সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বিন লাদেন হত্যার দশ বছর এবং পরবর্তী প্রভাব



বিন লাদেন সৌদী আরবে জন্মগ্রহণকারী যাকে আল কায়েদা সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সাধারণত তিনি ওসামা বিন লাদেন নামে পরিচিত। বিন লাদেন ১১ সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে আমেরিকা টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার জন্য বহুলভাবে পরিচিত। ওসামা বিন লাদেন দুইটি ফতোয়া জারি করেন; একটি ১৯৯৬ সালে, অন্যটি ১৯৯৯ সালে । তার ফতোয়াটি ছিল, ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের উচিত মার্কিন সামরিক ও বেসামরিক জনগণকে হত্যা করা যতক্ষণ না যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের প্রতি সব সহায়তা বন্ধ করে এবং সব মুসলিম দেশ থেকে সামরিক শক্তি অপসারণ করে।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর পর লাদেন মার্কিন প্রশাসনের চোখে বিশ্বের শীর্ষ সন্ত্রাসী হয়ে ওঠেন। বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র ও টুইন টাওয়ারে চালানো ওই হামলায় তিন হাজারের বেশি মানুষ নিহত হওয়ার দায় চাপে বিন লাদেনের ওপর।
হামলার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। হামলার পর প্রথম দিনেই নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে বড় ধস নামে। এক মাসেই চাকরি হারান ১ লাখ ৪৩ হাজার মানুষ। ধারণা করা হয়, ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলায় আনুমানিক ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের ক্ষতি হয়েছিল।ওই হামলার পর থেকে কমপক্ষে ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫০০ মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশ বেসামরিক নাগরিক। রোড আইল্যান্ডের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ওয়াটসন ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ‘কস্ট অব ওয়ার’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা যায়।এর পরই যুক্তরাষ্ট্র শুরু করে লাদেনবিরোধী অভিযান। আফগানিস্তানের দুর্গম অঞ্চলে ঘাপটি মেরে থাকা বিন লাদেন আর তাঁর সংগঠন আল–কায়েদাকে নির্মূল করতে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযান শুরু হয় ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পর থেকেই। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রায় পুরো পশ্চিমা বিশ্ব এক হয়ে এ নির্মূল অভিযানে নামে। পুরো বিশ্বের রাজনীতি পাল্টে যায়। ইরাক-আফগানিস্তানে অভিযান চালানো হয়। লাখো মানুষের রক্তের বন্যা বয়ে যায় এসব অভিযানে। আফগানিস্তানে যুদ্ধ চালাতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে অনেক মাশুল দিয়েছে।এখন পর্যন্ত ২৩০০ মার্কিন সেনা আফগানিস্তানে মারা গেছে। জখম হয়েছে ২০,০০০। সেই সাথে ৪৫০ জন ব্রিটিশ সৈন্য মারা গেছে। আরো কয়েকটি দেশের কয়েকশ সৈন্য প্রাণ হারিয়েছে দুই দশকের এই যুদ্ধে।তবে এই যুদ্ধে বহুগুণ বেশি হতাহত হয়েছে আফগানরা। আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর ৬০ হাজারেরও বেশি সদস্য মারা গেছে। সাধারণ বেসামরিক আফগানের মৃত্যুর সংখ্যা তার দ্বিগুণ।২০ বছরে প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৪০ জন বেসামরিক মানুষ মারা গেছে সেখানে। আর অর্থ-কড়ি ব্যয় হয়েছে পাহাড় সমান। এখন পর্যন্ত আফগান যুদ্ধের জন্য মার্কিন করদাতাদের প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার যোগাতে হয়েছে।প্রায় দুই দশক ধরে চলা এই যুদ্ধে আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের পতন হয়েছে ঠিকই; কিন্তু দেশটিতে তারা এখনো বহাল তবিয়তেই আছে। তালেবানের দাবি, তারা এখন আফগানিস্তানের ৭০ শতাংশের বেশি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। তবে আফগানিস্তানের একটি সংবাদ সংস্থার সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যায়, তালেবান অন্তত ৫২ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে।ওয়াশিংটন পোস্টসহ অন্যান্য মার্কিন সংবাদমাধ্যম এক প্রতিবেদনে জানায়, নাইন–ইলেভেনের ঘটনার ২০ বছর পূর্তির আগে, অর্থাৎ আগামী ১১ সেপ্টেম্বরের আগেই আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হবে।হেলমান্দ প্রদেশের মুসা কালা শহরের এক বাসিন্দা সিএনএনকে জানিয়েছেন, ‘দিন শেষে তালেবানদের হাতেই ক্ষমতা। তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়ার কোনো সুযোগই নেই।
২০১১ সালের ২ মে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের অদূরে অ্যাবোটাবাদে মার্কিন বাহিনী কমান্ডো অভিযান চালিয়ে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করে। লাদেন একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কাছের একটি বাড়িতে দীর্ঘ সময় ধরে আত্মগোপন করে ছিলেন।পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমির মাত্র ১০০০ ফুট দূরে লাদেনের এই গোপন আস্তানাটি ২০০৫ সালে নির্মাণ করা হয়। এখানে লাদেন তার কনিষ্ঠা স্ত্রী এবং পুত্র সহ বাস করতেন।পাকিস্তানকে না জানিয়েই দেশটির ভেতর ঢুকে যুক্তরাষ্ট্রের কমান্ডো বাহিনী অপারেশন জেরোনিমো নামে হত্যার অভিযান চালায়।লাদেনের মরদেহ মার্কিন কমান্ডোরা হেলিকপ্টারযোগে প্রথমে আফগানিস্থানে এবং পরে মার্কিন রণতরীতে নিয়ে যায়। লাদেনের দেহ ডিএনএ প্রযুক্তির সাহায্যে শনাক্ত করা হয়। শনাক্তকরণের শেষে ইসলামী প্রথানুসারে মরদেহ আরব সাগরে দাফন করা হয়।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, মার্কিন সেনারা বিন লাদেনের পরিবর্তে অন্য কাউকে হত্যা করেছে এবং লাদেনের এখনও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।২০১১ সালে সাবেক মার্কিন মেরিন সেনা রবার্ট ও’নেইল দাবি করেছিলেন, তিনি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নির্দেশে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করেছেন। তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় এক টুইটার পোস্টে বলেন, যাকে হত্যা করেছেন তিনি বিন লাদেনই ছিলেন, অন্য কেউ নন।
বিন লাদেনকে হত্যার পর উত্থান ঘটেছে জঙ্গি সংগঠন ইসলামি স্টেটের (আইএস)। বিন লাদেনের সংগঠন আল–কায়েদার জঙ্গি ভাবাদর্শে উদ্বুদ্ধ আবু বকর আল বাগদাদিকে খলিফা ঘোষণা করে আইএস আত্মপ্রকাশ করে। সিরিয়া ও ইরাকের অঞ্চল বিশেষ দখল করে নেয় জঙ্গি এ সংগঠনটি। যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকো থেকে ফ্রান্সের প্যারিস, বেