বক্ষণ পরিস্থিতির নাড়ির গতির উপর ছিল বিদ্যমান। পরিস্থিতির গতিধারার প্রেক্ষাপটে সংঘটিত ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার ঠিক ঠিক আঁচ অনুমান ও তথ্য পরিবেশন এবং তা থেকে মুক্ত থাকার জন্য তিনি উপযুক্ত সময়ে যথার্থ পদক্ষেপ অবলম্বন করে আসছিলেন। কাজেই কাফিরদের বিশাল বাহিনী যখনই মদীনা অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার জন্য সচেষ্ট হল তখনই মদীনার সংবাদ সরবরাহকারীগণ পরিচালকের নিকট ত্বরিৎ সংবাদ পরিবেশন করলেন।

সংবাদ প্রাপ্ত হওয়া মাত্রই রাসূলুল্লাহ () নেতৃস্থানীয় সাহাবাগণের পরামর্শ বৈঠক আহবান করেন এবং প্রতিরোধ সংক্রান্ত পরিকল্পনার ব্যাপারে সলা পরামর্শ করেন। শুরার প্রতিনিধিগণ অনেক চিন্তা ভাবনার পর সর্বসম্মতক্রমে সালামাহন ফারসী (রাঃ)-এর একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেন। সালামাহন ফারসীর (রাঃ) প্রস্তাবটির ভাষ্য ছিল নিম্নরূপ :

হে আল্লাহর রাসূল ()! পারস্যে যখন আমাদেরকে অবরোধ করা হতো তখন আমরা আমাদের পার্শ্ববর্তী স্থানে পরিখা খনন করে নিতাম। খন্দক শব্দের অর্থ পরিখা বা গর্ত। যেহেতু এ যুদ্ধে অনেক পরিখা খনন করা হয়, তাই এর নাম দেওয়া হয়েছে খন্দকের যুদ্ধ। এ যুদ্ধ আহজাব নামেও পরিচিত। আহজাব অর্থ সম্মিলিত বাহিনী।

প্রতিরোধ সংক্রান্ত এ প্রস্তাবটি ছিল অত্যন্ত হেকমতপূর্ণ ও সম্ভাবনাময়। আরববাসীগণ এ প্রস্তাবের হেকমত সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। এ প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাসূলুল্লাহ () তা বাস্তবায়ণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ অবলম্বন করেন। এতে প্রতি দশ জনের উপর ৪০ (চল্লিশ) হাত পরিখা খননের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। দায়িত্ব প্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে মুসলিমগণ অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পরিখা খননে আত্মনিয়োগ করেন। নাবী কারীম () এ কাজে সকলকে উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করতে থাকেন এবং নিজেও পুরোপুরিভাবে ওতে অংশগ্রহণ করেন। সাহল বিন সাদ হতে বুখারী শরীফে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ ()-এর সঙ্গে আমরা খন্দকে ছিলাম। লোকজনেরা খনন করছিলেন এবং আমরা কাঁধে করে মাটি বহন করছিলাম।

শত্রুপক্ষের সঙ্গে মোকাবেলার উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ () তিন হাজার সৈন্যের এক বাহিনীসহ অগ্রসর হলেন এবং সালা পর্বতকে পিছনে রেখে শিবির স্থাপন করলেন, সম্মুখভাগে ছিল খন্দক যা মুসলিম এবং কাফিরদের মধ্যে একটি প্রতিবন্ধক প্রাচীর হিসেবে বিদ্যমান ছিল। মুসলিম প্রতীক চিহ্ন (কোড পরিভাষা) ছিল হামীম, তাদেরকে সাহায্য করা হবে না। এ সময় মদীনার দায়িত্বভার অর্পণ করা হয় ইবনু উম্মু মাকতুমের উপর। মদীনার মহিলা এবং শিশুদেরকে নগরের দূর্গ ও গর্তসমূহে সুরক্ষিত রাখা হয়।

আক্রমণের উদ্দেশ্যে মুশরিকগণ যখন মদীনার দিকে অগ্রসর হল তখন প্রত্যক্ষ করল যে, একটি প্রশস্ত পরিখা তাদের এবং মুসলিমগণের মধ্যে প্রতিবন্ধক হিসেবে বিদ্যমান রয়েছে। অনন্যোপায় হয়ে তাদেরকে অবরোধ সৃষ্টির কথা ভাবতে হল অথচ যুদ্ধের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার সময় এ রকম কোন চিন্তা ভাবনা কিংবা প্রস্তুতি তাদের ছিল না। কারণ প্রতিরোধের এ পরিকল্পনা তাদের নিজেদের কথা অনুযায়ী এমন একটি চাতুর্যপূর্ণ কৌশল যে সম্পর্কে আরবগণের কোন ধারণা ছিল না। কাজেই, এ ধরণের রণ-কৌশল সম্পর্কে তারা চিন্তাই করে নি।

খন্দকের নিকট উপস্থিত হয়ে মুশকিরগণ তাদের ধারণাতীত এ রণ-কৌশল প্রত্যক্ষ করে অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে উঠল এবং ক্ষিপ্রতার সঙ্গে চক্কর দিতে থাকল। এ অবস্থায় তারা এমন কোন দুর্বল স্থানের অনুসন্ধান করছিল যেখান দিয়ে অবতরণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হতে পারে। এদিকে মুসলিমগণ তাদের গতিবিধির প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখাছিলেন এবং তারা যাতে খন্দকের নিকটবর্তী হতে সাহসী না হয় এ উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝে তীর নিক্ষেপ করছিলেন যাতে তারা খন্দকের মধ্যে লাফ দিয়ে পড়তে কিংবা অংশ বিশেষ ভরাট করে ফেলে পথ তৈরি করে নিতে না পারে।

এদিকে কুরাইশ আশ্বারোহীগণ এটা কিছুতেই সহ্য করতে পারছিল না যে খন্দকের পাশে অবরোধ সৃষ্টি করে ফলাফলের আশায় অনর্থক অনির্দিষ্ট কাল যাবৎ তারা বসে থাকবে। এ জাতীয় ব্যবস্থা ছিল তাদের অভ্যাস ও শানের সম্পূর্ণ বিপরীত। কাজেই, তাদের একটি দল যার মধ্যে ছিল আমর বিন আবদে উদ্দ, ইকরামা বিন আবূ জাহল এবং যারবার বিন খাত্তাব একটি সংকীর্ণ স্থান দিয়ে খন্দক পার হয়ে গেল এবং তাদের ঘোড়াগুলোও সালায়ার মধ্যবর্তী স্থানে চক্কর দিতে থাকল। পক্ষান্তরে আলী এবং কয়েকজন সাহাবী (রাঃ) খন্দকের যে অংশ দিয়ে তারা প্রবেশ করেছিল সেখানে অবস্থান নিয়ে তাদের পথ বন্ধ করে দিলেন। এর প্রেক্ষিতে আমর বিন আবদে উদ্দ সামনা সামনি মোকাবেলার জন্য উচ্চ কণ্ঠে আহবান জানাল। আলী (রাঃ) তার সঙ্গে মোকাবেলার জন্যে মুখোমুখী হয়ে এমন এক বাক্য উচ্চারণ করেন যার ফলে অত্যন্ত ক্রোধান্বিত অবস্থায় সে ঘোড়া হতে লাফ দিয়ে অবতরণ করে। সে অশ্বের পদযুগল কর্তন ও অবয়ব বিকৃত করত- সে অন্যতম বীর ও সাহসী মুশরিক ছিল। আলী (রাঃ)-এর সম্মুখে এসে পড়ে। অতঃপর উভয়ের মধ্যে শুরু হল মোকাবেলা। চলল উভয়ের মধ্যে আক্রমণ ও প্রতি আক্রমণের পালা। অবশেষে প্রবল আঘাত হেনে আলী (রাঃ) তাকে হত্যা করেন। এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে অন্যান্য মুশরিকগণ ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় খন্দক পেরিয়ে পলায়ন করে। তারা এতই ভীত হয়ে পড়েছিল যে, পলায়নের সময় ইকরামা তার বর্শা ফেলে দিয়ে পলায়ন করে।

মুশরিকগণ কোন কোন সময় খন্দক অতিক্রম করে যাওয়ার কিংবা এর প্রশস্ততা কমিয়ে পথ তৈরি করে নেয়ার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু মুসলিমগণও খন্দক থেকে তাদের দূরে রাখার লক্ষে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিভিন্ন ব্যবস্থা অবলম্বন করে যেতে থাকেন। তারা অদম্য সাহস এবং দক্ষতার সঙ্গে তীর নিক্ষেপ করেন এবং প্রতিপক্ষের তীরন্দাযির মোকাবেলা করে তাদের সকল প্রকার প্রচেষ্টাকে বিফল করে দেন।

এখান থেকে এ কথাও প্রমাণিত হয় যে, মুশরিকগণের পক্ষ থেকে খন্দক অতিক্রম করার প্রচেষ্টা এবং মুসলিমগণের পক্ষ থেকে অব্যাহত প্রতিরোধ কয়েক দিন পর্যন্ত চালু ছিল একটি বিরাট প্রতিবন্ধক, এই জন্যে সামানাসামনি সংগ্রামের সুযোগ সৃষ্টি হয় নি। যুদ্ধের গতিধারা তীর নিক্ষেপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

অবশ্য, তীর নিক্ষেপের ফলে উভয় পক্ষেরই কয়েক ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করতে হয় কিন্তু তাদের সংখ্যা আঙ্গুলে গণনা করা সম্ভব। মুসলিম মৃত ব্যক্তিদের সংখ্যা ছিল ছয় জন এবং মুশরিকদের পক্ষে দশ জন। এর মধ্যে এক কিংবা দুজন তরবারির আঘাতে নিহত হয়েছিল।

ঐ দুপ্রতিপক্ষ দলের পরস্পর পরস্পরের প্রতি তীর নিক্ষেপের এক পর্যায়ে সাদ বিন মুআয তীরবিদ্ধ হন। তীরের আঘাতে তাঁর হাতের মূল শিরা কর্তিত হয়। হেববান বিন আরাক নামক এক কুরাইশীর তীরের আঘাতে তিনি আহত হনআহত হওয়ার পর তিনি প্রার্থনা করেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি জানো যে, যে সম্প্রদায় তোমার রাসূল ()-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে এবং তাকে দেশ হতে বাহির করে দিয়েছে, তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার ব্যাপারটি আমার নিকট যত প্রিয়, অন্য কোন সম্প্রদায়ের নিকট ততটা প্রিয় নয়। হে আল্লাহ! আমি মনে করি যে, এখন তুমি তাদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধকে শেষ পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছ। কিন্তু যুদ্ধের ব্যাপারে এখনো যদি কোন কিছু অবশিষ্ট থাকে তাহলে আমাকে তাদের জন্য অবশিষ্ট রেখে দাও যেন আমি তাদের সঙ্গে জিহাদে লিপ্ত হতে পারি। আর যদি তুমি যুদ্ধ শেষ করে থাক তাহলে এ আঘাতকে বাকী রেখে এটাকে আমার মৃত্যুর কারণ করে দাও।[15] তিনি তাঁর দুআয় সর্বশেষে বলেছেন, বনু কুরাইযাহর ব্যাপারে আমার চক্ষু শীতল না হওয়া পর্যন্ত আমাকে মৃত্যু দিও না।

যে প্রকারেই হোক এক দিকে মুসলিমগণ শত্রুদের সামনাসামনি হয়ে উদ্ভূত সমস্যাবলী সমাধানে তৎপর রয়েছেন, অন্য দিকে ষড়যন্ত্রকারী এবং কপটদের শঠতা স্বর্প আপন গর্তের মধ্যে কুন্ডলী পাকাচ্ছে এবং প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে যে, তারা মুসলিমগণের দেহে গরল ঢেলে দেবে। যেমন বনু নাযীরের বড় অপরাধী হুওয়ায় বিন আখতাব বনু কুরাইযাহর আবাসস্থলে এসে তাদের নেতা কাব বিন আসাদ কোরযীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এ কাব বিন আসাদ হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে বনু কোরাইয়ার পক্ষ থেকে অঙ্গীকার পালনের অধিকার রাখত এবং যে রাসূলুল্লাহ ()-এর সঙ্গে এ চুক্তি করেছিল যে, যুদ্ধের সময় সে তাঁকে সাহায্য করবে। (যেমনটি ইতোপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে) হুওয়ায় এসে যখন দরজায় করাঘাত করে তখন সে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু হুওয়ায় তার সঙ্গে এমন এমন সব কথাবার্তা বলতে থাকে যে, শেষ পর্যন্ত তাঁর জন্য সে দরজা খুলে দেয়। হুওয়ায় বলল, ‘হে কাব! আমি তোমার নিকট যুগের ইজ্জত এবং জোয়ারের সাগর নিয়ে এসেছি। আমি নেতা ও পরিচালকগণসহ মুশরিকদেরকে নিয়ে এসে রুমার মাজমাউল আসয়ালে অবতরণ করিয়েছি। তাছাড়া, বনু গাত্বাফানকে তাদের পরিচালক ও নেতৃবৃন্দসহ উহুদের নিকট যামবে নাকমীতে শিবির স্থাপন করেছি। তারা আমার সঙ্গে এ মর্মে অঙ্গীকার করেছে,

মুহাম্মাদ এবং তার সঙ্গী সাথীদের সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত তারা এখান থেকে ফিরে যাবে না।

কাব বলল, ‘আল্লাহর কসম! তুমি আমার নিকট যুগের অপমান এবং বর্ষণ-মুখর মেঘমালা নিয়ে এসেছ যা শুধু বিজলীর চমক দিচ্ছে। কিন্তু ওর মধ্যে ফলোৎপাদক কিছুই নেই; হুওয়াই, আমি দুঃখিত আমাকে আমার আপন অবস্থার উপর থাকতে দাও। আমি মুহাম্মাদ ()-এর মধ্যে সততা ও বিশ্বাস রক্ষা ছাড়া অন্য কোন কিছুই দেখি নি।

কিন্তু হুওয়াই অনবরত তার চুলের খোপা এবং কাঁধের মধ্যে মোচড় দিতে এবং ফুসলাতে থাকল। এভাবেই তাকে বশীভূত করে ফেলল। অবশ্য এ ব্যাপারে হুওয়াইকে কাবের সঙ্গে একটি অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে হয়। অঙ্গীকারটি ছিল এরূপ যে, কুরাইশগণ যদি মুহাম্মাদ ()-কে হত্যা না করে ফিরে আসার পথ ধরে তাহলে সেও তাদের সঙ্গে তাদের দূর্গে প্রবেশ করবে। অতঃপর তাদের অবস্থা যা হবে তারও তাই হবে। উভয়ের এ অঙ্গীকারের ফলে রাসূলুল্লাহ ()-এর সঙ্গে কাবের সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ হয়ে যায় এবং এর ফলে মুসলিমগণের সহযোগী হয়ে দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে তাদের শত্রুদের পক্ষাবলম্বন করে।এরপর বনু কুরাইযাহর ইহুদীগণ প্রকৃত পক্ষে যুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কাজ কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে।

রাসূলুল্লাহ () নিম্নরূপ দুআ করেছিলেন : হে আল্লাহ! হে কিতাব অবতীর্ণকারী! দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী! এ সেনাবাহিনীকে পরাভূত করুন। হে আল্লাহ! তাদেরকে পরাভূত করুন এবং প্রকম্পিত করুন।

অবশেষে আল্লাহ আপন রাসূল () এবং মুসলিমদের দুআ কবুল করে মুশরিকদের ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি করেন এবং মনোবল ভেঙ্গে দেন। অতঃপর তাদের উপর উত্তপ্ত বায়ুর তুফান প্রেরণ করেন। যা তাদের তাঁবু উপড়িয়ে দেয়, মৃত পাত্রসমূহ উলটিয়ে দেয়, তাঁবুর খুঁটিসমূহ উৎপাটন করে ফেলে এবং সব কিছুকে তছনছ করে ফেলে। এর সঙ্গে প্রেরণ করেন ফিরিশতা বাহিনী যাঁরা তাদের অবস্থানকে নড়চড় করে দেন এবং অন্তরে ত্রাসের সঞ্চার করেন

সেই তীব্র শীতের রাত্রিতে রাসূলুল্লাহ () হুযায়ফা বিন ইয়ামান (রাঃ)-কে প্রেরণ করেন মুশরিকদের সংবাদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। তিনি যখন তাদের সমাবেশ স্থলের নিকট পৌঁছেন তখন প্রত্যক্ষ করেন যে, প্রত্যাবর্তনের জন্য তাঁদের প্রস্তুতিপর্ব প্রায় সম্পন্ন। হুযায়ফা নাবী কারীম ()-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে তাদের ফেরৎ যাত্রা সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করেন। প্রভাতে রাসূলুল্লাহ () প্রত্যক্ষ করেন যে, তাদের প্রত্যাবর্তনের ফলে ময়দান একদম পরিষ্কার হয়ে গেছে। কোন প্রকার সাফল্য লাভ ছাড়াই গভীর অসন্তোষ এবং ক্রোধসহ মুসলিমগণের শত্রুদের আল্লাহ তাআলা ফেরৎ পাঠিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য একাকী যথেষ্ট হয়েছেন। মোট কথা এভাবে আল্লাহ আপন ওয়াদা পূরণ করেছেন এবং নিজ সৈন্যদের ইজ্জত প্রদান করেছেন। এ অবস্থার প্রেক্ষাপটে রাসূলুল্লাহ () মদীনা প্রত্যাবর্তন করেন।

বিশুদ্ধ মতে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ৫ম হিজরীর শাওয়াল মাসে এবং মুশগিরকগণ আনুমানিক এক মাস যাবৎ রাসূলুল্লাহ () এবং মুসলিমগণকে অবরোধ করে রেখেছিল। অবরোধের সময় কেউ বলেছেন ২৪ দিন, অন্য বর্ণনায় ১৫ দিন পাওয়া যায়।প্রাপ্ত উৎসগুলোর উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে এটা প্রতীয়মান হয় যে, অবরোধ সূচিত হয়েছিল শাওয়াল মাসে এবং এর পরিসমাপ্তি ঘটেছিল জুল কাদা মাসে। ইতিহাসবিদ ইবনু সায়াদের বর্ণনায় আছে যে, রাসূলুল্লাহ () যে দিন খন্দক থেকে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন সে দিনটি ছিল বুধবার এবং জুলকাদা মাস শেষ হতে অবশিষ্ট ছিল সাত দিন।

আহযাব যুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে ক্ষয়ক্ষতির যুদ্ধ ছিল না, বরং সেটা প্রকৃত পক্ষে স্নায়ুযুদ্ধ ছিলআহজাব যুদ্ধে ৮ জন মুসলিম শহীদ হন। অন্যদিকে, শত্রুপক্ষে ৪ জন মারা যায়।ইসলামের ইতিহাসে এ যুদ্ধ ছিল একটি যুগান্তকারী ঘটনা।খন্দক যুদ্ধ সম্পর্কে আল্লাহপাক সুরা আহজাবে ৯ থেকে ২৭ পর্যন্ত ১৯টি আয়াত নাজিল করেন, যাতে এই যুদ্ধের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। খন্দক আমাদের এই শিক্ষা দেয়ইমান ও ধৈর্যের সঙ্গে আল্লাহর ওপর আস্থা স্থাপন করলে আল্লাহর রহমত থেকে কেউ বঞ্চিত হয় না। এ যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে মুশরিকদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে এবং সর্ব সমক্ষে এটা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, আরবের কোন শক্তির পক্ষেই মদীনার মুসলিমগণের ক্রমবিকাশমান এ শক্তিকে নিঃশেষ করা সম্ভব নয়। কারণ, আহযাব যুদ্ধের জন্য বিশাল বাহিনী সংগৃহীত হয়েছিল, এর চাইতে অধিক শক্তিশালী বাহিনী সংগ্রহ করা তাদের জন্য সম্ভবপর ছিল না।এ জন্য আহযাব থেকে প্রত্যাবর্তনের পর রাসূলুল্লাহ () বলেন,‘এখন থেকে আমরাই তাদের উপর আক্রমণ করব, তারা আমাদের উপর আক্রমণ করবে না। এখন আমাদের সৈন্যরা তাদের দিকে যাবে।’ (সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৫৯০ পৃঃ)

 

বনু কুরাইজা  (৫ম হিজরীর যিলহাজ্জ )

কিতাবধারীদের মধ্যে যারা ওদের সাহায্য করেছিল তাদের তিনি তাদের দুর্গ থেকে অবতরণ করালেন এবং তাদের অন্তরে ভীতি সঞ্চার করলেন। এখন তোমরা তাদের কতককে হত্যা করেছ আর কতককে করেছ বন্দি। আর তিনি তোমাদের অধিকারী করলেন ওদের ভূমি, ঘরবাড়ি ও ধন-সম্পদের এবং এমন ভূমির যাতে তোমরা এখনও পদার্পণ করোনি। আল্লাহ প্রত্যেক সব কিছুর ওপর সর্বশক্তিমান’ (সুরা আহজাব, আয়াত : ২৬-২৭)

মদীনায় অবস্থিত তিনটি ইহূদী গোত্রের সর্বশেষ গোত্রটি ছিল বনু কুরাইজা তারা ছিল আউস গোত্রের মিত্র। এদের সঙ্গে রাসূল (সা)-এর চুক্তি ছিল যে, তারা বহিঃশত্রুর আক্রমণ কালে সর্বদা রাসূল (সা)-কে সাহায্য করবে। গোত্রনেতা কাব বিন আসাদ আল-কুরাযী নিজে উক্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। তাদের বাসস্থান ছিল মুসলিম আবাসিক এলাকার পিছনে। মাসব্যাপী খন্দক যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তারা মুসলিম বাহিনীকে কোনরূপ সাহায্য করেনি। মুনাফিকদের ন্যায় তারাও যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করছিল। ইতিমধ্যে বিতাড়িত বনু নাযীর ইহূদী গোত্রের নেতা হুয়াই বিন আখত্বাব খায়বর থেকে অতি সঙ্গোপনে বনু কুরায়যার দুর্গে আগমন করে এবং তাদেরকে নানাভাবে মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে ফুসলাতে থাকে। সে তাদেরকে বুঝায় যে, কুরাইশের নেতৃত্বে সমস্ত আরবের দুর্ধর্ষ সেনাদল সাগরের জোয়ারের মত মদীনার উপকণ্ঠে সমবেত হয়েছে। তারা সবাই এই মর্মে আমার সাথে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছে যে মুহাম্মাদ ও তাঁর সাথীদের উৎখাত না করা পর্যন্ত তারা ফিরে যাবে নাকাব বিন আসাদ দুর্গের দরজা বন্ধ করে দেন ও বারবার তাকে ফিরে যেতে বলেন এবং মুহাম্মাদের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করবেন না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেনকিন্তু ধুরন্ধর হুয়াইয়ের অব্যাহত চাপ ও তোষামোদীতে অবশেষে তিনি কাবু হয়ে পড়েন। তখন একটি শর্তে তিনি রাযী হন যে, যদি কুরায়েশ ও গাতফানীরা ফিরে যায় এবং মুহাম্মাদকে কাবু করতে না পারে, তাহলে হুয়াই তাদের সঙ্গে তাদের দুর্গে থেকে যাবেন। হুয়াই এ শর্ত মেনে নেন এবং বনু কুরাইজা  চুক্তিভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়। এখবর রাসূল (ছাঃ)-এর কর্ণগোচর হলে তিনি আউস ও খাযরাজ গোত্রের দুনেতা সাদ বিন মুআয ও সাদ বিন ওবাদাহ এবং আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা ও খাউয়াত বিন জুবায়েরকে পাঠান সঠিক তথ্য অনুসন্ধানের জন্য। তিনি তাদেরকে বলে দেন যে, চুক্তিভঙ্গের খবর সঠিক হলে তারা যেন তাকে এসে ইঙ্গিতে জানিয়ে দেয় এবং অন্যের নিকটে প্রকাশ না করে। তারা সন্ধান নিয়ে এসে রাসূল (ছাঃ)-কে বললেন,অর্থাৎ রাজী‘-এর আযাল ও ক্বাররাহ গোত্রদ্বয়ের ন্যায় বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনা ঘটেছে

খন্দক যুদ্ধ থেকে ফিরে এসেই রাসুল (সা.) পঞ্চম হিজরির জিলকদ মাসে বনু কুরাইজার সঙ্গে যুদ্ধের নির্দেশ পান। বনু কুরাইজা ছিল মদিনা শরিফের ইহুদি গোত্র। খন্দকের যুদ্ধ  থেকে যেদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রত্যাবর্তন করলেন সে দিন যুহরের সময় যখন তিনি উম্মু সালামাহ (রাঃ)-এর গৃহে গোসল করছিলেন তখন জিবরাঈল (আঃ) আগমন করলেন এবং বললেন, ‘আপনি কি অস্ত্রশস্ত্র খুলে রেখে দিয়েছেন? ফিরিশতাগণ কিন্তু এখনো অস্ত্রশস্ত্র খোলেন নি। আমিও শত্রুদের পশ্চাদ্ধাবন করে সরাসরি এখানেই চলে আসছি। উঠুন এবং স্বীয় সঙ্গীসাথীদের নিয়ে বনু কুরাইযা অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকুন। আমি অগ্রভাগে গিয়ে তাদের দূর্গসমূহে কম্পন সৃষ্টি করে তাদের অন্তরে ভয় ভীতির সঞ্চার করে দিব।রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে এ সকল কথা বলার পর জিবরাঈল (আঃ) ফিরিশতাগণের দলভুক্ত হয়ে যাত্রা করলেন। ইবনু উম্মু মাকতুম (রাঃ)-এর উপর মদীনার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব অর্পণ করলেন এবং আলী (রাঃ)-এর হাতে যুদ্ধের পতাকা দিয়ে বুন কুরাইযা অভিমুখে প্রেরণ করলেন। বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে মুসলিম সৈন্যদল বনু কুরাইযাহ ভূমিতে গিয়ে পৌঁছলেন এবং নাবী কারীম -এর সঙ্গে মিলিত হলেন। অতঃপর বনু কুরাইযাহর দূর্গসমূহকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেললেন। মুসলিম বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল তিন হাজার এবং অশ্বের সংখ্যা ছিল ত্রিশটি। অবরোধকালে বনু কুরাইজার জনৈকা মহিলা যাঁতার পাট নিক্ষেপ করে সাহাবি খাল্লাদ বিন সুওয়াইদকে হত্যা করে। এর বদলা স্বরূপ পরে উক্ত মহিলাকে হত্যা করা হয়। খাল্লাদ ছিলেন এই যুদ্ধে একমাত্র শহীদ। তিনি বদর, ওহুদ, খন্দক ও বনু কুরাইজার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

 

বনু কুরাইযার ইহুদীগণ যখন আঁটষাট অবরুদ্ধ অবস্থার মধ্যে নিপতিত হল তখন ইহুদী নেতা কাব বিন আসাদ তাদের সামনে তিনটি পরিবর্তনশীল প্রস্তাব উপস্থাপন করল। সেগুলো হচ্ছে যথাক্রমে:

১। হয় ইসলাম গ্রহণ করে মুহাম্মাদ (সা)-এর দ্বীনে প্রবেশ করে স্বীয় জানমাল এবং সন্তান সন্ততির ধ্বংস প্রাপ্তি থেকে রক্ষা করবে, এ প্রস্তাব উপস্থাপন কালে কাব বিন আসাদ এ কথাও বলেছিল যে, ‘আল্লাহর শপথ! তোমাদের নিকট এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তিনি হচ্ছেন প্রকৃতই একজন নাবী এবং রাসূল। অধিকন্তু তিনি হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যার সম্পর্কে তোমরা স্বীয় আল্লাহর কিতাবে অবগত হয়েছ।

২। অথবা স্বীয় সন্তান সন্তুতিগণকে স্বহস্তে হত্যা করবে। অতঃপর তলোয়ার উত্তোলন করে নাবী (সা)-এর দিকে অগ্রসর হয়ে সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে যুদ্ধ করবে। পরিণামে হয় আমরা বিজয়ী হব, নতুবা সমূলে নিঃশেষ হয়ে যাব।

৩। অথবা রাসূলুল্লাহ (সা) এবং সাহাবা কেরাম (সা)-কে ধোঁকা দিয়ে শনিবার দিবস তাঁদের উপর আক্রমণ পরিচালনা করবে। কারণ এ ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিন্ত থাকবেন যে, এ দিবসে কোন যুদ্ধ বিগ্রহ অনুষ্ঠিত হবে না।

কিন্তু ইহুদীগণ এ তিনটি প্রস্তাবের একটিও মঞ্জুর করল না। 

২৫ দিন অবরোধের পর তারা আত্মসমর্পণ করে এবং তাদের মিত্র সাদ বিন মুআযের সিদ্ধান্ত মতে পুরুষদের হত্যা করা হোক, মহিলা ও শিশুদের বন্দী করে রাখা হোক এবং সম্পদসমূহ বন্টন করে দেয়া হোক। এতে বয়স্ক পুরুষ বন্দী ছয় থেকে সাত শতের মত লোককে হত্যা করা হয়। বাকীদের বহিষ্কার করা হয়। এই অবরোধকালে মুসলিম পক্ষে একজন শহীদ ও একজন স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যে হযরত সাদ বিন মুআয (রাঃ) মৃত্যু বরণ করেন। যিনি ইতিপূর্বে খন্দকের যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন।সা'দের এ বিচার ছিল অত্যন্ত ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিক। কারণ, বনু কুরাইযা মুসলিমগণের জীবন মরণের জন্য অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতিতে যা করতে চেয়েছিলেন তা ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ ও বিভীষিকাময়। অঙ্গীকার ভঙ্গের একটি জঘন্য অপরাধও তারা করেছিল। অধিকন্তু, মুসলিমগণকে নিঃশেষ করে ফেলার জন্য তারা দেড় হাজার তরবারী, দুই হাজার বর্শা, যুদ্ধে ব্যবহারোপযোগী তিন শত লৌহবর্ম এবং পাঁচ শত প্রতিরক্ষা ঢাল সংগ্রহ করে রেখেছিল। পরবর্তী কালে সেগুলো মুসলিমগণের অধিকারে আসে। বনু কুরাইযাহর অবরোধ কালে একজন মুসলিম শহীদ হন। তাঁর নাম ছিল খাল্লাদ বিন সুওয়াইদ। তিনি ছিলেন সে সাহাবী যাঁর উপর বনু কুরায়যার এক স্ত্রীলোক যাঁতার একটি পাট নিক্ষেপ করেছিল। এছাড়া হযরত উকাশার ভাই আবূ সিনান বিন মিহসান এ অবরোধকালে মৃত্যু বরণ করেন।

কাব বিন আশরাফকে হত্যা

তৃতীয় হিজরি মোতাবেক ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। নবীজি (সা.) তখন জীবিত। কাব বিন আশরাফ নামক ইহুদি নবীজি (সা.)-এর শানে অমার্জিত কথাবার্তা বলতে থাকে। তাঁর শানে কুৎসামূলক কবিতা আবৃত্তি করে। ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করে। নবীজি (সা.)-কে হত্যাচেষ্টাসহ বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক কাজ করতে থাকে। ফলে নবীজি (সা.) তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার নির্দেশ দেন। মুহাম্মদ বিন মাসলামা (রা.) কয়েকজন সাহাবির সহযোগিতায় তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন। (বুখারি : ২/৫৭৬-৫৭৭, সিরাতে ইবনে     হিশাম : ২/৫১-৫৭, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৪/৬-১১) ইবনে ইসহাকের বর্ণনা অনুযায়ী, রাসু্লুল্লাহ (সা) কাবকে হত্যা করার জন্য তার অনুসারীদেরকে নির্দেশনা দেন, এর কারণ; কাবের প্রেরিত একটি চিঠি বদর যুদ্ধের পর মক্কায় পৌঁছেছিলো এবং তা মুহাম্মদের বিরুদ্ধে কুয়াইশদেরকে খেপিয়ে দিয়েছিল। সে এমন কবিতাও লিখত যেগুলোতে সে বদর যুদ্ধে নিহত কুরাইশদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতো। মদিনা থেকে ফেরার অল্পদিন পরেই সে মুসলিম মহিলাদের প্রকৃতি সম্পর্কে কটাক্ষ করে কবিতা রচনা করে। অন্যান্য ঐতিহাসিক সূত্র দাবি করে যে, কাবকে হত্যা করার কারণ ছিল যে, সে রাসুল (সা) কে হত্যার জন্য একদল ইহুদির সঙ্গে গোপন পরিকল্পনা করেছিল। কাব বিন আশরাফকে হত্যার বিস্তারিত বর্ণনা সফিউর রহমান মোবারকপুরী তার গ্রন্থ আর রাহিকুল মাখতুম এ দিয়েছেন।

এ ছিল ইহুদীদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি, যে ইসলাম ও মুসলিমদের প্রতি অত্যন্ত শত্রুতা ও হিংসা পোষণ করত।  সে নবি (সা.) কে কষ্ট দিত এবং তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যভাবে যুদ্ধের হুমকি দিয়ে বেড়াত। তাইগোত্রের শাখা বনু নাবাহানের সাথে তার সম্পর্ক ছিল। আর তার মাতা বনু নাজির গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সে ছিল বড় ধনী ও পুঁজিপতি। আরবে তার সৌন্দর্য্যের খ্যাতি ছিল। সে একজন খ্যাতনামা কবিও ছিল। তার দূর্গটি মদীনার দক্ষিণে বনু নাজির গোত্রের আবাদী ভূমির পিছনে অবস্থিত ছিল।

বদর যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয় লাভ এবং নেতৃস্থানীয় কুরাইশদের নিহত হওয়ার প্রথম খবর শুনে সে অকস্মাৎ বলে ওঠে সত্যিই কি ঘটনা এটাই? এরা ছিল আরবের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি এবং জনগণের বাদশাহ। যদি মুহাম্মাদ (সা.) তাদেরকে হত্যা করে থাকে তবে পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগ ওর উপরিভাগ হতে উত্তম হবে অর্থাৎ আমাদের বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই উত্তম হবে।

তারপর যখন সে নিশ্চিতরূপে জানতে পারল যে, এটা সত্য খবর তখন আল্লাহর এ শত্রু রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং মুসলিমদের নিন্দা এবং ইসলামের শত্রুদের প্রশংসা করতে শুরু করল এবং তাদেরকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে লাগল। কিন্তু এতেও তার বিদ্বেষ বহ্ণি প্রশমিত না হওয়ায় সে অশ্বে আরোহণ করে কুরাইশদের নিকট গমন করল এবং মুত্তালিব ইবনু আবী অদাআ সাহমীর অতিথি হল। তারপর সে কুরাইশদের মর্যাদাবোধ উত্তেজিত করতে, তাদের প্রতিশোধাগ্নি প্রজ্জ্বলিত করতে এবং তাদেরকে নাবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্যে উৎসাহিত করতে কবিতা বলে বলে ঐ কুরাইশ নেতাদের জন্য বিলাপ করতে লাগল যাদের বদর প্রান্তরে হত্যা করার পর কূপে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। মক্কায় তার অবস্থান কালে আবূ সুফইয়ান ও মুশরিকরা তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার নিকট আমাদের দ্বীন বেশী পছন্দনীয়, না মুহাম্মাদ (সা.)- ও তাঁর সঙ্গীদের দ্বীন? আর উভয় দলের মধ্যে কোন্ দলটি বেশী হিদায়াত প্রাপ্ত?’ উত্তরে কাব ইবনু আশরাফ বলল তোমরাই তাদের চেয়ে বেশী হিদায়াত প্রাপ্ত এবং উত্তম। এ ব্যাপারেই আল্লাহ তাআলা আয়াত নাযিল করেন -

যাদেরকে কিতাবের জ্ঞানের একাংশ প্রদত্ত হয়েছে, সেই লোকেদের প্রতি তুমি কি লক্ষ্য করনি, তারা অমূলক যাদু, প্রতিমা ও তাগূতের প্রতি বিশ্বাস করে এবং কাফিরদের সম্বন্ধে বলে যে, তারা মুমিনগণের তুলনায় অধিক সঠিক পথে রয়েছে।’ (আন-নিসা আয়াত-  ৫১)

কাব ইবনু আশরাফ এ সব কিছু করে মদীনায় ফিরে এসে সাহাবায়ে কেরামের (রাঃ) স্ত্রীদের ব্যাপারে বাজে কবিতা বলতে শুরু করে এবং কট্যূক্তির মাধ্যমে তাঁদেরকে ভীষণ কষ্ট দিতে থাকে।

তা এ দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)  বললেন, ‘কে এমন আছে যে, কাব ইবনু আশরাফকে হত্যা করতে পারে? কেননা, সে আল্লাহ এবং তার রাসূল (সা.)-কে কষ্ট দিয়েছে এবং দিচ্ছে।

রাসূলুল্লাহ (সা.) এ প্রশ্নের জবাবে মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা (রাঃ), আব্বাদ ইবনু বিশর (রাঃ), আবূ নায়িলাহ (রাঃ) তার নাম সিলকান বিন সালামাহ যিনি ছিলেন কাবের দুধ ভাই, হারিস ইবনু আউস (রাঃ) এবং আবূ আবস ইবনু জাবর (রাঃ) এ খিদমতের জন্যে এগিয়ে আসেন। এ সংক্ষিপ্ত বাহিনীর নেতা ছিলেন মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ)।

কাব ইবনু আশরাফের হত্যার ব্যাপারে যে সব বর্ণনা রয়েছে ওগুলোর সারমর্ম হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন বললেন, ‘কাব ইবনু আশরাফকে কে হত্যা করতে পারে? সে আল্লাহ এবং তার রাসূল্লাহ (সা.)-কে কষ্ট দিয়েছে।তখন মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) উঠে আরয করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! আমি প্রস্তুত আছি। আমি তাকে হত্যা করব এটা কি আপনি চান?’ রাসূলুল্লাহ (সা.) জবাবে বললেন, ‘হ্যাঁতিনি বললেন, ‘তাহলে আপনি আমাকে অস্বাভাবিক কিছু বলার অনুমতি দিচ্ছেন কি?’

রাসূলুল্লাহ (সা.) উত্তরে বলেন, ‘হ্যাঁতুমি বলতে পার।

এরপর মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা (রাঃ) কাব ইবনু আশরাফির নিকট গমন করলেন এবং তাকে বললেন, ‘এ ব্যক্তি মুহাম্মাদ () আমাদের কাছে সাদকাহ চাচ্ছে এবং প্রকৃত কথা হচ্ছে সে আমাদেরকে কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

একথা শুনে কাব বলল, ‘আল্লাহর কসম! তোমাদের আরো বহু দুর্ভোগ পোহাতে হবে।

মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) বললেন, ‘আমরা যখন তার অনুসারী হয়েই গেছি তখন হঠাৎ করে এখনই তার সঙ্গ ত্যাগ করা উচিত মনে করছি না। পরিণামে কী হয় দেখাই যাক। আচ্ছা, আমি আপনার কাছে এক অসাক বা দুঅসাক (এক অসাক =১৫০ কেজি) খাদ্য শস্যের আবেদন করছি?’

কাব বলল আমার কাছে কিছু বন্ধক রাখো।

মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা (রাঃ) বললেন, ‘আপনি কী জিনিস বন্ধক রাখা পছন্দ করেন?’

কাব উত্তর দিলো, ‘তোমাদের নারীদেরকে আমার নিকট বন্ধক রাখো।

মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) বললেন, ‘আপনি আরবের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুদর্শন পুরুষ, সুতরাং আমরা আমাদের নারীদেরকে কিরূপে আপনার নিকট বন্ধক রাখতে পারি?’

সে বলল, ‘তাহলে তোমাদের পুত্রদেরকে বন্ধক রাখো।

মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) বললেন, ‘আমরা আমাদের পুত্রদেরকে কী করে বন্ধক রাখতে পারি? এরূপ করলে তাদেরকে গালি দেয়া হবে যে, এক অসাক বা দু অসাক খাদ্যের বিনিময়ে তাদেরকে বন্ধক রাখা হয়েছিল। এটা আমাদের জন্যে খুবই লজ্জার কথা হবে। আমরা অবশ্য আপনার কাছে অস্ত্র বন্ধক রাখতে পারি।

এরপর দুজনের মধ্যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো যে, মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) অস্ত্র নিয়ে তার কাছে আসবেন। এদিকে আবূ নায়িলাও (রাঃ) অগ্রসর হলেন অর্থাৎ কাব ইবনু আশরাফের কাছে আসলেন। কিছুক্ষণ পর্যন্ত উভয়ের মধ্যে বিভিন্ন দিকের কবিতা শোনা ও শোনানোর কাজ চললো। তারপর আবূ নায়িলা (রাঃ) বললেন, ‘ভাই ইবনু আশরাফ! আমি এক প্রয়োজনে এসেছি। এটা আপনাকে আমি বলতি চাচ্ছি এই শর্তে যে, আপনি কারো কাছে এটা প্রকাশ করবেন না।কাব বলল, ‘ঠিক আছে, আমি তাই করব।

আবূ নায়িলাহ (রাঃ) বললেন, ‘এ ব্যক্তির (মুহাম্মাদ(সা.)-এর) আগমন তো আমাদের জন্যে পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোটা আরব আমাদের শত্রু হয়ে গেছে। আমাদের পথ ঘাট বন্ধ হয়ে গেছে, পরিবার পরিজন ধ্বংস হতে চলেছে। সন্তান-সন্ততির কষ্টে আমরা চৌচির হচ্ছি।এরপর তিনি ঐ ধরণেরই কিছু আলাপ আলোচনা করলেন, যেমন মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা করেছিলেন। কথোপকথনের সময় আবূ নায়িলাহ (রাঃ) এ কথাও বলেছিলেন আমার কয়েকজন বন্ধু বান্ধব রয়েছে যাদের চিন্তাধারা ঠিক আমারই মত। আমি তাদেরকেও আপনার কাছে নিয়ে আসতে চাচ্ছি। আপনি তাদের হাতেও কিছু বিক্রি করুন এবং তাদের উপর অনুগ্রহ করুন।

মুহাম্মাদ ইবনু মাসালামা (রাঃ) এবং আবূ নায়িলাহ (রাঃ) নিজ নিজ কথোপকথনের মাধ্যমে নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনে সফলকাম হন। কেননা, ঐ কথোপকথনের পরে অস্ত্রশস্ত্র বন্ধু বান্ধবসহ এ দুজনের আগমনের কারণে কাব ইবনু আশরাফির সতর্ক হয়ে যাওয়ার কথা নয়। তারপর হিজরী ৩য় সনের রবিউল আওয়াল মাসের ১৪ তারীখে চাঁদনী রাতে এ ক্ষুদ্র বাহিনী রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট একত্রিত হন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বাকীয়ে গারকাদ পর্যন্ত তাঁদের অনুসরণ করেন। তারপর বলেন, ‘আল্লাহর নাম নিয়ে যাও। বিসমিল্লাহ। হে আল্লাহ! এদেরকে সাহায্য করুন।তারপর তিনি নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন। তারপর বাড়িতে তিনি সালাত ও মুনাজাতে লিপ্ত হয়ে পড়েন।

এদিকে এ বাহিনী কাব ইবনু আশরাফির দুর্গের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়ার পর আবূ নায়িলাহ (রাঃ) উচ্চৈঃস্বরে ডাক দেন। ডাক শুনে কাব তাদের নিকট আসার জন্যে উঠলে তার স্ত্রী- যে ছিল নববধূ- তাকে বলল, ‘এ সময় কোথায় যাচ্ছেন? আমি এমন শব্দ শুনতে পাচ্ছি যে, যেন তা হতে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে।

স্ত্রীর এ কথা শুনে কাব বলল, ‘এটা তো আমার ভাই মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা এবং দুধ ভাই আবূ নায়িলাহসম্ভ্রান্ত লোককে যদি তরবারী যুদ্ধের দিকে আহবান করা হয় তবে সে ডাকেও সে সাড়া দিবে।এরপর সে বাইরে আসল। তার দেহ থেকে সুগন্ধি ছুটছিল এবং তার মাথায় খোশবুর ঢেউ খেলছিল।

আবূ নায়িলাহ (রাঃ) তাঁর সঙ্গীদেরকে বলে রেখেছিলেন। যখন সে আসবে তখন আমি তার চুল ধরে শুঁকবো। যখন তোমরা দেখবে যে, আমি তার মাথা ধরে তাকে ক্ষমতার মধ্যে পেয়ে গেছি তখন ঐ সুযোগে তোমরা তাকে হত্যা করবে।

সুতরাং যখন কাব আসলো তখন দীর্ঘক্ষণ ধরে আলাপ আলোচনা ও গল্পগুজব চললো। তারপর আবূ নায়িলাহ (রাঃ) বললেন, ‘ইবনু আশরাফ! আজুয ঘাঁটি পর্যন্ত চলুন। সেখানে আজ রাতে কথাবার্তা বলাবলি হবে। সে বলল, ‘তোমাদের ইচ্ছা হলে চলো।তারপর তাদের সাথে সে চলল।

পথের মধ্যে আবূ নায়িলাহ (রাঃ) তাকে বললেন, ‘আজকের মতো এমন উত্তম সুগন্ধির সাথে আপনার পরিচয় নেই।একথা শুনে কা'বের বক্ষ গর্বে ফুলে উঠল। সে বলল, ‘আমার পাশে আরবের সর্বাপেক্ষা অধিক সুগন্ধি ব্যবহারকারিণী মহিলা রয়েছে।আবূ নায়িলাহ (রাঃ) বললেন, ‘আপনার মাথাটি একটু শুঁকবো এ অনুমতি আছে কি?’ সে উত্তরে বলল হ্যা, হ্যাঁআবূ নায়িলাহ (রাঃ) তখন কাবের মাথায় হাত রাখলেন। তারপর তিনি নিজেও তার মাথা শুঁকলেন এবং সঙ্গীদেরকেও শুঁকালেন। কিছুদূর যাওয়ার পর আবূ নায়িলাহ (রাঃ) বললেন, ‘ভাই আর একবার শুঁকতে পারি কি?’ কাব উত্তর দিল হ্যাঁ হ্যাঁ। কোন আপত্তি নেই।আবূ নায়িলাহ (রাঃ) আবার শুঁকলেন। সুতরাং সে নিশ্চিত হয়ে গেল।

আরো কিছুদূর চলার পর আবূ নায়িলাহ (রাঃ) পুনরায় বললেন, ‘ভাই আর একবার শুঁকবো কি?’ এবারও কাব উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, শুঁকতে পারো।

এবার আবূ নায়িলাহ (রাঃ) তার মাথায় হাত রেখে ভালভাবে মাথা ধরে নিলেন এবং সঙ্গীদেরকে বললেন, ‘আললাহর এ দুশমনকে হত্যা করে ফেল।ইতোমধ্যেই তার উপর কয়েকটি তরবারী পতিত হলো, কিন্তু কাজ হলো না। এ দেখে মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামা (রাঃ) নিজের কোদাল ব্যবহার করে তার দুনিয়ার স্বাদ চিরতরে মিটিয়ে দিলেন। আক্রমণের সময় সে এত জোরে চিৎকার করেছিল যে, চতুর্দিকে তার চিৎকারের শব্দ পৌঁছে গিয়েছিল এবং এমন কোন দূর্গ বাকী ছিল না যেখানে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করা হয়নি। কিন্তু ওটা মুসলিমদের ক্ষতির কোন কারণ হয় নি।

কাবকে আক্রমণ করার সময় হারিস ইবনু আউস (রাঃ)-কে তাঁর কোন এক সাথীর তরবারীর কোণার আঘাত লেগেছিল। ফলে তিনি আহত হয়েছিলেন এবং তাঁর দেহ হতে রক্ত প্রবাহিত হচ্ছিল। কাবকে হত্যা করে ফিরবার সময় যখন এ ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনী হররায়ে আরীয নামক স্থানে পেঁŠছেন তখন দেখেন যে, হারিস (রাঃ) অনুপস্থিত রয়েছেন। সুতরাং তারা সেখানে থেমে যান। অল্পক্ষণ পরে হারিসও (রাঃ) সঙ্গীদের পদচিহ্ণ ধরে সেখানে পৌঁছে যান। সেখান হতে তাঁরা তাঁকে উঠিয়ে নেন এবং বাকীয়ে গারকাদে পৌঁছে এমন জোরে তাকবীর ধ্বনি দেন যে, রাসূলুল্লাহ ()-ও তা শুনতে পান। তিনি বুঝে নেন যে, কাব নিহত হয়েছে। সুতরাং তিনিও আল্লাহ আকবার ধ্বনি উচ্চারণ করেন। তারপর যখন এ মুসলিম বাহিনী তাঁর খিদমতে উপস্থিত হন তখন তিনি বলেন, ‘আফলাহাতিল উজূহুঅর্থাৎ এ চেহারাগুলো সফল থাকুক। তখন তারা বললেন, ‘অ অজুহুকা ইয়া রাসূলুল্লাহঅর্থাৎ হে আল্লাহর রাসূল (সা.) আপনার চোহরাও সফলতা লাভ করুক। আর সাথে সাথেই তাঁরা তাগূতের (কাবের) কর্তিত মস্তক তাঁর সামনে রেখে দেন। তিনি তখন আল্লাহ পাকের প্রশংসা করেন এবং হারিস (রাঃ)-এর ক্ষত স্থানে স্বীয় পবিত্র মুখের লালা লাগিয়ে দেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আরোগ্য লাভ করেন এবং পরে আর কখনো তিনি কষ্ট অনুভব করেন নি।

এদিকে ইহুদীরা যখন কাব ইবনু আশরাফির হত্যার খবর জানতে পারল তখন তাদের শঠতাপূর্ণ অন্তরে ভীতি ও সন্ত্রাসের ঢেউ খেলে গেল। তারা তখন বুঝতে পারল যে, রাসূলুল্লাহ () যখন অনুধাবন করবেন যে, শান্তি ভঙ্গকারী, গন্ডগোল ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারী এবং প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকার ভঙ্গকারীদেরকে উপদেশ দিয়ে কোন ফল হচ্ছেনা তখন তিনি তাদের উপর শক্তি প্রয়োগ করতেও দ্বিধাবোধ করবেন না। এ জন্যেই তারা এ তাগূতের হত্যার প্রতিবাদে কোন কিছু করার সাহস করলনা, বরং একেবারে সোজা হয়ে গেল। তারা অঙ্গীকার পূরণের স্বীকৃতি দান করল এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধাচরণের সাহস সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলল।

এভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনার বিরুদ্ধে বহিরাক্রমণের মোকাবেলা করার অপূর্ব সুযোগ লাভ করলেন এবং মুসলিমরা অভ্যন্তরীণ গোলযোগ হতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে গেলেন যে গোলযোগের তাঁরা আশঙ্কা করছিলেন এবং যার গন্ধ তাঁরা মাঝে মাঝে পাচ্ছিলেন।( সফিউর রহমান মোবারকপুরী, আর রাহিকুল মাখতুম)     

আবু রাফে সালাম বিন আবিল হুকাইককে হত্যা

৫ম হিজরি মোতাবেক ৬২৭ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। নবীজি (সা.) তখনো জীবিত। আবু রাফে একজন ধনী ব্যবসায়ী ও ইহুদি। সে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ব্যাপারে বিভিন্ন কটূক্তি করত। তাঁকে নানাভাবে কষ্ট দিত। আবদুল্লাহ বিন আতিক (রা.)-সহ কয়েকজন সাহাবি নবীজি (সা.)-এর কাছে তার ব্যাপারে মৃত্যুদণ্ডের আবেদন করলেন। তিনি আবেদন মঞ্জুর করলেন। আবদুল্লাহ বিন আতিক (রা.) কয়েকজন সাহাবির সহযোগিতায় তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন। (বুখারি : ২/৫৭৭-৫৭৮, সিরাতে ইবনে হিশাম : ২/২৭৩-২৭৫, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৪/১৫৬-১৬০)

মূল নাম আব্দুল্লাহ ইবনে আবিল হুকাইক। তাকে সাল্লাম ইবনে আবিল হুকাইক নামেও ডাকা হতো। তার উপনাম ছিলো আবু রাফে। সে ছিলো হিজাযের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। অঢেল ধন-সম্পদের মালিক ছিলো। খায়বারের পাশেই হিজাযের একটি সুরক্ষিত দূর্গে সে বসবাস করত। সে ছিলো জাত ইয়াহুদী। উগ্র ও কট্টরপন্থী। সে ছিল কাব বিন আশরাফের ন্যায় প্রচন্ড ইসলাম ও রাসূল বিদ্বেষী ইহুদী নেতা। মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বদা সে শত্রুপক্ষকে সাহায্য করত। ওহোদ যুদ্ধের দিন আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের প্ররোচনায় বনু সালামা গোত্রের লোকেরা ফিরে যেতে উদ্যত হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা যায়নি। এ সম্পর্কে সূরা আলে ইমরান ১২২ আয়াত নাযিল হয়। খন্দকের যুদ্ধের দিনও এরা মুনাফিকদের প্ররোচনায় যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে যেতে চেয়েছিল এবং রাসূলের নিকটে ওযর পেশ করেছিল (আহযাব ১২-১৩)। সেই বদনামী দূর করার জন্য এবং ইতিপূর্বে ৩য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে আউস গোত্রের লোকেরা মুহাম্মাদ বিন মাসলামার নেতৃত্বে রাসূলের নির্দেশে কাব বিন আশরাফকে হত্যা করে প্রশংসা কুড়িয়েছিল, অনুরূপভাবে খাযরাজের সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আবু রাফেকে হত্যার অনুমতি চাইলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমতি দিলেন এবং সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে আতিক রা. এর নেতৃত্বে ছয়জনের একটি ছোট্ট বাহিনী পাঠালেন আবু রাফেকে হত্যা করার জন্য। তারা হলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে আতিক, আব্দুল্লাহ ইবনে উতবা, মাসউদ ইবনে সিনান, আব্দুল্লাহ ইবনে উনাইস, আবু কাতাদা, খুযায়ি ইবনে আসউয়াদ রাদিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন। সফিঊর রহমান বলেন,

সালাম বিন আবিল হুক্বাইক্বের উপ নাম ছিল আবূ রাফিইসলাম বিদ্বেষী ও ইসলামের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন ইহুদী প্রধানদের সে ছিল অন্যতম ব্যক্তি। মুসলিমগণের বিরুদ্ধে মুশরিকদের প্ররোচিত ও প্রলোভিত করার ব্যাপারে সে সব সময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করত এবং ধন সম্পদ ও রসদ সরবরাহ করে তাদের সাহায্য করত। এছাড়া রাসূলুল্লাহ (সা.) -কে কষ্ট দেয়ার ব্যাপারে সর্বক্ষণ সে উদ্বাহু থাকত। এ কারণে মুসলিমগণ যখন বনু কুরাইযাহর সমস্যাবলী থেকে মুক্ত হয়ে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন তখন খাযরাজ গোত্রের লোকেরা তাকে হত্যা করার জন্য নাবী কারীম (সা.) -এর অনুমতি প্রার্থী হলেন। যেহেতু ইতোপূর্বে আউস গোত্রের কয়েকজন সাহাবা কাব বিন আশরাফকে হত্যা করেছিলেন সেহেতু খাযরাজ গোত্রও অনুরূপ একটি দুঃসাহসিক কাজ করার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। তাই তাঁরা অনুমতি গ্রহণের ব্যাপারে তাড়াহুড়া করতে চাইলেন।

রাসূলে কারীম (সা.) তাঁদের অনুমতি প্রদান করলেন। কিন্তু বিশেষভাবে নির্দেশ প্রদান করলেন যে, মহিলা এবং শিশুদের যেন হত্যা করা না হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অনুমতি লাভের পর পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি দল অভীষ্ট গন্তব্য অভিমুখে রওয়ানা হয়ে যান। এরা সকলেই ছিলেন খাযরায গোত্রের শাখা বনু সালামাহ গোত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত। এদের দলনেতা ছিলেন আব্দুল্লাহ বিন আতীক।

এ দলটি সোজা খায়বার অভিমুখে গেলেন। কারণ আবূ রাফির দূর্গটি তথায় অবস্থিত ছিল। যখন তাঁরা দূর্গের নিকটে গিয়ে পৌঁছলেন সূর্য তখন অস্তমিত হয়েছিল। লোকজনরা তখন গবাদি পশুর পাল নিয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেছিল। আব্দুল্লাহ বিন আতীক তাঁর সঙ্গীদের বললেন, ‘তোমরা এখানে অপেক্ষা করতে থাকে। আমি দরজার প্রহরীর সঙ্গে কথাবার্তা বলতে গিয়ে এমন সূক্ষ্ণ কৌশল অবলম্বন করব ফলে হয়তো দূর্গাভ্যন্তরে প্রবেশ লাভ সম্ভব হতে পারে। এরপর তিনি দরজার নিকট গেলেন এবং মাথায় ঘোমটা টেনে এমনভাবে অবস্থান গ্রহণ করলেন যাতে দেখলে মনে হয় যে, কেউ যেন প্রস্রাব কিংবা পায়খানার জন্য বসেছে। প্রহরী সে সময় চিৎকার করে ডাক দিয়ে বলল, ‘ওহে আল্লাহর বান্দা! যদি ভেতরে আসার প্রয়োজন থাকে তবে এক্ষুনি চলে এসো, নচেৎ আমি দরজা বন্ধ করে দিব।

আব্দুল্লাহ বিন আতীক বলছেন, ‘আমি সে সুযোগে দূর্গাভ্যন্তরে প্রবেশ করলাম এবং নিজেকে গোপন করে রাখলাম। যখন লোকজন সব ভেতরে এসে গেল প্রহরী তখন দরজা বন্ধ করে দিয়ে চাবির গোছাটি একটি খুঁটির উপর ঝুলিয়ে রাখল। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর যখন লক্ষ্য করলাম যে, সমগ্র পরিবেশটি নিশ্চুপ ও নিস্তব্ধ হয়ে গেছে তখন আমি চাবির গোছাটি হাতে নিয়ে দরজা খুলে দিলাম।

আবূ রাফিউপর তলায় অবস্থান করছিল। সেখানেই তার পরামর্শ বৈঠক অনুষ্ঠিত হত। বৈঠক শেষে বৈঠককারীগণ যখন নিজ নিজ স্থানে চলে গেল তখন আমি উপর তলায় উঠে গেলাম। আমি যে দরজা খুলতাম ভেতর থেকে তা বন্ধ করে দিতাম। আমি এটা স্থির করে নিলাম যে যদি লোকজনেরা আমার অনুপ্রবেশ সম্পর্কে অবহিত হয়েও যায়, তবুও আমার নিকট তাদের পৌঁছবার পূর্বেই যেন আবূ রাফিকে হত্যা করতে পারি। এভাবে আমি তার কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। কিন্তু সে পরিবার পরিজন এবং সন্তানাদি পরিবেষ্টিত অবস্থায় এক অন্ধকার কক্ষে অবস্থান করছিল। আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছিলাম না যে, সে কক্ষের ঠিক কোন্ স্থানে অবস্থান করছে। এ কারণে আমি তার নাম ধরে ডাক দিলাম, ‘আবূ রাফি

সে উত্তরে বলল, ‘কে ডাকে?’

তৎক্ষণাৎ আমি তার কণ্ঠস্বরকে অনুসরণ করে দ্রুত অগ্রসর হলাম এবং তরবারী দ্বারা জোরে আঘাত করলাম। কিন্তু আমার দৈহিক ও মানসিক অবস্থাজনিত বিশৃঙ্খলার কারণে এ আঘাতে কোন ফল হল না বলে মনে হল। এদিকে সে জোরে চিৎকার করে উঠল। কাজেই, আমি দ্রুতবেগে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম এবং অল্প দূরে এসে থেমে গেলাম। অতঃপর কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করে আবার ডাক দিলাম, ‘আবূ রাফি, এ কণ্ঠস্বর কেমন?’

সে বলল, ‘তোমার মা ধ্বংস হোক! অল্পক্ষণ পূর্বে এ ঘরেই কে আমাকে তরবারী দ্বারা আঘাত করেছে।

আব্দুল্লাহ বিন আতীক বললেন, ‘আমি আবার প্রচন্ড শক্তিতে তরবারী দ্বারা তাকে আঘাত করলাম। তার ক্ষতস্থান থেকে রক্তের ফোয়ারা ছুটতে থাকল। কিন্তু এতেও তাকে হত্যা করা সম্ভব হল না। তখন আমি তরবারীর অগ্রভাগ সজোরে তার পেটের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিলাম। তরবারীর অগ্রভাগ তার পৃষ্ঠদেশ পর্যন্ত পৌঁছে গেল। এখন আমি স্থির নিশ্চিত হলাম যে, সে নিহত হয়েছে। তাই আমি একের পর এক দরজা খুলতে খুলতে নীচে নামতে থাকলাম। অতঃপর সিঁড়ির মুখে শেষ ধাপে গিয়ে বুঝতে পারলাম যে, আমি মাটিতে পৌঁছে গিয়েছি। কিন্তু কিছুটা অসাবধানতার সঙ্গে মাটিতে পা রাখতে গিয়ে আমি নীচে পড়ে গেলাম।

চাঁদের আলোয় আলোকিত ছিল চার দিক। নীচে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পায়ের গোড়ালি গেল স্থানচ্যুত হয়ে। মাথার পাগড়ী খুলে শক্ত করে বেঁধে ফেললাম পায়ের গোড়ালি। অতঃপর দরজা হতে দূরে গিয়ে বসে পড়লাম এবং মনে মনে স্থির করলাম যে, যতক্ষণ না ঘোষণাকারীর মুখ থেকে তার মৃত্যুর ঘোষণা শুনতে পাচ্ছি ততক্ষণ আমি এ স্থান পরিত্যাগ করব না।

মোরগের ডাক শুনে বুঝতে পারলাম, রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। এমন সময় দূর্গ শীর্ষ থেকে ঘোষণাকারী ঘোষণা করল যে, ‘আমি হিজাযের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবূ রাফির মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করছি। এ কথা শ্রবণের পর অত্যন্ত দ্রুত গতিতে আমি সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম এবং সঙ্গীদের নিকট গিয়ে বললাম, ‘আল্লাহ তাআলা আবূ রাফি'কে তার মন্দ কথাবার্তা ও মন্দ কাজের চূড়ান্ত বিনিময় প্রদান করেছেন। আবূ রাফিনিহত হয়েছে। চলো আমরা এখন এখান থেকে পলায়ন করি।

মদীনা প্রত্যাবর্তনের পর নাবী কারীম (সা.) -এর খিদমতে হাজির হলাম এবং ঘটনাটি আনুপূর্বিক বর্ণনা করলাম। ঘটনাটি অবগত হওয়ার পর তিনি বললেন, ‘তোমার পা প্রসারিত কর।আমার পা প্রসারিত করলে তিনি স্থানচ্যুত গোড়ালিটির উপর তাঁর হাত মুবারক বুলিয়ে দিলেন। তাঁর হাত পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গেই এটা অনুভূত হল যে, ব্যথাবেদনা বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। শুধু তাই নয়, ঐ স্থানে যে কোন সময় ব্যথা বেদনা ছিল সে অনুভূতিও যেন তখন ছিল না।

এ হচ্ছে সহীহুল বুখারী শরীফের বর্ণনা। ইবনু ইসহাক্বের বর্ণনায় রয়েছে যে, আবূ রাফির ঘরে পাঁচ জন সাহাবীই (রাযি.) প্রবেশ করেছিলেন এবং তার হত্যার ব্যাপারে সকলেই সক্রিয় ছিলেন। তবে যে সাহাবী তরবারীর আঘাতে তাকে হত্যা করেছিলেন তিনি হচ্ছেন আব্দুল্লাহ বিন উনাই‌স।

এ বর্ণনায় এ কথাও বলা হয়েছে যে, তাঁরা যখন রাত্রিতে আবূ রাফিকে হত্যা করেন এবং আব্দুল্লাহ বিন আতীকের পায়ের গোড়ালি স্থানচ্যুত হয়ে যায় তখন তাঁকে উঠিয়ে এনে দূর্গের দেয়ালের আড়ালে যেখানে ঝর্ণার নহর ছিল সেখানে আত্মগোপন করে থাকেন।

এদিকে ইহুদীগণ অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করে চতুর্দিকে দৌড়াদৌড়ি করে অনুসন্ধান চালাতে থাকল। অনেক অনুসন্ধানের পরও যখন তারা কোন খোঁজ না পেল তখন নিরাশ হয়ে নিহত ব্যক্তির নিকট প্রত্যাবর্তন করল। এ সুযোগে সাহাবীগণ আব্দুল্লাহ বিন আতীককে কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে রাসূলে কারীম (সা.)-এর খিদমতে হাজির হলেন। প্রেরিত এ ক্ষুদ্র বাহিনীটির সফল অভিযান অনুষ্ঠিত হয়েছিল ৫ম হিজরীর যুল ক্বাদাহ অথবা যুল হিজ্জাহ মাসে।( (সফিউর রহমান   )  এরপর হুকাইকের স্থলাভিষিক্ত হন উসাইর ইবনে যারিম

উসাইর ইবনে যারিমকে হত্যা

উসাইর গাতাফান গোত্রের সাথে সলা পরামর্শ শুরু করেছিল এবং গুজব ছড়ায় যে সেও "মুহাম্মাদের রাজধানী" মদিনা আক্রমণের অভিপ্রায়ে ছিল। এই খবর পেয়ে নবী মুহাম্মাদ সা. আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহাকে আব্দুল্লাহ ইবনে উনাইস, বনু সালিমা গোত্রের একজন সদস্য এবং ইহুদি বিরোধী একটি গোত্রসহ আরও অনেককে সাথে নিয়ে উসাইরের কাছে প্রেরণ করেন। তারা উসাইরকে বলেন যে, সে মুহাম্মাদ সা. এর কাছে গেলে মুহাম্মাদ সা. তার সাথে সাক্ষাৎ করবেন এবং তাকে সম্মান দেবেন। সে রাজি না হওয়া পর্যন্ত তারা তাকে অনুরোধ করতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত সে কিছু ইহুদিকে সাথে নিয়ে তাদের সাথে রওয়ানা হয়। খাইবার থেকে ছয় মাইল দুরে কারারা নামক স্থানে আসার আগ পর্যন্ত উসাইর স্বাভাবিক ছিলেন, আচমকা তিনি তাদের সাথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন। উসাইর আবদুল্লাহর তলোয়ার কেড়ে নিতে উদ্যত হলে আবদুল্লাহ তার দিকে ছুটে এসে তার পা কেটে দেন। আবদুল্লাহকে উসাইর তার হাতে থাকা কাঠের লাথি দিয়ে আঘাত করলে তিনি মাথায় চোট পান। এরপর সেখানে উপস্থিত মুসলিমগণ তার ৩০ জন ইহুদি সঙ্গীর মাঝে সকলকে হত্যা করে একজনকে বাদে যে কিনা দৌড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল।

 

খায়বর যুদ্ধ

৭ম হিজরীর মুহররম মাস ৬২৮ খ্রিস্টাব্দ কুরায়েশদের সঙ্গে সন্ধিচুক্তির পর সকল ষড়যন্ত্রের মূল ঘাঁটি খায়বরের ইহুদীদের প্রতি এই অভিযান পরিচালিত হয়। হুদায়বিয়ার সন্ধি ও বায়আতে রিযওয়ানে উপস্থিত ১৪০০ ছাহাবীকে নিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্বয়ং এই অভিযান পরিচালনা করেন। অন্যদের নেননি। সফিউর রহমান মোবারকপুরী বলেন,

হুদায়বিয়া থেকে ফেরত এসে নাবী (সা.) ২০ দিন বা এর চেয়ে কম সময় মদ্বীনায় অবস্থান করলেন। অতঃপর তিনি খায়বারের উদ্দেশ্যে বের হলেন। বের হওয়ার সময় তিনি সিবা বিন উরফুযাকে মদ্বীনায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত করলেন। আর রাহিকুল মাখতুম গ্রন্থে খায়বার যুদ্ধের কারণ হিসাবে উল্লেখ আছে-

খায়বার ছিল মদীনার উত্তরে আশি কিংবা ষাট মাইল দূরত্বে অবস্থিত একটি বড় শহর। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন সেখানে একটি দূর্গ ছিল এবং চাষাবাদেরও ব্যবস্থা ছিল। বর্তমানে সেটি একটি জন বসতি এলাকায় পরিণত হয়েছে। এখানকার আবহাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য তেমন উপযোগী নয়।

হুদায়বিয়াহর সন্ধির ফলে রাসূলে কারীম (সা.) যখন আহযাব যুদ্ধের তিনটি শক্তির মধ্যে সব চাইতে শক্তিশালী দল কুরাইশদের শত্রুতা থেকে মুসলিমগণকে নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত মনে করলেন, তখন অন্য দুটি শক্তি ইহুদী ও নাজদ গোত্রসমূহের সঙ্গেও একটি সমঝোতায় আসার চিন্তাভাবনা করতে থাকলেন। উদ্দেশ্য ছিল এ সকল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে শত্রুতা ও বৈরীভাব পরিহারের মাধ্যমে মুসলিমগণের শান্তি ও স্বস্তিপূর্ণ নিরাপদ জীবন যাপন এবং ইসলামের দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে অধিক পরিমাণে আত্মনিয়োগ।

যেহেতু খায়বার ছিল বিভিন্ন ষড়যন্ত্রকারী ও কোন্দলকারীদের আড্ডা, সৈনিক মহড়ার কেন্দ্র এবং প্ররোচনা, প্রবঞ্চনা ও যুদ্ধের দাবানল সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু সেহেতু এ স্থানটি সর্বাগ্রে মুসলিমগণের মনোযোগদানের বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার বিশেষ প্রয়োজন ছিল। এ প্রসঙ্গে এখন একটি প্রশ্ন উঠতে পারে যে, খায়বার সম্পর্কে মুসলিমগণের যে ধারণা তা যথার্থ ছিল কি না, এ ব্যাপারে মুসলিমগণের ধারণা যে যথার্থ ছিল তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

কারণ, এ খায়বারবাসী খন্দক যুদ্ধে মুশরিক শক্তিগুলোকে সংগঠিত করে মুসলিমগণের বিরুদ্ধে লিপ্ত হতে সাহায্য এবং উৎসাহিত করেছিল। তাছাড়া, মুসলিমগণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও বিশ্বাসঘাতকতার জন্য এরাই বনু কুরাইযাহকে সর্বতোভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। অধিকন্তু, এরাই তো ইসলামী সমাজের পঞ্চম বাহিনীভুক্ত মুনাফিক্বদের সঙ্গে, আহযাব যুদ্ধের তৃতীয় শক্তি বনু গাত্বাফান এবং বেদুঈনদের সঙ্গে অনবরত যোগাযোগ রেখে চলছিল এবং নিজেরাও যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল। তাঁরা তাদের এ সমস্ত কার্যকলাপের মাধ্যমে মুসলিমগণের একটা চরম অস্বস্তিকর অবস্থা ও অগ্নি পরীক্ষার মধ্যে নিপতিত করেছিল। এমন কি নাবী কারীম (সা.) -কে হত্যার ষড়যন্ত্র তারা করেছিল। এ সমস্ত অস্বস্তিকর অবস্থার প্রেক্ষাপটে অন্যন্যোপায় হয়ে মুসলিমগণ বার বার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ সকল যুদ্ধের মাধ্যমে কোন্দল সৃষ্টিকারী ও ষড়যন্ত্রকারীদের নেতা ও পরিচালক সালামাহ বিন আবিল হুকাইক এবং আসির বিন যারেমকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়া অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। অথচ শত্রুমনোভাবাপন্ন ইহুদীদের শায়েস্তা করার ব্যাপারটি মুসলিমগণের জন্য ততোধিক প্রয়োজনীয় ছিল।

কিন্তু এ ব্যাপারে যথাযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণে মুসলিমগণ যে কারণে বিলম্ব করেছিলেন তা হচ্ছে, কুরাইশ মুশরিকগণ ইহুদীদের তুলনায় অনেক বেশী শক্তিশালী যুদ্ধভিজ্ঞ ও উদ্ধত ছিল এবং শক্তি সামর্থ্যে মুসলিমগণের সমকক্ষ ছিল। কাজেই কুরাইশদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ার পূর্বে ইহুদীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে শক্তি ও সম্পদ ক্ষয় করাকে নাবী কারীম (সা.) সঙ্গত মনে করেন নি। কিন্তু কুরাইশদের সঙ্গে যখন একটা সমঝোতায় আসা সম্ভব হল তখনই ইহুদীদের ব্যাপারে মনোযোগী হওয়ার অবকাশ তিনি লাভ করলেন এবং তাদের হিসাব গ্রহণের জন্য ময়দান পরিস্কার হয়ে গেল।   ( সফিউর রহমান মোবারকপুরী, আর রাহিকুল মাখতুম   )ফিউর রহমান  

এতে মুসলিম পক্ষে ১৮ জন শহীদ ও ৫০ জন আহত হন। ইহুদী পক্ষে ৯৩ জন নিহত হয়। ইহুদীদের বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত হয়। তবে তাদের আবেদন মতে উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক ভাগ দেবার শর্তে তাদেরকে সেখানে বসবাস করার সাময়িক অনুমতি দেওয়া হয়। যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ গনীমত লাভ হয়। যাতে মুসলমানদের অভাব দূর হয়ে যায়। এই সময়ে ফিদাকের ইহুদীদের নিকটে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুহাইছাহ বিন মাসঊদকে প্রেরণ করেন। খায়বর বিজয়ের পরে তারা নিজেরা রাসূলের নিকটে দূত পাঠিয়ে আত্মসমর্পণ করে এবং খায়বরবাসীদের ন্যায় অর্ধেক ফসলে সন্ধিচুক্তি করে। বিনাযুদ্ধে ও স্রেফ রাসূলের দাওয়াতে বিজিত হওয়ায় ফিদাক ভূমি কেবল রাসূলের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়।ঐতিহাসিক আমীর আলী বলেন, হযরত আলী (রা) এ যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করেন বলে মহানবী (স) তাকে আসাদুউল্লাহ (আল্লাহর সিংহ) উপাধিতে ভূষিত করেন এবং তাকে বিখ্যাত জুলফিকার তরবারি প্রদান করেন।

 

ওয়াদিল কুরা

খায়বার বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ (সা.) মনের দিক দিয়ে যখন কিছুটা মুক্ত হলেন তখন ওয়াদিল কুরা বা কুরা উপত্যকায় গমন করলেন। সেখানে ইহুদীদের একটি দলের বসবাস ছিল। এক পর্যায়ে আরবদের একটি দল গিয়ে তাদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিল।

মুসলিমগণ যখন কোরা উপত্যকায় অবতরণ করলেন তখন ইহুদীগণ তাঁদের প্রতি তীর নিক্ষেপ করে আক্রমণ করল। তারা পূর্ব হতেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল। তাদের এ আক্রমণে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর একজন দাস মৃত্যুমুখে পতিত হল। লোকজনেরা বললেন, ‘তার জন্য জান্নাত বরকতময় হোক। নাবী কারীম (সা.) বললেন,কখনই না। সে সত্তার শপথ! যাঁর হাতে রয়েছে আমার জীবন, খায়বার যুদ্ধে এ ব্যক্তি যুদ্ধ লব্ধ মাল হতে বন্টনের পূর্বেই যে চাদর খানা চুরি করেছিল তা আগুনে পরিবর্তিত হয়ে ওর জন্য দীপ্তিমান হয়ে উঠেছে। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এ কথা শুনে একটি ফিতা, দুটি ফিতা কিংবা যিনি যে জিনিস গোপনে নিয়ে গিয়েছিলেন সে সব রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর খিদমতে এনে হাজির করলেন। নাবী কারীম (সা.) বললেন,এ একটি কিংবা দুটি ফিতা ছিল আগুনের।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (সা.) মুসলিম বাহিনীকে যুদ্ধের উপযোগী সুশৃঙ্খলভাবে সারিবদ্ধ করলেন। সমগ্র বাহিনীর পতাকা সাদ বিন উবাদাহর হাতে সমর্পণ করলেন। একটি পতাকা দিলেন হুবাব বিন মুনযিরকে এবং তৃতীয় পতাকা দিলেন উবাদাহ বিন বিশরকে। এরপর ইহুদীদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করলেন। এ দাওয়াত গ্রহণ না করে তাদের এক ব্যক্তি যুদ্ধের জন্য ময়দানে অবতরণ করল। আল্লাহর নাবী (সা.)-এর পক্ষে যুবাইর বিন আউওয়াম (রাঃ) যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তাঁর কাজ সম্পূর্ণ করলেন। অতৎপর ইহুদীদের পক্ষ থেকে দ্বিতীয় ব্যক্তি ময়দানে অবতীর্ণ হলেন। যুবাইর (রাঃ) তাকেও হত্যা করলেন। এরপর তাদের পক্ষ থেকে তৃতীয় ব্যক্তি ময়দানে অবতরণ করলেন। এর সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য আলী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তাকে হত্যা করলেন। এভাবে একে একে তাদের ১১ ব্যক্তি নিহত হয়। যখন একজন নিহত হতো তখন নাবী কারীম (সা.) অবশিষ্ট ইহুদীগণকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন।

ঐ দিন যখন সালাতের সময় হতো তখন সাহাবাদের নিয়ে নাবী কারীম (সা.) সালাত পড়তেন। সালাতের পর পুনরায় ইহুদীদের সামনে ফিরে যেতেন এবং তাঁদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করতেন।

এভাবে যুদ্ধ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। দ্বিতীয় দিন সকালে পুনরায় গমন করলেন। তখনো সূর্য বর্শা বরাবর উপরে ওঠেনি এমন সময় তাদের হাতে যা কিছু ছিল তা সম্পূর্ণ নাবী কারীম (সা.) -এর হাতে সমর্পণ করে দিল। অর্থাৎ নাবী (সা.) শক্তি দিয়ে বিজয় অর্জন করেন এবং আল্লাহ তাআলা তাদের সম্পদসমূহের সবটুকুই নাবী কারীম (সা.)-এর হাতে গণীমত হিসেবে প্রদান করেন। বহু সাজ-সরঞ্জামাদি সাহাবীগণ (রাযি.)-এর হস্তগত হয়।

রাসূলুল্লাহ (সা.)  ওয়াদিল কুরা নামক স্থানে চার দিন অবস্থান করেন এবং যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সাহাবীগণ (সা.)-এর মধ্যে বন্টন করে দেন। তবে জমিজমা খেজুরের বাগানগুলো ইহুদীদের হাতেই ছেড়ে দেন এবং খায়বারবাসীগণের অনুরূপ ওয়াদিল কোরাবাসীগণের সঙ্গেও একটি চুক্তি সম্পাদন করেন। ( সফিউর রহমান )

তাইমা

তাইমার ইহুদীগণ যখন খায়বার, ফাদাক এবং ওয়াদিল কুরার অধিবাসীদের পরাভূত হওয়ার খবর পেল তখন তারা মুসলিমগণের বিরুদ্ধে শক্তির মহড়া প্রদর্শন ছাড়াই সন্ধি চুক্তি সম্পাদনের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট দূত প্রেরণ করল। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের সন্ধি প্রস্তাব গ্রহণ করে সম্পদাদি সহ বসবাসের অনুমতি দেন। অতঃপর তাদের সঙ্গে সন্ধি চুক্তি সম্পাদন করেন যার ভাষা ছিল নিম্নরূপ:

এ দলিল লিখিত হল আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সা.)-এর পক্ষ থেকে বনু আদিয়ার জন্য। তাদের উপর কর ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হল এবং মুসলিমগণ তাদের জিম্মাদা হলেন। তাদের উপর কোন প্রকার অন্যায় করা হবে না এবং দেশ থেকে তাদের বিতাড়িত করা হবে না। রাত্রি হবে তাদের সাহায্যকারী এবং দিন হবে পূর্ণতা প্রদান কারী (অর্থাৎ এ চুক্তি হবে স্থায়ী ব্যবস্থা) এ চুক্তি লিপিবদ্ধ করেন খালিদ বিন সাঈদ।

বিশ মিশ্রিত খাদ্য

৭ম হিজরীর মহররম মাসে খয়বর বিজয়ের পরে সেখানেই তাঁর পূর্বপরিচিত ইহুদী নেতা সালাম বিন মুশকিমের স্ত্রী জয়নব বিনতুল হারেছ রাসূলকে হাদিয়া দেওয়ার জন্য তাঁর প্রিয় খাদ্য বকরীর ভূনা রান বিষমিশ্রিত করে নিয়ে আসে। মহানবী ও সাহাবিরা খাবার গ্রহণ করেন। মহানবী (সা) খাওয়া মাত্র জেনে যান যে তাতে বিষ মেশানো হয়েছে। তিনি তৎক্ষণাৎ সাহাবিদের খাবার খেতে নিষেধ করেন। কিন্তু ইতোমধ্যে বিশর বিন বারাবিন মারুর (রাঃ) মহানবীর সা: সতর্কবাণীর আগেই খাবার গলধঃকরণ করে ফেলেছেন! কিছুক্ষণের মধ্যে তার দেহে তীব্র বিষক্রিয়া শুরু হয়। খাবারে মিশ্রিত বিষ ছিল খুবই তীব্র। ফলে অল্পক্ষণের মধ্যে বিশর বিন বারাবিন মারুর (রাঃ) শাহাদাত বরণ করেন। মহানবী সা: খাবারে বিষ মেশানোর বিষয়টি ঠিকই অবগত হয়েছিলেন। বিষ মিশ্রিত খাবার খাওয়া সত্ত্বেও তাঁর পবিত্র অন্ত্রে কোনো ক্রিয়া করতে পারেনি। ফলে মহানবী সা:-এর প্রাণ রক্ষা হয় এবং ঘাতকের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। এ মহিলাকে নাবী  ক্ষমা করেছিলেন কিংবা হত্যা করেছিলেন সে ব্যাপারে বর্ণনাকারীগণের মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে। মত পার্থক্যের সামঞ্জস্য বিধান করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, নাবী  প্রথমে মহিলাকে ক্ষমা করেছিলেন, কিন্তু যখন বিশর (রাঃ)-এর মৃত্যু সংঘটিত হয়ে গেল তখন তাকে হত্যার বিনিময়ে হত্যা করা হল।রাসুল (সা.) একমাত্র বিষ প্রয়োগকারিণীকেই শাস্তিদান করে গোত্রের অন্যদের ক্ষমা করে দেন। (সিরাত ইবনে হিশাম : ২/৩৩৭)

ইহুদিদের স্বরূপ

ইহুদি মিথ্যাবাদী জাতি। আমি আলেমের পুত্র আলেম এবং সর্দারের পুত্র সর্দার। আপনি তাদেরকে ডেকে আমার কথা জিজ্ঞাসা করুন; কিন্তু আমার ইসলাম গ্রহণের কথা তাদের নিকট প্রকাশ করবেন না।  এই স্বীকারোক্তি একজন ইহুদি বংশোদ্ভত সাহাবির। ইহুদি আলেম হিসেবেও তিনি ছিলেন সকলের নিকট সুপরিচিত। এই সাহাবির নাম হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.)। হজরত ইয়াকুব ইবনে ইউসুফ (আ.)-এর বংশধর ইবনে সালাম (রা.) সেই মহান সাহাবি, যিনি রাসূলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরত করে এসেছেন- এ খবর পাওয়া মাত্র রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে সাক্ষাৎ লাভের উদ্দেশ্যে তাঁর দরবারে উপস্থিত হন। তখন মদিনার লোকেরা দলে দলে হুজুর (সা.)-এর খেদমতে এসে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। নবুওয়াতের দাবির সত্যতা যাচাই করার জন্য হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.)-এর মনে কতিপয় প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল পূর্বেই। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নূরানী চেহারা প্রথম দর্শনেই অনুভব করতে পারেন যে, সত্যিই ইনি আল্লাহর নবী-রাসূল; ইনি মিথ্যা দাবি করতে পারেন না। রাসূলুল্লাহ (সা.) তখন উপস্থিত নও-মুসলিমদের মধ্যে ওয়াজ করছিলেন। ওয়াজ শ্রবণ করার পর কোনো প্রশ্ন না করেই হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.) সেদিনকার মতো সেখান থেকে চলে যান। অত:পর দ্বিতীয়বার রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে তাঁর সাথে কিছুক্ষণ একান্ত আলোচনাকালে এমন কিছু প্রশ্ন করেন, যেগুলোর জওয়াব নবী ব্যতীত অন্য কারো পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। হুজুর (সা.)-এর কাছ থেকে অত্যন্ত সন্তোষজনক জওয়াব পেয়ে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.)-এর এতদূর বিশ্বাস হয় যে, তিনি আর কোনো প্রশ্ন না করে তৎক্ষণাৎ ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর জাতির পক্ষ থেকে সমূহ বিরুদ্ধাচরণের আশঙ্কা থাকা সত্তে¡ও হুজুর (সা.) এর প্রতি ঈমান আনতে তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত হননিইসলাম গ্রহণের পর আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে যেসব কথা বলেন, তার অংশ-বিশেষ উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। অত:পর মহানবী (সা.) মদিনার ইহুদিদের ডেকে ইসলামের প্রতি আহ্বান জানান এবং তাদেরকে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.) এর পরিচয় কি জিজ্ঞাসা করেন। উত্তরে তারা বলেন, ‘তিনি আমাদের নেতা এবং নেতার পুত্র।রাসূলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞাসা করেন, ‘সে কি ইসলাম গ্রহণ করতে পারে?’ তারা বলল, ‘না, পারে না।হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.) এ সময় গৃহের কোণে আত্মগোপান করে ছিলেন। হুজুর (সা.) তাঁকে আহ্বান করলে তিনি কলেমা পড়তে পড়তে বের হয়ে নিকটে আসেন এবং ইহুদিদের লক্ষ্য করে বলেন; ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। তোমরা ভালোরূপেই জানো, ইনি আল্লাহর রাসূল। তাঁর ধর্ম সম্পূর্ণ সত্য অথচ তোমরা তাঁর প্রতি ঈমান গ্রহণ করছ না।এতে ইহুদিরা অপ্রত্যাশিতভাবে অপমানিত বোধ করে এবং রাগে ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.)-এর উদ্দেশ্যে বলতে থাকে তুমি মিথ্যাবাদী এবং আমাদের দলের নিকৃষ্টতম ব্যক্তি। তোমার পিতাও নিকৃষ্ট ব্যক্তি ছিলেন।হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, আপনি তো দেখলেন, আমার এটাই আশঙ্কা ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে বেহেশতি হওয়ার সুসংবাদ দিয়েছিলেন এবং কেউ কেউ বলেন যে, ‘আশারায়ে মোবাশশারা’ (বেহেশতের সুসংবাদপ্রাপ্ত) ১০ জন সাহাবির পর একাদশ সাহাবি ছিলেন হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.)। হিজরি ৪৩/৬৬৩ সালের ৯ অক্টোবর তিনি মদিনায় ইন্তেকাল করেন। তাঁর উদ্বৃত বাক্য মিথ্যাবাদী ইহুদিদের স্বরূপ উদ্ঘাটিত করে।

সুদখোর ইহুদি

সুদি কাজে লিপ্ত হওয়া আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সঙ্গে যুদ্ধ করার শামিল। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কিন্তু যদি তা না করো (অবশিষ্ট সুদ ছেড়ে না দাও), তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পক্ষ থেকে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৭৮-২৮০)

তাওরাত গ্রন্থে আল্লাহ তায়ালা ইহুদিদের ওপর সুদ হারাম করেন। তারা আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে এবং কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে আল্লাহর বাণীর বিকৃতি সাধন করে মনগড়া ব্যাখ্যা স্থির করে। তারা যুক্তি দেয় সুদ হারাম শুধু ইহুদিদের পরস্পরের মাঝে সুদী লেনদেন করা। অন্য ধর্মের লোকদের সঙ্গে সুদী কারবার করতে কোনো বাধা নেই। এভাবে এরা আল্লাহর বাণী নিজেদের মতো পরিবর্তন করে নেয়। এরা যে কত বড় সুদখোর শেকসপিয়রের দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস (The Merchant of Venice) কমেডি নাটক তার বড় প্রমাণ। ড. সাঈদ ইব্‌ন আলী ইব্‌ন ওয়াহফ আল-ক্বাহত্বানী (সুদের ক্ষতি-অপকার-কুপ্রভাব ) গ্রন্থে বলেন,

ইহুদিরা সেই আদিকাল থেকেই ষড়যন্ত্র ও কূটকৌশল প্রিয় জাতি হিসেবে প্রসিদ্ধ। তারা তাদের কাছে প্রেরিত নবীর বিরুদ্ধে নানা কূটচাল চালত। তাদের সেসব কূটকৌশলের একটি ছিল সুদ খাওয়ার ব্যাপারে কৌশলের আশ্রয় নেয়া। অথচ তাদের নবী এ থেকে তাদের বারণ করেছেন। হারাম ঘোষণা করেছেন সুদ খাওয়া। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-সুতরাং ইয়াহুদীদের যুলুমের কারণে আমি তাদের উপর উত্তম খাবারগুলো হারাম করেছিলাম, যা তাদের জন্য হালাল করা হয়েছিল এবং আল্লাহর রাস্তা থেকে অনেককে তাদের বাধা প্রদানের কারণে। আর তাদের সুদ গ্রহণের কারণে, অথচ তা থেকে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল।

হাফেজ ইবনে কাসির রহ. বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তথা ইহুদিদের সুদ খেতে নিষেধ করেন, তারপরও তারা সুদ খাওয়া থেকে বিরত থাকেনি। এজন্য তারা নানা কৌশল গ্রহণ করল। বিষয়টিকে সন্দেহের বাতাবরণে ঢেকে ফেলল আর মানুষের সম্পদ খেতে লাগল অবৈধ পন্থায়।

ইহুদিরা সুদ হারাম ঘোষণাকারী বক্তব্যকেই বিকৃত করল। তারা সে বক্তব্যের ব্যাখ্যা দাঁড় করাল এভাবে, ইহুদিদের পরস্পরের মাঝে সুদ খাওয়া নিষেধ, তবে অন্য ধর্মের লোকদের সঙ্গে ইহুদিদের সুদী কারবার করতে কোনো বারণ নেই। রাব নামক এক ইহুদি যাজক বলে, যখন কোনো খৃস্টানের দরকার পড়বে দিরহামের, ইহুদির উচিৎ হবে সর্বদিক থেকে এ সুযোগে তার ওপর প্রভাব বিস্তার করা। তাকে আটকে ফেলা ব্যাপক লাভের বেড়াজালে। যাতে সে সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত হয়। এবং তার সম্পদের মালিকানা খর্ব হয় কিংবা তার সম্পদ এবং ঋণ সমান্তরাল হয়ে যায়। এভাবে ইহুদি খৃষ্টান ব্যক্তির ওপর কর্তৃত্ব লাভ করবে অতপর বিচারকের সহযোগিতায় তার সম্পদের অধিকার কেড়ে নিতে সক্ষম হবে।

সুতরাং আল্লাহর বাণীর আলোকে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, তিনি তাওরাত গ্রন্থেই ইহুদিদের ওপর সুদ হারাম করেছেন। তারা আল্লাহর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেছে এবং কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে তাঁর বাণীর বিকৃতি সাধন করেছে। তারা মনগড়া ব্যাখ্যা স্থির করেছে যে, হারাম শুধু ইহুদিদের পরস্পরের মাঝে সুদী লেনদেন করা অন্যথায় অন্য ধর্মের লোকদের সঙ্গে সুদী কারবার করা হারাম নয়। এ জন্যই আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজিদে তাদের ভৎর্সনা করেছেন। যেমনটি জানা গেল উপরের আয়াত থেকে। ( ড. সাঈদ ইব্‌ন আলী ইব্‌ন ওয়াহফ আল-ক্বাহত্বানী , সুদের ক্ষতি-অপকার-কুপ্রভাব )

রাসুল (সা.)-এর ইন্তেকাল-পরবর্তী  খুলাফায়ে রাশেদার আমলে ইহুদি ষড়যন্ত্র

ইসলামের অব্যাহত অগ্রযাত্রা ও বিস্তৃতির পেছনে কার্যকারণ শক্তি হিসেবে ছিল মুসলমানদের অটুট ঐক্য ও সংহতি। তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাতে বিশ্বাস ছিল তাদের ঐক্য ও সংহতির মূল সূত্র। রাসুল (সা.) ওপরের তিনটি মৌল বিশ্বাসের ভিত্তিতে এমন একটি সমাজের বুনিয়াদ কায়েম করেছিলেন, যার শ্রেষ্ঠত্ব ও আভিজাত্যের প্রতীক ছিল ইমান ও তাকওয়া। সব বংশগত কৌলিন্য, গোত্রীয় আভিজাত্য, রক্ত ও বর্ণের অহমিকাবোধের দাফন ঘটিয়ে শতধাবিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীকে কালেমায়ে তাইয়েবার পতাকাতলে সমবেত করতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। তাদের ঐক্য ও সংহতি ছিল সিসাঢালা প্রাচীরের মতো। কাফির, মুশরিক, মুনাফিক, ইহুদি ও খ্রিস্টান শক্তি তাই মুসলমানদের শক্তির উৎস এই পারস্পরিক ঐক্য ও সংহতির ভিত্তিমূলেই আঘাত হানতে প্রয়াস পায়।

হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)

রাসুল (সা.)-এর ইন্তেকালের পর খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) মুসলিম জাহানের সার্বিক দায়িত্ব লাভ করেন। এ সময় অনেক অমুসলিম গোত্র রাসুল (সা.)-এর ইন্তেকালের সুযোগে ইসলামকে তার বিকাশের প্রথম স্তরেই গলা টিপে হত্যার চেষ্টা চালায়। মুনাফিকদের একদল ইসলামের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ জাকাত প্রদানকেই অস্বীকার করে। কেউ আবার মদিনার কেন্দ্রীয় ভূমিকাকে অস্বীকার করতে চেষ্টা করে এবং মদিনা আক্রমণের স্বপ্ন দেখে। এমতাবস্থায় হজরত আবু বকর (রা.) শক্ত হাতে হাল ধরে সব প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলে নেন। খলিফার বাস্তবোচিত দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে স্বল্প সময়ে মুনাফিকদের সব তত্পরতা মিইয়ে যায়।

হজরত ওমর (রা.)।

হজরত আবু বকর (রা.)-এর পর খলিফা হন হজরত ওমর (রা.)। তাঁর অপ্রতিরোধ্য ব্যক্তিত্ব ও প্রভাব, অনুপম চরিত্র-মাহাত্ম্য এবং অতিমাত্রায় সচেতনতা সাময়িকভাবে হলেও শত্রুদের সব ধরনের শয়তানি অপচেষ্টায় বিরত থাকতে বাধ্য করে। ওমর (রা.)-এর ১০ বছরের খেলাফত আমল ছিল ইসলামের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা ও অবিরাম বিস্তৃতির যুগ। এ সময় মুসলিম বাহিনী সিরিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিন, মিসর, ইরান ও ইয়েমেন পুরোপুরিভাবে জয় করে।

 

হজরত ওসমান (রা.)

হজরত ওসমান (রা.) এর খেলাফতের প্রথম কয়েক বছর পরিপূর্ণ শান্তি-নিরাপত্তার আবহ বিরাজ করে। সেই সঙ্গে ইসলামী সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষামূলক অগ্রাভিযানও অব্যাহত থাকে। ইসলামের এ অব্যাহত অগ্রযাত্রা ও অগ্রাভিযান মুনাফিক ও ইহুদিদের অন্তর্জ্বালা বাড়িয়ে দেয়। সহস্র বছরের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ইরানি সাম্রাজ্য, সুদীর্ঘকালের অজেয় বিশাল রোমক সাম্রাজ্যকে নবোত্থিত এ মুসলিম শক্তির সামনে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে দেখে দুশমনরা বুঝতে পারে, সম্মুখ সমরে এ অজেয় বাহিনীকে কিছুতেই মোকাবিলা করা যাবে না। এদের ভেতরে অনুপ্রবেশ ঘটিয়েই কেবল অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব।

হজরত ওসমান (রা.)-এর দয়া ও সহিষ্ণুতা তাদের জন্য অপূর্ব সুযোগ এনে দেয়। রোমক সাম্রাজ্যের খ্রিস্টান অধিবাসীরা, পারস্য সাম্রাজ্যের অগ্নিউপাসকরা তাদের নিজ নিজ গৌরবমণ্ডিত বিশাল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য মুসলমানদের দায়ী মনে করে এবং যেকোনোভাবে মুসলমানদের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণে সংকল্পবদ্ধ হয়। এরাও আগে থেকে তত্পর ইহুদি ও মুনাফিকদের ঘৃণ্য অশুভ প্রয়াসের সঙ্গে হাত মেলায়।

এ সময় আবদুল্লাহ বিন সাবা নামক ইয়েমেনের অন্তর্গত সানআর একজন ইহুদি মুসলমান হওয়ার দাবি করে এবং আগে থেকে মুসলিম সমাজে অবস্থানরত মুনাফিকদের গোপন তত্পরতায় যোগ দেয়। অল্প দিনের মধ্যেই সে তার অসাধারণ সাংগঠনিক প্রতিভা, নেতৃত্ব গুণ, উদ্ভাবনী শক্তি ও নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে সব মুনাফিককে ছাড়িয়ে যায়। (আল বিদায়া ওয়াননিহায়া, ইবনে কাসির : ৭/১৬৭-১৭০)

হজরত আলী (রা.)

তারা হজরত ওসমান (রা.)-এর বিরুদ্ধে বিষোদগার করে মুসলমানদের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করে তাঁকে শহীদ করে। পরবর্তী সময়ে হজরত আলী (রা.)-এর ছত্রচ্ছায়ায় এসে কূটচাল আরম্ভ করে। এর ফলে হজরত আলী (রা.) ও মুয়াবিয়া (রা.)-এর সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে মুসলিম উম্মাহর রক্ত প্রবাহিত করে। পরবর্তী সময় ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে হজরত আলী (রা.)-কে শহীদ করে। তাঁর পুত্র হাসান (রা.)-কেও একই ষড়যন্ত্রের জালে শহীদ করে। পরবর্তী সময় কারবালায় হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতও একই সূত্রে গাঁথা। মুসলিম উম্মাহর মধ্যে অনৈক্য-ফেরকাবাজির যে সূত্রপাত অভিশপ্ত ওই ইহুদি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শুরু হয়, আজ পর্যন্ত ওই ফেতনার দ্বার বন্ধ হয়নি।

এত সব অপকর্ম ও কুকীর্তি ইহুদিদের পরিণত করেছে আল্লাহর অভিশপ্ত জাতিতে। আল্লাহ তাআলা এ জন্য যুগে যুগে তাদের ওপর নাজিল করেছেন তাঁর আজাব। আর তারা বারবার আল্লাহর গজবের শিকার হয়ে লাঞ্ছিত হতে থাকে। এভাবে ক্রমাগত আক্রমণের শিকার হয়ে এরা বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিতে থাকে এবং পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে।

কিন্তু পৃথিবীর কোথাও এদের ঠাঁই হয়নিপরিণামে তাদের শুধু শোচনীয় অবস্থার সম্মুখীনই হতে হয়েছে। পৃথিবীর কোথাও তারা কোনো দিনও স্থায়ীভাবে বাস করতে পারেনি। মধ্যপ্রাচ্য তো বটেই, শুধু ইউরোপেই তারা ৪৭ বার বহিষ্কৃত হয়েছে! সময়ের পরিক্রমায় তারা সারা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।

 

তারা ১৯২০ সালে ইংল্যান্ড থেকে এদের বিতাড়িত করা হয়। ফ্রান্স একবার ১৩০৬ সালে, দ্বিতীয়বার ১৩৯৪ সালে, ১৩৭০ সালে বেলজিয়াম, ১৩৮০ সালে চেকোশ্লোভাকিয়া, ১৪৪৪ সালে হল্যান্ড, ১৫৪০ সালে ইতালি, ১৫৫১ সালে জার্মানি এবং ১৫১০ সালে রাশিয়া ইহুদিদের তাদের নিজ নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত করে। তার মধ্যে নির্মমভাবে বিতাড়িত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। জার্মানির হিটলার এদের পাইকারিভাবে হত্যা করে বাকিগুলোকে বিদায় করে দেন।

যেখানেই গেছে, সেখানেই তারা ঘৃণার পাত্র হয়েছে, কোনো কোনো সময় হয়েছে বিতাড়িত। তবে ফরাসি বিপ্লব ইহুদিদের জন্য মুক্তির পয়গাম নিয়ে এসেছে। ইহুদিদের রচিত বিশ্বব্যাপী চক্রান্তের পরিকল্পনা পুস্তক protoukol (এর তরজমা পুস্তকের দ্বিতীয় খণ্ডে)-এ তারা উল্লেখ করেছে যে ফরাসি রাষ্ট্রবিপ্লবের পরিচালনা ও পরিকল্পনায় ইহুদি ষড়যন্ত্রকারীদেরই হাত ছিল। এ বিপ্লবের ফলে উনিশ শতকের শেষাংশে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানি, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, নরওয়ে, অস্ট্রিয়া এবং সুইজারল্যান্ড ইহুদিদের পূর্ণাঙ্গ নাগরিক অধিকার দান করে। কিন্তু তখনো পূর্ব ইউরোপে এরা ঘৃণার পাত্র ছিল। অস্ট্রিয়ার ইহুদি সাংবাদিক থিওদর হার্টজেল সর্বপ্রথম ইহুদিদের মধ্যে আজাদির প্রেরণা সৃষ্টি করে। প্রথম দিকে থিওদর ইংরেজদের পরামর্শে পূর্ব আফ্রিকায় একটি আজাদ ইহুদি রাষ্ট্র স্থাপন করতে আগ্রহী থাকলে অন্যান্য ইহুদি নেতা তার আগ্রহকে ফিলিস্তিনের দিকে নিবদ্ধ করতে উৎসাহিত করলে সে কার্যসিদ্ধির জন্য পৃথিবী চষতে শুরু করে। পাঁচ কোটি টাকার অর্থ সাহায্য দান করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক সংকট দূরীকরণের আশা দিয়ে তুর্কি সুলতান আবদুল হামিদকে (দ্বিতীয়) অনুরোধ করলে তা প্রত্যাখ্যাত হলে ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে তুর্কি খেলাফত ধ্বংসের পাঁয়তারা শুরু করে। ১৮৯৭ সালের ২৯ আগস্ট সুইজারল্যান্ডে আহ্বানকৃত বৈঠকে বিভিন্ন কূট ফায়সালা গৃহীত হয়।

কৃষি ও ব্যবসাক্ষেত্রে নিজেদের উন্নীত করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করে, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিষ্ঠা, জাতীয় চেতনা ও অনুভূতি জাগরণের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। আঞ্চলিকতা, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি সস্তা ও মুখরোচক স্লোগান মুসলমানদের মধ্যে ঢুকিয়ে আরব তুর্কি সম্পর্ককে নষ্ট করে শুরু হয় ইহুদিদের মরণ কামড়হতভাগা কুখ্যাত কামাল পাশা ২৫ হাজার ধর্মপ্রাণ মানুষকে হত্যা করে ইহুদিদের প্রভাবান্বিত পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে।

ফিলিস্তিনের বুকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড

কোরআনের ভাষায় আর তাদের ওপর আরোপ করা হলো লাঞ্ছনা ও পরমুখাপেক্ষিতা। ’ (সুরা বাকারা : ৬১)

ইসরায়েল রাষ্ট্রও তাদের লাঞ্ছনার একটি অংশ। যদিও বাহ্যিকভাবে তাদেরকে শক্তিধর ও সম্পদশালী ও সম্মানী মনে হয়, বাস্তব কথা হলো, এ রাষ্ট্র ইসরায়েলের নয়; বরং আমেরিকা ও ব্রিটেনের একটি ঘাঁটি ছাড়া আর কিছুই নয়। এ রাষ্ট্র নিজস্ব শক্তির ওপর নির্ভর করে এক মাসও টিকতে পারবে কি না সন্দেহ। পাশ্চাত্যের খ্রিস্টান শক্তি ইসলামী বিশ্বকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে তাদের মাঝখানে ইসরায়েল নাম দিয়ে একটি সামরিক ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করেছে। এ রাষ্ট্র আমেরিকা ও ইউরোপীয়দের দৃষ্টিতে একটি অগণিত আজ্ঞাবহ ষড়যন্ত্রকেন্দ্র ছাড়া অন্য কোনো গুরুত্ব বহন করে না। পাশ্চাত্য শক্তিবলয় বিশেষ করে আমেরিকার সঙ্গে নানা ধরনের প্রকাশ্য ও গোপন চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে তাদের মদদপুষ্ট ও আশ্রিত হয়ে নিছক ক্রীড়নকরূপে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। তা-ও অত্যন্ত লাঞ্ছনা ও অবমাননার ভেতর দিয়ে।

ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৬১৬ সালে world zionist organaisation ব্রিটেনের পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গে আলোচনায় লিপ্ত হয় এবং এর ফলে ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার কুখ্যাত ব্যালফরঘোষণায় ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জাতীয় আবাসভূমি স্থাপনের দাবি সমর্থন করে। এই কুখ্যাত ব্যালফরঘোষণায় ফিলিস্তিনে ১৯১৮ সালে ইহুদির সংখ্যা যেখানে ছিল মাত্র কয়েক হাজার, সেখানে ১৯৪১ সালে তা গিয়ে দাঁড়ায় দুই লাখ ৫০ হাজারে।

কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ অ্যামেরিকায় ওই ইহুদিদের বসবাসের ব্যবস্থা সম্ভব থাকলেও ব্রিটেনের কারণে ছয় লাখ ইহুদিকে আরবের প্রতিবাদ সত্ত্বেও ফিলিস্তিনে এনে বসানো হয়। এভাবে ফিলিস্তিন বিভক্ত হয়ে গেল। শুরু হলো অত্যাচারের স্টিমরোলার। ১০০ দিনের মধ্যে ১৭ হাজার মুসলিম নিহত। ২০ এপ্রিল ১৯৪৮ প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদে স্থগিত করা হয় সাময়িকভাবে। ১৪ মে ইহুদি নেতা বেন গুরিয়ান স্বাধীন ইহুদি রাষ্ট্র ঘোষণা দেয় কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই। এর এক মিনিট পর আমেরিকা দেয় তাদের স্বীকৃতি।

লাশ

তুরস্কের জেনগি রাজবংশের শেষ শাসক, বায়তুল মুকাদ্দাসের পুন:উদ্ধারের স্বপ্নদ্রষ্টা, নূরউদ্দিন আবুল কাসিম মাহমুদ ইবনে ইমাদউদ্দিন জেনগি (ফেব্রুয়ারি ১১১৮ ১৫ মে ১১৭৪) ছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভূত জেনগি রাজবংশীয় শাসক। ১১৪৬ থেকে ১১৭৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি সেলজুক সাম্রাজ্যের সিরিয়া প্রদেশ শাসন করেছেন। তিনি ১১৪৬ থেকে ১১৭৪ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। তাঁকে দ্বিতীয় ক্রুসেডের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসাবে গণ্য করা হয়।

সুলতান মাহমুদ জেনগি স্বপ্নে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছিলেন, রাসুলুল্লাহ ( সা) স্বপ্নে তাঁকে দুজন লোক দেখিয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুলতানকে তাদের ক্ষতি থেকে রক্ষা করার নির্দেশ দিলেন। তারপর সুলতান দ্বিতীয় রাতে এবং তৃতীয় রাতে ঠিক একই স্বপ্ন দেখেন। তিনি বিচলিত ও বিক্ষুব্ধ হয়ে এক বাহিনীসহ দ্রুত মদীনায় পৌঁছেনতিনি মদীনা মনোয়ারার অধিবাসীদের ডেকে পাঠান। কিন্তু মদিনাবাসিদের পক্ষ থেকে তাকে বলা হয় দু'জন 'ধার্মিক ব্যক্তি' অনুপস্থিত। ইবাদত ও দান-খয়রাতেই তারা দিন-রাত অতিবাহিত করেন। সুলতান তাদের বাড়িতে প্রবেশ করলেন এবং দেখলেন যে তিনি ঠিক সেই দুজন লোককে স্বপ্নে দেখেছিলেন এবং তারা একটি সুড়ঙ্গ খুঁড়েছিলেন যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রওজার কাছাকাছি গিয়েছিল। তারা সুলতান নূরউদ্দিনের কাছে স্বীকার করে যে তারা গুপ্তচর ছিল এবং তারা মহানবী (সাঃ) এর দেহ মোবারক চুরি করতে চেয়েছিল। এ ধৃষ্টতা ও সাহস দেখে সুলতান তাদের দুজনকে আগুনে পুড়ে হত্যা করেছিলেন। অত:পর তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে এক হাজার মন সিসা গলিয়ে রওজা শরীফের চতুষ্পার্শে মজবুত প্রাচীর নির্মাণ করে দেন। যেন ভবিষ্যতে আর কেউ প্রিয় নবীজির কবর পর্যন্ত পৌছাতে সক্ষম না হয়। তারপর তিনি কায়মনোবাক্যে আল্লাহ্‌পাকের শুকরিয়া আদায় করলেন এবং তাকে যে এত বড় খেদমতের জন্য কবুল করা হল সেজন্য সপ্তাহকাল ব্যাপী আনন্দাশ্রু বিসর্জন দিলেন। ইতিহাসের পাতা থেকে অবগত হওয়া যায় যে, নূরউদ্দিন জেনগি (র:) ইন্তিকাল করলে অসীয়ত মোতাবেক তার লাশকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজা মোবারকের অতি নিকটে দাফন করা হয়। উল্লেখ্য রাসূল (সা) এবং তাঁর দুসাথী আবুবকর ও ওমর (রাঃ)-এর লাশ চুরি করার জন্য পাঁচবার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবারেই আল্লাহ তাআলার অসীম রহমতে তা ব্যর্থ হয়ে গেছে।

 

 

ওসমানীয় খেলাফাত ধ্বংসে ইহুদি চক্র

ওসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ ছিলেন উম্মাহ দরদি মুসলিম বিশ্বের খলিফা যাকে ইয়াহুদীরা বায়তুল মুকাদ্দাস হস্তান্তরের জন্য বিশাল পরিমাণ অর্থ দিতে চেয়েছিল কিন্তু তিনি মুসলিম বিশ্বের একচুল মাটি ছাড়তেও রাজি হননি। সুলতান আব্দুল হামিদ নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ইহুদিদের আন্তর্জাতিক সংগঠনের কিছু নেতা তার দরবারে উপস্থিত হয়ে ফিলিস্তিনে বসতি নির্মাণের আবেদন করে। কিন্তু ওসমানি খেলাফতের নীতিতে ইহুদিদের ফিলিস্তিনে আগমন এবং বায়তুল মুকাদ্দাসে ভ্রমণের অনুমতি থাকলেও, ফিলিস্তিনে জমি ক্রয় ও বসতি নির্মাণের অনুমতি ছিল না। ফলে বিগত শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত পুরো ফিলিস্তিনে ইহুদিদের কোনো বসতি ছিল না। ইহুদিরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছিল। কোথাও তাদের স্বতন্ত্র দেশ, শহর ছিল না। সুলতান আব্দুল হামিদ ইহুদিদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ, ফিলিস্তিন ঘিরে ইহুদিদের সুদূরপ্রসারী কূটকৌশলের ব্যাপারে তিনি অবগত ছিলেন।

তিনি আরো লিখেছেন, দ্বিতীয়বার ইহুদি প্রতিনিধি দল এসে প্রস্তাব দেয় আমরা ওসমানি সাম্র্রাজ্যের জন্য একটি বড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে প্রস্তুত। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ইহুদি বিজ্ঞানীরা শিক্ষাদান করবেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে উন্নতির জন্য তারা উসমানি সাম্রাজ্যকে সাহায্য করবে। বিশ্ববিদ্যালয়টির পৃষ্ঠপোষকতা ও জমির অনুমতি দেয়া হোক। সুলতান আব্দুল হামিদ জবাব দিলেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির পৃষ্ঠপোষকতা ও জমি দানের জন্য প্রস্তুত। তবে শর্ত হলো, এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ফিলিস্তিন ব্যতীত অন্য কোনো স্থানে স্থাপিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়টির নামে তিনি ফিলিস্তিনে ইহুদি বসতি নির্মাণের অনুমতি দিতে অক্ষম। শর্ত শুনে ইহুদিরা ভগ্ন হূদয়ে বিদায় নেয়।

তৃতীয়বার ইহুদি প্রতিনিধি দল এসে সরাসরি প্রস্তাব দেয়, যত অর্থ প্রয়োজন সুলতানকে দেয়া হবে, বিনিময়ে নির্দিষ্ট সংখ্যক ইহুদিকে ফিলিস্তিনে বসবাসের অনুমতি দেয়া হোক। প্রস্তাব শুনে সুলতান আব্দুল হামিদ তাদের অত্যন্ত কঠোর ভাষায় ধমকি ও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন, দ্রুত দরবার ত্যাগের আদেশ করেন এবং ভবিষ্যতে তাদের সাক্ষাতের সময় দেয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।

এ ঘটনার পর ইয়াহুদীরা বুঝে যায়, খলীফা দ্বিতীয় আবদুল হামিদ ক্ষমতায় থাকতে তারা আরবে কোনো রাষ্ট্র গঠন করতে পারবে না। তৎকালীন ইয়াহুদী প্রধান ইসরাঈল রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা থিওডোর হার্জেল খলীফার সাথে দেখা করতে এলে তিনি তাকে সাক্ষাৎ প্রদানে রাজি হননি। পরবর্তীতে হার্জেল ২০ মিলিয়ন পাউন্ডের মাধ্যমে সারা বছর ইহুদীরা বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রার্থনা করার অনুমতি চায়। (অটোমান খিলাফতের সময় ইয়াহুদীরা তিন ঘন্টা অবস্থানের শর্তে প্রতি বছর মাত্র একমাসের জন্য জেরুজালেমে প্রবেশ করতে পারত।) খলীফা হার্জেলের এই প্রস্তাবও নাকচ করে দেন। ফিরতি চিঠিতে তিনি লেখেন, তারা যেন এই পরিকল্পনা নিয়ে আর অগ্রসর না হয়। তাদেরকে জেরুজালেমের এক মুঠো মাটিও দেওয়া হবে না, যেহেতু এটার মালিক তিনি নন। এটা মুসলিমদের রক্তে কেনা ভূমি। (তারিখে দাওয়াতিল উসমানীয়্যা, ইয়ালমায উসতুনা)

এই ঘটনার পর তুরস্কে সুলতানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে ষড়যন্ত্রের গোড়ায় পুরোদমে পানি দেয়া শুরু হয়। নানা ধরনের মিথ্যা অভিযোগ-অপবাদ আরোপ করে জনগণকে সুলতানের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলে ক্ষমতাচ্যুত করে নির্বাসনে পাঠানো হয়। তাঁর ভাই পঞ্চম মুহাম্মদ নামমাত্র সুলতান হন। সেই রাতেই সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদকে স্যালোনিকায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। সেখানে তাকে এক ইহুদির বাড়িতে কড়া নজরবন্দির মধ্যে রাখা হয়। এরপর তাকে ইস্তাবুলে এনে বেইলেরবিক প্রাসাদে রাখা হয়। আত্মজীবনীটি তিনি এই সময়ে রচনা করেন। তিনি আরো লিখেছেন, তার ক্ষমতাচ্যুতির ফরমান নিয়ে যে প্রতিনিধি দল এসেছিল, সেখানে তুর্কি পার্লামেন্টের ইহুদি সদস্য কুরাসুউপস্থিত ছিল। কুরাসুপূর্বের ইহুদি প্রতিনিধি দলের সঙ্গেও উপস্থিত ছিল। এতে প্রমাণিত হয়, সুলতানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উস্কানি থেকে ক্ষমতাচ্যুত পর্যন্ত সমস্ত ষড়যন্ত্র ইহুদিদের নীল নকশায় বাস্তবায়িত হয়েছিল।

 

 

 

আব্দুল হামিদ নির্বাসিত অবস্থায় মুসলিম উম্মাহর জন্য আকুল হয়ে কাঁদতেন। কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য তিনি কারও সাথে দেখা করতে পারতেন না। তার সহকারী হিসামিদ্দীন বলেন, খলীফা খিলাফতে আরোহণের পর থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত প্রায়শই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন, ‘হয় খিলাফত, নয় শাহাদাত।গৃহবন্দি অবস্থায় ১৯১৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনি বেইলেরবিক প্রাসাদে ইন্তিকাল করেন। তিনিই ছিলেন অটোমান সাম্রাজ্যের সর্বশেষ প্রকৃত খলীফা।

জীবদ্দশায় তিনি যত অপবাদ ও প্রপাগাণ্ডার শিকার হয়েছেন সমকালীন ইতিহাসে আর কোন শাসক ততটা হয়নি। তাঁর মৃত্যুর পর অনেকেরই চোখ খুলেছিল। তাদেরই একজন আনোয়ার পাশা। খেলাফতে উসমানিয়ার যুদ্ধমন্ত্রীও নব্য তুর্কিদের অন্যতম প্রধান নেতা ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তার একক জেদ ও হঠকারিতার ফলেই ওসমানীয়রা জার্মানির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করে। ফলে খিলফতের পতন ত্বরান্বিত হয়। সেই আনোয়ার পাশা পরবর্তীতে তিনি বলেন, “ জামাল আমাদের আসল মুসিবতটা কি জান?…আমরা বিপ্লব সংঘটিত করেছি। কিন্তু নিজেদের অজান্তে কখন জায়োনিস্টদের ক্রিড়নকে পরিণত হয়েছি টেরই পাইনি। আসলে আমরা ছিলাম নির্বোধ।

তেমনি আরেকজন ছিল কবি রেজা তাওফিক। যে নব্য তুর্কিদের তাত্ত্বিক ও দার্শনিক ছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে নিজের ভুল বুঝতে পারে ও সুলতানকে উদ্দেশ্য করে লিখে,“ হে মহান সুলতান, ইতিহাস যখন আপনাকে স্মরণ করবে সত্য আপনার পক্ষেই থাকবে/ আমরা নির্লজ্জভাবে আপনার উপর অপবাদ চাপিয়েছি/ অথচ আপনি ছিলেন আমাদের যুগের শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ/ আমরা বলতাম সুলতান জালেম, সুলতান পাগল, তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ অপরিহার্য/ শয়তান যা যা বলেছিল আমরা সব বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম/ আমরা ঘুমন্ত ফেতনাগুলোকে জাগিয়ে তুলতাম/ কিন্তু হে আমার মুনিব, আপনি পাগল ছিলেন না/ পাগল ছিলাম আমরা কিন্তু আমরা তা বুঝতেও পারিনি/ না শুধু পাগলই নই; বরং আমরা মানুষ্য চরিত্রও হারিয়ে ফেলেছিলাম/ আমরা আপনার উপর নির্লজ্জভাবে অপবাদ চাপিয়েছি।

তুর্কি সেনাবাহিনীর কর্ণেল হুসামুদ্দিন আর্তুর্ক বলেন,“ জায়নিস্টদের বিরুদ্ধে সুলতান আব্দুল হামিদের পদক্ষেপের অর্থই ছিল নিজ ক্ষমতা ও সিংহাসন হারানো।

প্রখ্যাত ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী আর্লন্ড টয়েনবি লিখেন,“ সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদের ইসলামি রাজনীতির উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বের মুসলমানদের এক পতাকার নিচে একত্রিত করা। নিঃসন্দেহে যা ছিল মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের ঐপনিবেশিক শক্তিগুলোর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক পাল্টা শক্তিশালী প্রতিরোধী পদক্ষেপ।তাকে নিয়ে ইউরোপিয়রা এত বেশি পরিমাণে লিখেছে যে, সমকালীন ইতিহাসে তো বটেই, সুদীর্ঘ সাড়ে চৌদ্দশত বছরের ইতিহাসে অন্য কোন মুসলিম শাসককে নিয়ে তারা ততটা লেখেনি। যার গুটিকয়েকটি ছাড়া সবগুলোই অপবাদ মিথ্যাচার ও প্রপাগাণ্ডায় পূর্ণ।

ওসমানি সম্রাজ্যের পতনে ইহুদি ষড়যন্ত্রের কথা আরেকবার প্রমাণিত হলো, প্রায় ১০০ বছর পর দেয়া ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল মোফাজের ২০০৫ সালের ভাষণে! লাহোরের দৈনিক নাওয়ায়ে ওয়াক্ত২০০৩ সালের ৫ মার্চ ইসরায়েলের একটি সংবাদপত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেছিল, ইসরায়েলের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল মোফাজ বলেছেন, অল্প কয়েকদিনের ভেতর ইরাক আমাদের দখলে আসবে।

আমাদের কাজে বাধা দানকারীর পরিণতি হবে ইরাকের মতোই। উসমানি খলিফা আব্দুল হামিদ আমাদের ফিলিস্তিনের জমি দিতে অস্বীকার করেছিল। ফলে আমরা শুধু তার ক্ষমতা ধ্বংস করেছি এমন নয়; বরং ওসমানীয় সাম্রাজ্যকে টুকরো টুকরো করে দিয়েছি।

ইসরাইল রাষ্ট্র

ইসরাইল রাষ্ট্রকে পাকাপোক্ত করার জন্য পরপর চারটি যুদ্ধ করে আরব দেশগুলোর ওপর অতর্কিতে সামরিক হামলা চালিয়ে আরব ভূখণ্ড দখল করে নেয় ইহুদিরা। ১৯৪৮ সালে প্রথম ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারপর থেকে প্রতিনিয়ত ফিলিস্তিনি মুসলমানদের ওপর চালিয়ে এসেছে অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্যাতনসহ চরম অমানবিক কার্যক্রম। আর তাদের কুবুদ্ধির মদদ দিচ্ছে পরাশক্তি আমেরিকা। ইসরাইলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এর অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে আমেরিকাই। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল যখন স্বাধীনতা ঘোষণা করে তখন

১৯১১ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফোরের ঘোষণার মাধ্যমে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্র দীর্ঘকাল ধরে একই নীতি অনুসরণ করে আসছে। প্রত্যহ ফিলিস্তিনি মুসলমানদের ওপর অত্যাচার নিপীড়ন হচ্ছে। পুরো গাজায় এখন শুধু অশান্তির বাতাস। পুরো উপত্যকা জ্বলছে, আর ঝরছে আরবদের প্রাণ। রক্ষা পাচ্ছে না নিষ্পাপ শিশুরাও। এ রাষ্ট্রের জন্য ১৯৫৬ সালে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সহযোগিতায় ইসরাইল মিসরের ওপর হামলা চালায়।

 ১৯২১ সালে ইহুদিরা হাগানানামের একটি জঙ্গিবাহিনী গঠন করে। এ বাহিনী ইহুদিবাদীদের রাষ্ট্র গঠনের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৬৭ সালে আমেরিকা ও ব্রিটেনের উসকানিতে ইসরাইল বিমান হামলা করে মিসরের সিনাই, গাজা এলাকা ও জর্দান নদীর পশ্চিম তীর দখল করে নেয়। ১৯৭৩ সালে সিরিয়ায় গোলান মালভূমি দখল করে। এই ইহুদিরাই বনি ইসরাইলের নবীদের হত্যা করেছে। ইসলাম ও নবীদের অবমাননা ইহুদিদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য। আজো ওরা তাদের নবীবিদ্বেষী চরিত্র থেকে মুক্ত হতে পারেনি। ২০১২ সালে সেপ্টেম্বর মাসে নাকুলা বাসিলে নামের ইহুদি নির্মাণ করে ইননোসেন্স অব মুসলিমশীর্ষক পবিত্র ইসলাম ও মহানবী সা:-এর অবমাননাকর চলচ্চিত্র। তাকে সহায়তা করেছে কুখ্যাত মার্কিন পাদ্রি টেরি জোন্স। ইহুদি ব্যবসায়ীদের অর্থে ৫০ লাখ ডলার ব্যয়ে নির্মিত ছবিটি বেশ রহস্যজনক। এ চলচ্চিত্রে বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ সা:-এর চরিত্রকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা হয়েছে।

মোসাদের হাতে খুন হন ফিলিস্তিন লিবারেশন অরগানাইজেশনের সাবেক প্রধান ইয়াসির আরাফাতের সহযোগী, আবু জিহাদ ওরফে খলিল আল ওয়াজির। ১৯৮৮ সালে তিউনিসিয়ার রাজধানী তিউনিসে ইসরাইল কমান্ডো অভিযান চালিয়ে আবু জিহাদকে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ডের ২৫ বছর পর ইসরাইলি দৈনিক ইয়েদিউথ আহরোনোথ১ নভেম্বর প্রকাশিত এক খবরে তাকে হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেছে

ইসরাইল ১৯৮১ সালে ইরাকের পারমাণবিক প্রকল্পে হামলা চালিয়ে তা ধ্বংস করে দেয় প্রতিদ্বন্দ্বীর উত্থানের আশঙ্কায়। বায়তুল মোকাদ্দাস শহরে খ্রিষ্টান ধর্মযাজকদের একটি কেন্দ্রে প্রবেশপথে হজরত ঈসা আ: ও তার মা হজরত মরিয়ম আ: সম্পর্কে হিব্রু ভাষায় অশালীন বক্তব্য লিখে তাদের অবমাননা করেছে ইহুদিবাদীরা। ইতালীয় ওয়েবসাইট কাস্টডিয়া টেররা সান্টাএই খবর দিয়েছে। ভ্যাটিকানের সাথে সম্পর্কিত এই ওয়েবসাইট জানিয়েছে- মুসলমানদের প্রথম কেবলা অধ্যুষিত জেরুসালেমে বা বায়তুল মোকাদ্দাস শহরের জিহুন বা জায়ান পাহাড়ে ক্যাথলিকদের ধর্মকেন্দ্র, সানফ্রান্সিসকো মনাস্টারির অন্যতম প্রবেশপথের দেয়ালে এই অপকর্ম করা হয়েছে। ইহুদিবাদী দখলদাররা হজরত ঈসা মসিহের জন্ম বৈধ ছিল কি না সেই প্রশ্ন করা হয়েছে, ওই অশালীন দেয়াল লিখনে।

 

এডলফ হিটলারের ইহুদি নিধন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ৬০ লক্ষ ইহুদী হত্যা করেছিলেন এডলফ হিটলার। ইতিহাসে এটি হলোকস্টনামে পরিচিত। হিটলার চেয়েছিল পৃথিবী থেকে ইহুদীদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে। তাই তিনি এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিলেন। ধারণা করা যায় ইহুদীদের প্রতি হিটলারের অতিমাত্রায় ক্ষোভ এবং ঘৃণাই ছিল এই হত্যাকান্ডের মুল কারণ ।কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন এমন বিভৎস ক্ষোভ আর নির্মম ঘৃণা জন্ম নিয়েছিল জার্মান এই রাষ্ট্র প্রধানের মনে ?ইহুদীদের প্রতি হিটলারের এমন ভয়াবহ ঘৃণার সঠিক কারন বের করা অসম্ভব। হিটলার নিজেও সরাসরি কোন কারণ বলে যান নি। ইতিহাসবিদেরাও

সঠিক কোন কারন বের করতে পারেনি। তবে কয়েকটি কারন অনুমান করা হয়, যা হিটলারের মনে ইহুদী বিদ্বেষের জন্ম দিয়েছিল।

এডলফ হিটলার জার্মানির নাৎসি নেতা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন তিনি ইহুদিদের হত্যা করেছিলেন। হিটলারের ইহুদিদের প্রতি ঘৃণার কারণ হিসেবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের জন্য ইহুদিদের দায়ী করার কথা বলা হয়। যদিও এটা একটা ধারণা মাত্র।

ড. মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম,  ইসলাম ও অন্যান্য মতবাদ : পৃ. ৮৪ বইয়ে উল্লেখ করেন-

হিটলারের ইহুদি হত্যার আসল কারণ হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মুহূর্তে ইহুদি নেতারা বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইহুদিরা ওই সময় পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করে। ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদিদের দেশত্যাগ প্রয়োজন। কিন্তু কোনো ইহুদি ইসরাইল রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে দেশত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিল না।

তখন ইহুদি নেতারা হিটলারের সাথে এক গোপন ইহুদি হত্যা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। যাতে করে বিশ্বব্যাপী ইহুদিদের মধ্যে ভয় ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করা যায় এবং তারা ইসরাইলের উদ্দেশ্যে দেশত্যাগ করার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে বাধ্য হয়। চুক্তি অনুযায়ী ৪ লাখ ৫০ হাজার ইহুদির মধ্যে মাত্র ৭ হাজারকে ইসরাইলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয় এবং অবশিষ্টদের হত্যার নীলনকশা করা হয়। হিটলার ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে জড়ো করে গ্যাস বোমা মেরে হত্যা করে।

এরপরও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইহুদিরা ইসরাইলের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করতে রাজি না হওয়ায় ইহুদি নেতারা বিশ্বের সর্বত্র ইহুদি হত্যার গোপন পরিকল্পনা হাতে নেয়। যাতে করে তাদের মধ্যে ভয়ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয়। ইহুদিরা ইসরাইলের হাইফা বন্দরে এসেও জাহাজ থেকে নামতে রাজি না হওয়ায় ইহুদি বোঝাই জাহাজটিকে তাদের নেতা ডেভিড গুরিওন বোমা মেরে সাগরে ডুবিয়ে দেয়। এভাবে আল্লাহর ঘোষণা সত্যে পরিণত হয়।

এতদসম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, আরো স্মরণ করো, যখন তোমাদের রব ঘোষণা দিলেন, তিনি কেয়ামত পর্যন্ত সবসময় বনি ইসরাইলের ওপর এমন লোককে প্রভাবশালী করবেন যারা তাদের নিকৃষ্টতম শাস্তি দান ও নির্যাতন করতে থাকবে। (সূরা আরাফ, ১৬৭)

মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইহুদিবাদি ইসরায়েল রাষ্ট্রের আজ

১৪ মে, ১৯৪৮ সালে বর্তমানে ফিলিস্তিনের বুকে অবৈধ ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা্য লাখ লাখ ফিলিস্তিনী বাস্তু-চ্যুত হয়েছে। নিহত হয়েছেন হাজার হাজার ফিলিস্তিনি মুসলমান। বর্তমানে ইসরায়েল আধিপত্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী নীতির দ্বারা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ভূমি গ্রাস করে ফিলিস্তিনকে বিশ্ব মানচিত্রে একটি পরাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। ইসরায়েল পশ্চিম এশিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যের একটি রাষ্ট্র। আয়তন ২২ হাজার ৭২ বর্গকিলোমিটার। এটি ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ-পূর্ব তীরে ও লোহিত সাগরের উত্তর তীরে অবস্থিত। দেশটির উত্তর স্থলসীমান্তে লেবানন, উত্তর-পূর্বে সিরিয়া, পূর্বে জর্দান ও ফিলিস্তিনি-অধ্যুষিত ভূখন্ড পশ্চিম তীর, পশ্চিমে ফিলিস্তিনি ভূখন্ড গাজা উপত্যকা এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে মিশর অবস্থিত।ইসরায়েলে প্রায় ৮৩ লক্ষ লোকের বাস। এটি মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ; এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩৮১ জন লোক বাস করে। এদের মধ্যে ৬১ লক্ষ ইহুদী ধর্মাবলম্বী এবং ১৭ লক্ষ আরব জাতিভুক্ত (যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান)১৮৯৭ সাল থেকেই ইহুদিরা চেয়েছিলেন নিজেদের জন্য আলাদা একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে ইহুদীরা ফিলিস্তিন আসা শুরু করলে ১৯০৫ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা কয়েক হাজারে উন্নীত হয়।১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশদের সহযোগিতায় ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০ হাজারে গিয়ে দাঁড়ায়।প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে বর্তমান ইসরাইল-ফিলিস্তিন অঞ্চল অটোম্যান সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মুসলমান শাসকদের অদূরদর্শিতা এবং ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্রের কারণে ১৯২৪সালে তুরস্কে ওসমানীয় খিলাফতের পতন ঘটে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ বাহিনী ১৯১৭ সালে ইরাক, সিনাই উপত্যকা,ফিলিস্তিন ও পবিত্র জেরুজালেম দখল করে নেয়। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর বর্তমান ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন অঞ্চলগুলো ইংল্যান্ড-ফ্রান্সের ম্যান্ডেটের অধীন চলে যায়। এই সময়েই ইহুদি জায়ানিস্ট সংঘের তৎপরতা বাড়তে থাকে এবং ইউরোপে বসবাসকারী ইহুদিদের ফিলিস্তিন অঞ্চলে ফিরে যাওয়ার আন্দোলন তীব্রতর হতে থাকে।  ১৯১৭ সালে থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের ভূমি ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তখন ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে ফিলিস্তিনের মাটিতে ইহুদিদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠনের জন্য সহায়তা করবে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯১৭ সালের ২রা নভেম্বর ব্রিটেনের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার জেমস বেলফোর বিষয়টি জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন ইহুদি আন্দোলনের নেতা ব্যারন রটসচাইল্ডকে ।চিঠিতে মুসলিম প্রধান ফিলিস্তিন ভূখন্ডে একটি ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন। ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সে চিঠি বেলফোর ঘোষণা ( Balfour Declaration) হিসেবে পরিচিত।।“His Majesty's government view with favour the establishment in Palestine of a national home for the Jewish people, and will use their best endeavours to facilitate the achievement of this object, it being clearly understood that nothing shall be done which may prejudice the civil and religious rights of existing non-Jewish communities in Palestine, or the rights and political status enjoyed by Jews in any other country.”

বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের আলাদা রাষ্ট্রের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয় এবং বিপুলসংখ্যক ইহুদি বিভিন্ন সময় ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিনে এসে বসতি স্থাপন করতে থাকে।১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণার সময় ফিলিস্তিনে ইহুদি ছিল ৮ শতাংশ। এর মধ্যে বহিরাগত ইহুদিরা ৬ শতাংশ। বাকি ৯২ শতাংশই ছিল মুসলমান। ফিলিস্তিনের এই ৯২ শতাংশ স্থানীয় অধিবাসীকে অস্ত্রের বলে তাদের মাতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। বেলফোর ঘোষণা অনুযায়ী ব্রিটেন ফিলিস্তিনে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টার অঙ্গীকার করে। বেলফোর ঘোষণার ৩১ বছর পর ১৯৪৮ সালে আমেরিকা ও ব্রিটেনের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় জবরদস্তিমূলকভাবে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে আত্মপ্রকাশ করে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান ইহুদি রাষ্ট্রটিকে স্বীকৃতি দিতে সময় নিয়েছিলেন মাত্র ১১ মিনিট।ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেমন ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানী, নরওয়ে, পোল্যান্ড, গ্রীস এবং সুইজাল্যান্ডে বসবাসকারী ইহুদীদেরকে নেতারা আহবান জানান ফিলিস্তিনে বসতি গড়তে।তাছাড়া ব্রিটিশ সরকার ইহুদীদেরকে ফিলিস্তিন ছেড়ে দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে প্রায় আড়াই লাখ ইহুদী ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে পাড়ি জমায়। ১৯১৯ সালে ফিলিস্তিনে ইহুদির সংখ্যা ছিল কয়েক হাজার। ১৯১৯ থেকে ১৯২৩ সাল নাগাদ ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৩৫ হাজারে উন্নীত হয় ।ধীরে ধীরে ইসরাইল ইহুদীদের জন্য নিরাপদ ও স্বাধীন এলাকা হিসেবে গড়ে উঠার ফলে সেখানে ইহুদীর সংখ্যা দ্রুতই বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৩১ সালে ইহুদীদের সংখ্যা প্রায় ৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১ লাখ ৮০ হাজারে পৌঁছায় ১৯৪৮ সালে সেখানে ইহুদিদের সংখ্যা ছয় লাখে উন্নীত হয়। ১৯৩৩ সালের পর থেকে জার্মানির শাসক হিটলার ইহুদিদের প্রতি কঠোর হতে শুরু করলে জাহাজে করে হাজার হাজার ইহুদি অভিবাসী ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে আসতে থাকে। ব্যাপক হারে ইহুদি আগমনে ফিলিস্তিনীদের বোধোদয় যে তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে। এসময় ফিলিস্তিনী আরবরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য বিদ্রোহ করে। তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল ব্রিটিশ সৈন্য এবং ইহুদি নাগরিকরা । কিন্তু আরবদের সে বিদ্রোহ কঠোর হাতে দমন করে ব্রিটিশ সৈন্যরা।

১৯২০ সালে ইহুদীরা হাগানাহ নামের এক জঙ্গি বাহিনী তৈরি করে। এ বাহিনী ইহুদীবাদীদের রাষ্ট্র তৈরির কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রথম পর্যায়ে ফিলিস্তিনী জনগণের বিরুদ্ধে ইহুদীবাদীদের সহায়তা করা হাগানাহ বাহিনীর কাজ হলেও পরবর্তীকালে তারা সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী বাহিনীতে পরিণত হয়। ফিলিস্তিনী জনগণের বাড়িঘর ও ক্ষেতখামার দখল করে তাদেরকে ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত করা এবং বাজার ও রাস্তাঘাটসহ জনসমাবেশ স্থলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফিলিস্তিনীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা ছিল হাগানাহ বাহিনীর প্রধান কাজ। স্বাধীনতার পরে এই বাহিনী ইসরায়েলের মূল সামরিক বাহিনী গঠন করে ও বিভিন্ন জঙ্গি তৎপরতায় সাহায্য করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ইউরোপ থেকে আরো ইহুদীরা ফিলিস্তিনে আসে এবং তাদের অনেককেই হাগানাহ সহ অন্যান্য বাহিনীতে নেওয়া হয়। ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে দু'টি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ। একটি ইহুদিদের জন্য এবং অন্যটি আরবদের জন্য। ইহুদিরা মোট ভূখণ্ডের ১০ শতাংশের মালিক হলেও তাদের দেয়া হয় মোট ভূমির অর্ধেক। কিন্তু আরবদের জনসংখ্যা এবং জমির মালিকানা ছিল দ্বিগুণ।১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মুসলমানদের ফিলিস্তিনী ভূখন্ডকে দ্বিখন্ডিত করা সংক্রান্ত ১৮১ নম্বর প্রস্তাব গৃহীত হয়। জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দ্বিখন্ডিত করার প্রস্তাব পাশ করে মাত্র ৪৫ শতাংশ ভূমি ফিলিস্তিনীদের নিজেদের জন্য এবং বাকি ৫৫ শতাংশ ভূমি ইহুদীবাদীদের হাতে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। স্বভাবতই আরবরা এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। তারা জাতিসংঘের এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখান করে।এই সিদ্ধান্তে ফিলিস্তিনীদের ভূখণ্ডে তখন ইহুদিরা বিজয় উল্লাস শুরু করে। মার্কিনদের প্রবল চাপ ও মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগে ১৯৪৮সালের ১৪ মে ব্রিটিশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনির ম্যানডেট ছেড়ে দেয়।। একই দিনে তৎকালীন ইহুদি নেতারা রাতেই ইহুদি রাষ্ট্রের জন্ম ঘোষণা দেয়। এভাবে ১৯৪৮ সালের ১৪মে রাতের অন্ধকারে ইহুদিবাদি ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম।আমেরিকাসহ ইউরোপের অনেক দেশ ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদান করে ।ড্যাভিড বেন গুরিয়ন ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহন করে। ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের এক ঘন্টার মধ্যেই একসাথে পাঁচটি আরব দেশ ইসরায়েলকে আক্রমণ করে। যেসব দেশ একযোগে ইসরায়েলকে আক্রমণ করেছিল দেশগুলো - মিশর, ইরাক, লেবানন, জর্ডান এবং সিরিয়া। আরবদের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ত্রিশ হাজারের মতো। অন্যদিকে ইসরায়েলের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫ হাজার। জেরুজালেম দখলের জন্য যখন আরব এবং ইসরায়েলের মধ্যে চলছে তীব্র লড়াই। তীব্র লড়াইয়ের এক পর্যায়ে ইসরায়েলি বাহিনী পিছু হটতে থাকে। তাদের অস্ত্রের মজুত শেষ হয়ে যায়। সম্ভাব্য পরাজয় আঁচ করতে পেরে ইহুদিরা নিজেদের শক্তি সঞ্চয়ের জন্য সময় নেয়। আর কিছুদূর অগ্রসর হলেই আরব বাহিনী তেল আবিবের দিকে অগ্রসর হতে পারতো। তখন জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। যুদ্ধবিরতির সময় দু'পক্ষই শক্তি সঞ্চয় করে। কিন্তু ইসরায়েল বেশি সুবিধা কুরতে পেরেছিল। তখন চেকোস্লোভাকিয়ার (১৯৯৩ সালে এই রাষ্ট্র বিভক্ত হয়ে চেক প্রজাতন্ত্র  স্লোভাকিয়া নামক দুটি রাষ্ট্র গঠিত হয়) কাছ থেকে আধুনিক অস্ত্রের চালান আসে ইসরায়েলের হাতে। যুদ্ধ বিরতি শেষ হলে নতুন করে আরবদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ইসরায়েলি বাহিনী। একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নেয় ইহুদিরা। জাতিসংঘের মাধ্যমে আরেকটি যুদ্ধ বিরতির মাধ্যমে সে সংঘাত থামে। ইহুদিরা মনে করে তারা যদি সে যুদ্ধে পরাজিত হতো তাহলে আরবরা তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতো। আরব দেশগুলোর মধ্যে পারষ্পরিক আস্থা না থাকার কারণেই ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে তারা পরাজিত হয়েছে এবং ইসরায়েল দেশটির জন্ম হয়ে সেটি স্থায়ী হতে পেরেছে। যদিও বিশ্বের শান্তিপূর্ণ ও মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ ইসরায়েলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না।

মিত্রদের সহযোগিতা ও আশকারায় দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে ইসরায়েল। ষাটের দশকে পারমাণবিক বোমার মালিক বনে যায় তারা। দখলদারি ও বর্বরতার ব্যারোমিটার বাড়তে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসরায়েলের একগুঁয়েমি ও নৃশংসতায় ফিলিস্তিনে রক্তগঙ্গা বইতে থাকে। দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইলের অবৈধ দখল চালিয়ে যাওয়ায় বর্তমানে ফিলিস্তিন ২ হাজার ৪০০ বর্গমাইলের কয়েক টুকরো ভূমি মাত্র দীর্ঘ দিন ধরে দুই দেশের মধ্যে চলমান সংঘাতের কারণে সীমানাও নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। ভূমধ্যসাগর থেকে জর্ডান নদী পর্যন্ত পুরো অঞ্চলের সীমানা ধরা হয়। এখন বড় প্রশ্ন হলকে ওই এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। বাস্তবতা হলঅধিকাংশ ফিলিস্তিনিই এখন পশ্চীমতীরের ছোট কিছু বসতিতে থাকেন। আর গাজা উপত্যকা সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ। সম্প্রতি ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর পশ্চিমতীরের আরো কিছু অংশ ইসরাইলের অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা প্রকাশ করেছেন। দ্রুতই সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করবে ইসরাইল। ১৯৪৮ সালের পর আরব-ইসরায়েলের মধ্যে ১৯৫৬১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে আরও তিনটি যুদ্ধ হয়। এতে ফিলিস্তিনের ভাগ্যে দুর্ভোগ ছাড়া আর কিছুই জোটেনি।১৯৬৭ সালে ৬দিনের যুদ্ধে মিশরসিরিয়া এবং জর্ডানের সেনাবাহিনী ইসরায়েলের কাছে পরাস্ত হয়। ইসরায়েল গাজা উপত্যকামিশরের সিনাই মরুভূমিসিরিয়ার গোলান মালভূমি এবং জর্ডানের কাছ থেকে পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেম দখল করে। এ প্রথমবারের মতো ইহুদিদের জন্য পবিত্র জেরুজালেম ইসরায়েলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে। সেখান থেকে বহু ফিলিস্তিনীকে বিতাড়িত করা হয়। ১৯৭৮ সালে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এর ফলে মিশরকে সিনাই উপদ্বীপ ফিরিয়ে দেয়া হয় এবং প্রথমবারের মত কোনো আরব রাষ্ট্র কর্তৃক ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ৯৯৪ সালে ২৬ অক্টোবর জর্ডান এবং ইসরাইল শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। তখন পর্যন্ত জর্ডান ছিল দ্বিতীয় আরবদেশ মিশরের পর ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছে। তেল আবিবের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে তাদের শর্ত ছিলআগে ফিলিস্তিনের সঙ্গে ইসরায়েলের বিরোধের অবসান ঘটতে হবে। মুক্তির সংগ্রামের লক্ষ্যে ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজেশন (পিএলও)১৯৬৮ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ইয়াসির আরাফাত ছিলেন সংগঠনটির চেয়ারম্যান। তিনি ফিলিস্তিনের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক দল ফাতাহরও নেতা ছিলেন।ইসরায়েলি দখলদারির অবসান ঘটিয়ে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করতে ১৯৮৭ সালে গঠিত হয় হামাস। তাদের রাজনৈতিকসামাজিক ও সামরিক শাখা রয়েছে। কট্টরপন্থী সংগঠনটি ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয় না। ১৯৯৩ সালে সম্পাদিত অসলো প্রক্রিয়ারভিত্তিতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থার মধ্যে যে শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়তার ভিত্তিতে ১৯৯৬ সালে পশ্চিম তীর ও গাজায় নামকাওয়াস্তে ফিলিস্তিনি স্বায়ত্তশাসন কায়েম হয়। তত দিনে অবশ্য সেই অঞ্চলের একটা বড় অংশ ইসরায়েলের অবৈধ বসতির কবলেঅথবা সরাসরি সামরিক নিয়ন্ত্রণে। নামেই স্বায়ত্তশাসনকিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে চৌপ্রহর ইসরায়েলি প্রহরাউঁচু দেয়ালএক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে হলে ইসরায়েলি অনুমতিফলে এমন দেশকে স্বাধীন না বলে ছাদহীন কারাগার বলাই সংগত। । কিন্তু সেই প্রশাসনও দুই টুকরা হয়ে গেল ২০০৬ সালের নির্বাচনের পর। পশ্চিম তীর গেল ফাতাহর নিয়ন্ত্রণেগাজা গেল ইসলামিক ব্রাদারহুডের মিত্র হিসেবে পরিচিত হামাসের। ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে ফিলিস্তিনের দুই অংশ পশ্চিম তীর ও গাজা ২০০৭ সালের আগস্টে চলে যায় দুটি দলের নিয়ন্ত্রণে। সেই থেকে মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বে ফাতাহ পশ্চিম তীরে ও খালেদ মেশালের নেতৃত্বে হামাস গাজা শাসন করছিল। দুজনের সঙ্গে কথা বন্ধযখন-তখন বন্দুকযুদ্ধ। হামাস সন্ত্রাসবাদী দল ও ইসরায়েলের অস্তিত্ব স্বীকার করে নাএই অভিযোগে ইসরায়েলযুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন দলটির সঙ্গে সব সম্পর্ক বর্জন করে। 'সন্ত্রাসবাদীতকমা থাকায় হামাসের ওপর বারবার আক্রমণ করেও ইসরায়েল পার পেয়ে যায়। এমনকি ওই সব সামরিক আক্রমণে হাজার নিরীহ-নিরস্ত্র ফিলিস্তিনি নিহত হলেও নিজেকে নৈতিকভাবে শ্রেষ্ঠ দাবি করে ইসরায়েল। ফলে হামাস-ফাতাহ বিভেদে লাভবান হচ্ছে ইসরায়েল। অন্যদিকে নিজেরা যে আলাপ-আলোচনা করে মতৈক্যে পৌঁছবেফাতাহ বা হামাস কেউই তাতে আগ্রহী নয়। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে আরব শাসকরা সবাই শান্তির পক্ষে হলেও যুদ্ধের বিপক্ষে নয়। আরব রাজা-বাদশাহরা চাইলে ইসরায়েলকে চাপ দিতে পারত ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার ব্যাপারেযুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেনদরবার করতে পারত ইসরায়েলের ওপর সরাসরি প্রভাব বিস্তারে সক্ষম একমাত্র দেশটির নাম যুক্তরাষ্ট্র। এই দুই দেশ কৌশলগতভাবে ঘনিষ্ঠ মিত্র। দুই দেশে সরকার বদল হয়নতুন নেতৃত্ব আসেকিন্তু তাদের আঁতাতের কোনো হেরফের হয় না। যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই নিজেকে মধ্যপ্রাচ্য সংকটের নিরপেক্ষ 'মধ্যস্থতাকারীহিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নিরপেক্ষতার সরল অর্থ আগে ইসরায়েলের স্বার্থএরপর অন্য কথা। অনেকেই মনে করেনযুক্তরাষ্ট্রের এই একচোখা নীতি তাদের জাতীয় স্বার্থবিরোধীও। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী বব গেটস সরাসরিই কবুল করেছেনবিশ্বজুড়ে মুসলমানদের মধ্যে যে মার্কিনবিরোধী মনোভাবতার প্রধান কারণ যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যনীতি। তা সত্ত্বেও ইসরায়েল প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিবর্তিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ১৯৪৮ সালে তৎকালীন সৌদি বাদশাহ প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানকে বলেছিলেনফিলিস্তিন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র হয় নিরপেক্ষ থাকুক অথবা আরবদের সমর্থন দিক। ট্রুম্যান নাকি জবাবে বলেছিলেনদেশের অভ্যন্তরে কোনো আরব লবি নেইযাদের জোরে নির্বাচনে জেতা যাবে। এই বাস্তবতার আজও কোনো পরিবর্তন হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ পর্যন্ত নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছেকিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সফল হয়নি। বরং দশকের পর দশক ধরে সেখানে নতুন মাত্রায় সংঘাত জন্ম নিয়েছে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ২০১২ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায় ফিলিস্তিন। স্বভাবতই তখন এর তীব্র বিরোধিতা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল জোট। এর আগে তারা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে পর্যবেক্ষক ভূখণ্ডহিসেবে যোগ দিত। কিন্তু এখন সদস্য নয় এমন পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এই রায়কে সার্বভৌম ফিলিস্তিনের জন্মসনদবলে অভিহিত করেন। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনিদের জাতিসংঘের পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ পাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত আছে।তারা আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের (আইসিসি) সদস্যপদও লাভ করেছে। সম্প্রতি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রামকে চিরতরে নিঃশেষ করার লক্ষ্যে এক ভয়াবহ ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তি (ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি/শতাব্দীর সেরা চুক্তি) স্বাক্ষর করেছে। যে মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রইইউসহ বিশ্বের প্রায় সব পক্ষ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে মেনে নিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ সমঝোতায় পৌঁছার জন্য তৎপরঠিক তখনই যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কতিপয় আরব রাষ্ট্রের সহযোগিতায় ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্রকে সমূলে বিনাশ করার লক্ষ্যে ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে শতাব্দীর সেরা চুক্তি (!) স্বাক্ষর করে তা বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। এ চুক্তি মোতাবেক স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কোনো অস্তিত্ব নেই গাজা উপত্যকাজিহুদিয়া পার্বত্য অঞ্চল ও পশ্চিম তীরের সামারিয়া অঞ্চল নিউ প্যালেস্টাইন নামে পরিচিত হবে। আর বাকি সব অঞ্চলএমনকি এসব এলাকার ইহুদি বসতিগুলো সব স্বাধীন রাষ্ট্র ইসরাইলের অন্তর্ভুক্ত থাকবে। জেরুসালেম ইসরাইল ও নিউ প্যালেন্টাইনের যৌথ রাজধানী হবে। আরবরা নিউ প্যালেস্টাইন এবং ইহুদিরা ইসরাইলের নাগরিক হিসেবে গণ্য হবে। নিউ প্যালেস্টাইনের কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না। হালকা অস্ত্রধারী পুলিশ থাকবে। বহিঃশত্রু থেকে তাদের রক্ষার দায়িত্বে থাকবে ইসরাইল। অর্থাৎ সেনাবাহিনী অস্ত্রভাণ্ডার সবই থাকবে ইহুদিদের ও ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে। জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ থাকবে ইসরাইলি পৌরসভার হাতে। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিতে ফিলিস্তিনিদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চলছে। আর কত রক্ত ঝরলেলাশের মিছিল কতটা দীর্ঘ হলেতাদের ভূখণ্ড স্বপ্নের স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে ধরা দেবেতা এখনো অজানা। মিসরজর্দান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের পর আরববিশ্বের চতুর্থ রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দিয়েছে বাহরাইন। ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ও বাহরাইনের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগকে পেছন থেকে ছুরি চালানোহিসেবে দেখছে ফিলিস্তিন। তাদের জনগণ এ উদ্যোগে ব্যথিত ও মর্মাহত

 

বর্তমানে পৃথিবীর ১৬১টি রাষ্ট্র ইসরায়েলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও ৩১টি রাষ্ট্র (মূলত মুসলমান অধ্যুষিত) এখনও ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব মেনে নেয়নি এবং দেশটির সাথে তাদের কোনও কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। তাদের অনেকের মতে ইসরায়েল স্বাধীন রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের একটি অংশের অবৈধ দখলদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ড। তবে নিকটতম দুই আরব প্রতিবেশী মিশর ও জর্দানের সাথে ইসরায়েল শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছে ও দেশদুইটির স্বীকৃতিও লাভ করেছে।বাংলাদেশ ইসরায়েলকে নৈতিক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে না এবং বাংলাদেশী নাগরিকদের ইসরায়েলে ভ্রমনে সরকারী নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বাংলাদেশের পাসপোর্ট ইসরায়েল ব্যতিত বিশ্বের সকল দেশ ভ্রমনের জন্য বৈধ।বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র সমর্থন করে এবং ইসরায়েলের অবৈধভাবে প্যালেস্টাইন দখলের সমাপ্তি দাবি করে।বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তি সময়ে যেসব রাষ্ট্র বাংলাদেশকে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দেয়, ইসরায়েল তাদের মধ্যে অন্যতম। আরব দেশসমূহ স্বীকৃতি দেয়ার আগেই ইসরায়েল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ইসরায়েল সরকার এবং ইসরায়েলী নাগরিক সকলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশকে সমর্থন করেছিল। স্বাধীনতা পরবর্তি সময়ে নতুন স্বাধীনতা লাভকারী বাংলাদেশকে ইসরায়েল আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রধান করে, যা বাংলাদেশ সরকার নিরপেক্ষভাবে প্রত্যাখ্যান করে।।ইসরায়েলের জন্ম, ইতিহাস ও রাজনীতি মধ্যপ্রাচ্য সংকটের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকেই ইসরায়েল প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলির সাথে বেশ কয়েকবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়। দেশটি ১৯৬৭ সাল থেকে ফিলিস্তিনি-অধ্যুষিত পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা সামরিকভাবে দখল করে আছে। বিনা উস্কানিতে প্রায় ইহুদিবাদি ইসরায়েল ফিলিস্তিনি মুসলিমদের ওপর নিধনযজ্ঞ চালিয়ে আসছে। উল্লেখ্য মুসলিমদের প্রথম কেবলা ইসরায়েলের জেরুজালেমে অবস্থিত।

 

 

 

বিশ্ব মিডিয়াতে ইহুদিরা

বিশ্ব মিডিয়াতেও ছড়িয়ে আছে ইহুদিরা। মুসলমানদের নিহত হবার ঘটনা তাদের কাছে পান্তা ভাতের মতো। তাদের কাছে মুসলমানদের জীবন গুরুত্বহীন। নির্দোষ মুসলমানদের জঙ্গি ও সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে বেইজ্জত করাতে ওদের জুড়ি নেই। সন্ত্রাসী হামলায় কোনো মুসলিম যুক্ত থাকলে তার কাজের জন্য পুরো সম্প্রদায়কেই দায়ী করা হয়কিন্তু একই রকম ঘটনায় ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ জড়িত থাকলে গণমাধ্যমে শুধুমাত্র হামলাকারীকেই তুলে ধরা হয়।হামলাকারী অমুসলিম হলে, গণমাধ্যম তার ধর্মীয় পরিচয়ের দিকে জোর দেয় না। হামলাকারীকে মানসিকভাবে অসুস্থ বা উন্মাদ হিসেবে দেখানো হয়। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের ব্রেন্টন ট্যারেন্টের কথা এক্ষেত্রে একটি চমৎকার উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে। হামলার পর তাকে কোথাও শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীবা খ্রিষ্টান সন্ত্রাসীহিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। যদিও তার ৭৪ পৃষ্ঠার ইশতেহারের তার বর্ণবাদী আদর্শ ও ধর্মীয় ঘৃণার কথা সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেছে। কিছু সন্ত্রাসী হামলার খবর কেন গণমাধ্যমে বেশি গুরুত্ব পায়?” শীর্ষক ইউনিভার্সিটি অব অ্যালাবামা থেকে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৬ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র ১২ দশমিক ৫ শতাংশ সন্ত্রাসী হামলায় মুসলিমদের সংশ্লিষ্টতা ছিল। কিন্তু সন্ত্রাসী হামলা নিয়ে গণমাধ্যমে যত খবর প্রকাশিত হয়েছে তার অর্ধেকের বেশি ছিল এই হামলাগুলো সম্পর্কে।যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলায় জড়িতদের ধর্মীয় পরিচয়ের এই চিত্র তুলে ধরে গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, “আমরা সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছি যে সন্ত্রাসী হামলায় মুসলিমরা জড়িত থাকলে গণমাধ্যমে সেই খবর অমুসলিমদের সন্ত্রাসী হামলার খবরের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব পায়।মুসলিম সম্প্রদায়ের একজন যুক্ত ছিল এমন একটি সন্ত্রাসী হামলার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ওই ঘটনায় খবরের সংখ্যা ৩৫৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল।

আমেরিকার পত্রিকাগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী তিনটি পত্রিকা হলো নিউইয়র্ক টাইমস্ , ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল এবং ওয়াশিংটন পোষ্ট। এ তিনটি পত্রিকার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ইহুদিদের হাতে। ওয়াটারগেট কেলেংকারীর জন্য প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলো ওয়াশিংটন পোষ্ট। এর বর্তমান সিইও ডোনাল্ড গ্রেহাম ইহুদি মালিকানার তৃতীয় প্রজন্ম হিসেবে কাজ করছেন। উগ্রবাদী ইহুদী হিসেবে তিনি পরিচিত। ওয়াশিংটন পোষ্ট আরও অনেক পত্রিকা প্রকাশ করে। এর মধ্যে আর্মিদের জন্যই করে ১১টি পত্রিকা। এই গ্রুপের আরেকটি সাপ্তাহিক পত্রিকা পৃথিবী জুড়ে বিখ্যাত। টাইম এর পরে বিশ্বের দ্বিতীয় প্রভাবশালী এই সাপ্তাহিক পত্রিকাটির নাম নিউজউইক।আমেরিকার রাজনৈতিক জগতে প্রভাবশালী নিউইয়র্ক টাইমস্-এর প্রকাশক প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ইহুদিরা হয়ে আসছেন। বর্তমান প্রকাশক ও চেয়ারম্যান আর্থার সালজবার্গার প্রসিডেন্ট ও সিইও রাসেল টি লুইস এবং ভাইস চেয়ারম্যান মাইকেল গোলডেন সবাই ইহুদি।বিশ্বের অর্থনীতি যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের নিয়ন্ত্রণ করে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল। আঠার লাখেরও বেশী কপি চলা এই পত্রিকার ইহুদি প্রকাশক ও চেয়ারম্যান পিটার আর কান তেত্রিশটিরও বেশী পত্রিকা ও প্রকাশনা সংস্থা নিয়ন্ত্রণ করেন।

বিভিন্ন জনপ্রিয় পত্রিকা, স্যাটেলাইট নিউজ চ্যানেলগুলোর উচ্চপদে আসীন আছেন তারা। উলফ ব্লিটজার (সিএনএন), বারবারা ওয়াল্টার (এবিসি নিউজ), ইউগেনা মেয়ার (ওয়াশিংটন পোস্ট), হেনরি গ্রুনওয়াল্ড (টাইম ম্যাগাজিনের চিফ এডিটর), ক্যাথেরিন গ্রাহাম (ওয়াশিংটন পোস্টের এডিটর), জোসেফ লিলিয়েল্ড (নিউইয়র্ক টাইমসের এক্সিকিউটিভ এডিটর), ম্যাক্স ফ্রাংকেন (নিউইয়র্ক টাইমস)। এদিকে CNN, AOL, HBO, Cartoon Network, New line cinema, Warner Bross, Sports illustrated, People - ইহুদি মালিক নিয়ন্ত্রিত। ABC, Disney Channel, ESPN, Touchstone pictures - Michael Eisner ইহুদি মালিক নিয়ন্ত্রিত Fox Network, National Geographic, 20th century Fox Rupert Murdoch ইহুদি মালিক নিয়ন্ত্রিত।ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা Mark Zuckerberg একজন ইহুদি।

ইরাকের বিরুদ্ধে আমেরিকার আগ্রাসনকে সাধারণ আমেরিকানদের কাছে বৈধ হিসেবে চিত্রায়িত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ফক্স নিউজ। বিশ্ববিখ্যাত মিডিয়া মোগল রুপার্ট মারডকের নিয়ন্ত্রণাধীন এ রকম প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই জুইশদের সমর্থন দিয়ে এসেছে। রুপার্ট মারডকের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সারা বিশ্বের ১৮৫টি পত্রপত্রিকা ও অসংখ্য টিভি চ্যানেল। বলা হয়, পৃথিবীর মোট তথ্যপ্রবাহের ৬০ ভাগ কোনো না কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করে রুপার্ট মারডকের The News Corporation.আমেরিকায় দৈনিক পত্রিকা বিক্রি হয় প্রতিদিন কমপক্ষে ৫৮ মিলিয়ন কপি। জাতীয় ও স্থানীয় মিলিয়ে দেড় হাজার পত্রিকা সেখানে প্রকাশিত হয়। এসব পত্রিকাসহ বিশ্বের অধিকাংশ পত্রিকা যে নিউজ সার্ভিসের সাহায্য নেয় তার নাম দি এসোসিয়েটেড প্রেস বা এপি (AP)এ প্রতিষ্ঠানটি এখন নিয়ন্ত্রণ করছেন এর ইহুদি ম্যানেজিং এডিটর ও ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইকেল সিলভারম্যান। তিনি প্রতিদিনের খবর কী যাবে, না-যাবে তা ঠিক করেন।

 

আমেরিকার রাজনীতিতে ইহুদি প্রভাব

 

ইহুদিরা মার্কিন জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ, আর পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.২ শতাংশ। অর্থাৎ পৃথিবীর প্রতি ৫০০ জনে একজন ইহুদি! পৃথিবীতে ইহুদি এবং মুসলিমদের অনুপাত ১ঃ১০০। অর্থাৎ একজন ইহুদির বিপরীতে এক শজন মুসলিম। এর পরও মুসলিমদের চেয়ে কয়েক শগুণ ক্ষমতাবান ইহুদিরা। এর কারণ হিসেবে বলা যায় সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সব দিক দিয়েই ইহুদিরা এগিয়ে।জনসংখ্যার দিক দিয়ে ঢাকা শহরের কাছাকাছি। হতে পারে ইহুদিরা আমেরিকার মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশ, কিন্তু আমেরিকান রাজনীতিতে তাদের প্রভাব একচেটিয়া। তারা মোট সম্পদের ৫০ শতাংশের মালিক।আমেরিকার ইহুদি জনগোষ্ঠীর ৮৯ শতাংশ বাস করে ১২টি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে, যাদের বলা হয় ইলেকটোরাল কলেজ স্টেটস। উল্লেখ্য, ইহুদিদের ভোট সব সময় এক দিকে যায়। যারা তাদের জন্য কাজ করবে তাদের ভোট দেয়। তাই সহজেই ভোট দিয়ে নির্বাচন করতে পারে তাদের পছন্দমতো প্রেসিডেন্টকে। আবার এমনও দেখা যায়, যারা ইহুদি নয় কিন্তু ইহুদিদের প্রতি সহানুভূতিশীল।

তাদের সংখ্যা ধরলে ইহুদিরাই সবচেয়ে বড় ভোট ব্যাংক। এটা হলো অনানুষ্ঠানিক ইহুদি লবি, যা আনুষ্ঠানিক ইহুদি লবির অতিরিক্ত। আমেরিকার ১০০ জন সিনেটরের ১৩ জন ইহুদি। এর চেয়ে ভয়ংকর তথ্য হলো, ইহুদিদের সমর্থন ছাড়া কোনো আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেন না, কোনো প্রেসিডেন্ট প্রেসিডেন্ট থাকতে পারেন না।বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব যতোটা; আমেরিকার রাজনীতিতে ইহুদিদের প্রভাব তার চেয়েও অনেক অনেক বেশি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তহবিল সংগ্রহ একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। বারাক ওবামা বা বিল ক্লিনটন নিজের টাকায় প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন না। চাঁদা এবং পার্টির টাকায় তাদের নির্বাচনী ব্যয় মিটাতে হয়েছে। আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের সবচেয়ে বড় নির্বাচনী ফান্ড দাতা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক এফেয়ার্স কমিটি ( এআইপিএসি)।যুক্তরাষ্ট্রে এআইপিএসির মতো আরো কিছু ইসরায়েলপন্থী লবি রয়েছে। মূলত তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। তারা সরাসরি কোনো দলকে অর্থ দেয় না। বরং পছন্দের প্রার্থীদের নির্বাচনে অর্থ ব্যয় করে। শুধুমাত্র ট্রাম্পের শাসনামলেই এআইপিএসি অনেকগুলো সফলতা অর্জন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা, ইরানের সাথে করা পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বের হয়ে আসা এবং ফিলিস্তিনকে দেওয়া সাহায্য বন্ধ করা। কংগ্রেশনাল ক্লাব নামে এআইপিএসির বিশেষ একটি দল আছে। এই দলের প্রত্যেক সদস্য প্রতি নির্বাচনে সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার ডলার চাঁদা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর এই অর্থ ইসরায়েলপন্থী রাজনীতিবিদদের নির্বাচনে ব্যয় করা হয়। পরবর্তীতের এদের মধ্যে যারা জয়লাভ করে, তাদের মাধ্যমে সিনেট এবং হাউজে প্রভাব বিস্তার করে নিজেদের নীতির বাস্তবায়ন করে।ইসরায়েল সৃষ্টির পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ১১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আর্থিক সাহায্য দিয়েছে। পাশাপাশি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ওঠা যেকোনো নিন্দা অথবা শাস্তির প্রস্তাব আটকে দিতেও বরাবরই তৎপর যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্র যতবার ভেটো দিয়েছে, তার অর্ধেকই ইসরায়েলের জন্য।এটা হলো ইহুদি লবির প্রতি আমেরিকান প্রশাসনের কৃতজ্ঞতা।

আমেরিকার এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংকসহ গুরুত্বপূর্ণ সব ব্যাংক ইহুদিদের দখলে। ফলে আমেরিকার কেউ চাইলেও এদের কিছু করতে পারবেন না। বরং জুইশ কমিউনিটি বা ইহুদিদের হাতে না রাখলে ক্ষমতায় টেকা মুশকিল। এসব কারণে শুধু জুইশ কমিউনিটির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে ক্ষমতাসীন মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রশাসনের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে সার্বক্ষণিক ভাবে কাজ করে যেতে হয়।

আমেরিকার রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করে মূলত করপোরেট হাউসগুলো।এসব করপোরেট হাউসের দিকে তাকালে দেখা যায়, এগুলোর মালিক কিংবা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কম্পানিগুলোর মূল দায়িত্বে থাকা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার, সিইও হলেন ইহুদি কমিউনিটির মানুষ।জো বাইডেনের নেতৃত্বে নতুন প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর হোয়াইট হাউসের স্টাফ হিসেবে যাদেরকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে ২০ জনই ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক। এ নিয়ে ইসরাইলের একটি থিংকট্যাংক দাবি করছে যে, মার্কিন প্রশাসনে ভারতীয় নাগরিকদের আধিপত্য বিস্তারের নেপথ্যে ইহুদিদের ভূমিকা রয়েছে। মার্কিন প্রশাসনের এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদে হঠাৎ করে ভারতীয় বংশোদ্ভুত নাগরিকদের এভাবে উঠে আসার নেপথ্যে ইসরাইলের সাথে ভারতের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্কই মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে বলে জিউয়িশ পিপল পলিসি ইন্সটিটিউট বা জেপিপিআই জানিয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানটি ইসরাইলের একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র পেশাদার নীতি নির্ধারনী থিংক ট্যাংক হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে।বিগত দুই যুগে মার্কিন ইহুদি গ্রুপগুলো ইহুদি জনগোষ্ঠী এবং ভারতীয় বংশোদ্ভুত নেতৃবৃন্দের মাঝে শক্তিশালী রাজনৈতিক সম্পর্ক তৈরিতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

আমেরিকা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যেতে পারে না। কেননা

আশির দশক থেকে আমেরিকার রাজনীতিতে ইসরায়েল বড় এক ইস্যু। কারণ অধিকাংশ আমেরিকান ইসরায়েলের প্রতি সহানুভূতিশীল। এ কারণে আমেরিকার রাজনীতিতে যারা ইসরায়েলকে সমর্থন করে, তাদেরকে ভালো চোখে দেখা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, মার্কিন নাগরিকদের প্রায় ৭০ ভাগই ইসরায়েলকে সমর্থন করেন এবং তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ করতে ইচ্ছুক। বিপরীতে মার্কিন মুলুকে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতি দিনকে দিন আরো কমছে।

জেরুজালেম রাজধানী

প্রাচীন শহর জেরুজালেম। এই শহরে মুসলিমইহুদি ও খ্রিষ্টানদের পবিত্র স্থান তাই এই শহরকে নিজেদের করতে চায় তারা। এ নিয়ে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে যুগের পর যুগ ধরে চলছে দ্বন্দ্ব-সংঘাত-সহিংসতা। ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ফিলিস্তিনের পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয় ইসরায়েল। এ শহরেই মুসলমানদের প্রথম কিবলা আল আকসা মসজিদ অবস্থিত। মক্কা ও মদিনার পর এটি মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্র স্থান। ১৯৮০ সালে পুরো জেরুজালেম দখল করে নেয় ইসরায়েল। শহরটিকে তারা ইহুদিবাদী রাষ্ট্রের শাশ্বত এবং অবিভক্ত রাজধানীদাবি করতে থাকে। ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম হলেও তাদের দাবীকৃত জেরুজালেমকে রাজধানী হিসেবে কোনো রাষ্ট্রই স্বীকৃতি দেয়নি।১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর যুক্তরাষ্ট্র প্রথম রাষ্ট্র যারা ২০১৭ সালেজেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতি দেয় ।সবাইকে অগ্রাহ্য করে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেনজেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সময় এসেছে। অনেক আগেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। তার বিতর্কিত এই মন্তব্যের পর তিনি তেল আবিব থেকে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের কাজ শুরু করতে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন। জেরুজালেম ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বীকৃতি দেওয়ার পর এ সিদ্ধান্ত তীব্র সমালোচনার জন্ম দেয়। জাতিসংঘ এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণে কোনো ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিতে না পারলেও সাধারণ পরিষদ এর বিরুদ্ধে ভোট দেয়। বিষয়টি ভালোভাবে নেননি ট্রাম্প। জেরুজালেম প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়া ১২৮টি দেশকে শত্রুরাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও হুমকি দেন। পশ্চিম তীর ও গাজায় ইসরায়েলি দখলদারত্বের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনে প্রথম ইন্তিফাদার (এর অর্থ গণ-অভ্যুত্থান) সূচনা হয়েছিল ১৯৮৭ সালে। ১৯৯৩ সালে ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের মধ্যে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে এর সমাপ্তি ঘটে। ওই শান্তি চুক্তি অনুযায়ীফিলিস্তিনও চায় পূর্ব জেরুজালেম তাদের রাজধানী হবে।

ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি

২৮ জানুয়ারি ২০২০ সালে ডিল অব দ্য সেঞ্চুরিবা শতাব্দীর সেরা চুক্তি নামের মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা প্রকাশ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এতে ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক জেরুজালেম শহরকে ইসরায়েলি ভূখণ্ড হিসেবে দেখানো হয়েছে। আবু দিস নামের একটি ছোট গ্রামকে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে প্রস্তাব করা হয়।ওই পরিকল্পনায় জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরের অংশবিশেষ ও গাজা উপত্যকা নিয়ে নামমাত্র একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়েছেযে রাষ্ট্রের নিজস্ব কোনও সেনাবাহিনী থাকবে না। তবে ট্রাম্পের কট্টর ইসরায়েল ঘেঁষা ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।

 

 

কিয়ামত হবে না –

কিয়ামত সংঘটিত হবার  পূর্বে হযরত ঈসা (.) এর সঙ্গে দাজ্জালের জেরুজালেমে যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধে ইহুদিরা দাজ্জালের পক্ষাবলম্বন করবে। হযরত ঈসা (.) দাজ্জালকে হত্যা করবেন।এদিকে  ইহুদিরা প্রাণ ভয়ে পালাতে চেষ্টা করবে।  আশেপাশের গাছ ও পাথর/ দেয়ালে আশ্রয় নেবে। সেদিন গারকাদ নামক একটি গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে। গারকাদ ইহুদীবান্ধব গাছ।গারকাদ একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হল কাটাওয়ালা ঝোঁপ।গারকাদ এর ইংরেজী প্রতিশব্দ BoxthornBoxএর অর্থ সবুজ ঝোঁপ এবং thorn এর অর্থ কাঁটা। এ ধরনের গাছ বক্সথর্ন হিসেবেই পরিচিত। এই গাছ চেরি গাছের মতো এবং চেরি ফলের মতো লাল ফলে গাছটি শোভিত থাকে। ইসরায়েলের সর্বত্র বিশেষত অধিকৃত গাজা ভূখন্ডে গারকাদ গাছ ব্যাপকহারে  দেখতে পাওয়া যায়।ইহুদিরা কোথাও পালাবার স্থান পাবে না। গাছের আড়ালে পালানোর চেষ্টা করলে গাছ বলবে, হে মুসলিম! আসো, আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। আসো এবং তাকে হত্যা কর। পাথর বা দেয়ালের পিছনে পলায়ন করলে পাথর বা দেয়াল বলবে, হে মুসলিম! আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে, আসো! তাকে হত্যা কর। তবে গারকাদ নামক গাছ ইহুদিদেরকে গোপন করার চেষ্টা করবে। কেননা সেটি ইহুদিদের বৃক্ষ বলে পরিচিত।

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত ইহুদিদের সাথে মুসলিমদের যুদ্ধ না হবে। মুসলিমরা তাদেরকে হত্যা করবে, ফলে তারা গাছ ও পাথরের পিছনে লুকিয়ে থাকবে। তখন গাছ বা, পাথর বলবে হে মুসলিম! হে আল্লাহর বান্দাহ!! এইতো আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে, আসো!! তাকে হত্যা কর। কিন্তু গারকাদ (এক ধরনের ঝাউ গাছ) নামক বৃক্ষ দেখিয়ে দিবে না। কারন এটা হচ্ছে ইহুদীদের সহায়তাকারী গাছ।" (সহিহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন নং-৭০৭৫, ইসলামিক সেন্টার নং-৭১২৯)তবে এই হাদিসে ইহুদি বলতে অপশক্তিকে বোঝানো হয়েছে বলে মনে করেন একদল ইসলামি চিন্তাবিদ। কিন্তু ইহুদি সম্প্রদায় ধর্মীয় উগ্রতা ছড়াতে এই গাছের প্রসঙ্গ টেনে আনে। ইহুদিদের বিরুদ্ধে মহান আল্লাহ জড় পদার্থগুলোকেও সেদিন বাকশক্তি দান করবেন। তারাও ইহুদিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে।

ইসরাইল যখন গোলান মালভূমি দখল করে, তখন থেকেই তারা ওখানে গারকাদবৃক্ষ লাগাতে শুরু করেছে। এছাড়াও তারা স্থানে স্থানে এই গাছটি রোপণ করছে। সম্ভবত এই গাছের সঙ্গে তাদের বিশেষ কোন সম্পর্ক আছে।ইসরাইলীরা মুসলিমদের সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে গণ্য করে। পৃথিবী থেকে মুসলিমদের নাম-নিশানা মুছে ফেলার জন্য তারা মরিয়া।"মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে জঘন্য দুশমন হল ইহুদী ও মুশরিকরা (মূর্তি পূজারী)"(সূরা মায়েদা, আয়াত - ৮২)এই ইহুদিরা আবার রাসুল (সা.)'র হাদিসকে বিশ্বাস করে। এ বিশ্বাসের কারণেই সমগ্র ইসরাইলে তারা ব্যাপকভাবে গারকাদ গাছ লাগানোর কাজ শুরু করেছে। গড়ে তুলছে গারকাদ বন। অর্থাৎ তারা বিশ্বাস করে মুসলমানদের সাথে যুদ্ধে গারকাদ বৃক্ষ তাদের সাহায্য করবে।ইসরাইলের সীমান্তজুড়ে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এই গারকাদ বৃক্ষ রোপন করা হচ্ছে।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহর ঘোষণা অনুযায়ী তাদের ধ্বংস অনিবার্য। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণীমূলক হাদিসের আলোকে বলা যায়, বর্বর নৃশংস অত্যাচারী ইহুদিরা অবশ্যই ধ্বংস হবে। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত হবে না যতক্ষণ না মুসলিমদের সঙ্গে ইহুদিদের যুদ্ধ হবে। মুসলিমরা ইহুদিদের হত্যা করতে থাকবে। তখন তারা (ইহুদিরা) পাথর ও গাছের পেছনে লুকিয়ে আশ্রয় নেবে। তখন পাথর ও গাছ বলবে, হে মুসলিম, হে আল্লাহর বান্দা, এই তো ইহুদি আমার পেছনে লুকিয়ে আছে। এসো, তাকে হত্যা করো। (সহীহ মুসলিম)

 

 ইসরাইলের ষষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী মেনাখেম বেগিন একবার এক বক্তব্যে বলেছিল, ‘শোন হে ইহুদিরা! শত্রুদের (মুসলমানদের) নিঃশেষ না করা পর্যন্ত তোমাদের প্রশান্তি অনুভব করা উচিত নয়। যতদিন না আমরা ইসলামি সভ্যতাকে ধ্বংস করে তার বিপরীতে কোনো নবসভ্যতা দাঁড় করাতে পারছি, ততদিন তোমাদের সামান্য সহানুভূতি কিংবা নমনীয়তা প্রকাশের সুযোগ নেই।প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিওন বলেছে, ‘আমরা দেশের গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র কিংবা অন্য যে কোনো আন্দোলনের তোয়াক্কা করি না। আমাদের আশঙ্কাস্থল একমাত্র ইসলাম। 

 

 

পৃথিবীতে ইহুদিদের মোট সংখ্যা দেড় কোটির মতো।

       পৃথিবীতে একটিমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র আছে। তার নাম ইসরায়েল।

       ইসরায়েলে ইহুদির সংখ্যা ৫৪ লাখ, অবশিষ্ট প্রায় এক কোটি ইহুদি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে।

বিজ্ঞাপন

এর মধ্যে আমেরিকায় ৭০ লাখ, কানাডায় চার লাখ আর ব্রিটেনে তিন লাখ ইহুদি থাকে।

       ইহুদিরা মার্কিন জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ, আর পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.২ শতাংশ। অর্থাৎ পৃথিবীর প্রতি ৫০০ জনে একজন ইহুদি! কিন্তু জনসংখ্যার দিক দিয়ে ঢাকা শহরের কাছাকাছি হলেও বিশ্বে ইহুদি জাতি থেকে যুগে যুগে বেরিয়ে এসেছে অসংখ্য প্রতিভাবান ব্যক্তি। প্রধান ধর্মগুলোর পর পৃথিবীতে যে মতবাদ সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে, সেই কমিউনিজমের স্বপ্নদ্রষ্টা কার্ল মার্ক্স ইহুদি জাতি থেকে এসেছেন।

       বিশ্বের মানুষকে মুগ্ধ করে রাখা জাদুশিল্পী হুডিনি ও বর্তমানে ডেভিড কপারফিল্ড এসেছেন একই কমিউনিটি থেকে।

       এসেছেন আলবার্ট আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানী, যাঁকে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী বলা হয়।

       হতে পারে ইহুদিরা আমেরিকার মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশ, কিন্তু আমেরিকান রাজনীতিতে তাদের প্রভাব একচেটিয়া। আমেরিকার ১০০ জন সিনেটরের ১৩ জন ইহুদি। এর চেয়ে ভয়ংকর তথ্য হলো, ইহুদিদের সমর্থন ছাড়া কোনো আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেন না, কোনো প্রেসিডেন্ট প্রেসিডেন্ট থাকতে পারেন না।

       আমেরিকার এক্সপোর্ট ইমপোর্ট ব্যাংকসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংকগুলো ইহুদিদের দখলে। ফলে আমেরিকার কেউ চাইলেও এদের কিছু করতে পারবে না। বরং জুইশ কমিউনিটি বা ইহুদি জাতিকে হাতে না-রাখলে ক্ষমতায় টেকা যাবে না। এসব কারণে শুধু জুইশ কমিউনিটির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে ক্ষমতাসীন মার্কিন প্রেসিডেন্টে প্রশাসনের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করে যেতে হয়।

       আমেরিকার রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করে মূলত করপোরেট হাউসগুলো। তারা প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত বানাতে পারে ও প্রেসিডেন্টকে সরাতে পারে। এসব করপোরেট হাউসের দিকে তাকালে দেখা যায়, এগুলোর মালিক কিংবা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কম্পানিগুলোর মূল দায়িত্বে থাকা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার, সিইও হলেন ইহুদি কমিউনিটির মানুষ।

       মিডিয়া জগতে যদি আপনি তাকান, তাহলে দেখবেন : CNN, AOL, HBO, Cartoon Network, New line cinema, Warner Bross, Sports illustrated, People - ইহুদি মালিক নিয়ন্ত্রিত।

       ABC, Disney Channel, ESPN, Touchstone pictures - Michael Eisner  ইহুদি মালিক নিয়ন্ত্রিত।

       Fox Network, National Geographic, 20th century Fox Rupert Murdoch ইহুদি মালিক নিয়ন্ত্রিত।

       চারটি বিখ্যাত পত্রিকা ও এর সম্পাদকদের নাম দেখুন

 

New York Times-Arthur Sulzberger. New York Post-Rupert Murdoch. Washington Post-K. M. Graham. Wall street journal-Robert Thomsonসব কয়টি খবরের কাগজ ইহুদি মালিক নিয়ন্ত্রিত।

       ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা Mark Zuckerberg  একজন ইহুদি।

       ইরাকের বিরুদ্ধে আমেরিকার আগ্রাসনকে সাধারণ আমেরিকানদের কাছে বৈধ হিসেবে চিত্রায়িত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ফক্স নিউজ। বিশ্ববিখ্যাত মিডিয়া মোগল রুপার্ট মারডকের নিয়ন্ত্রণাধীন এ রকম প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই জুইশদের সমর্থন দিয়ে এসেছে। রুপার্ট মারডকের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সারা বিশ্বের ১৮৫টি পত্রপত্রিকা ও অসংখ্য টিভি চ্যানেল। বলা হয়, পৃথিবীর মোট তথ্যপ্রবাহের ৬০ ভাগ কোনো না কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করে রুপার্ট মারডকের The News Corporation. (সূত্র : ইন্টারনেট)

 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল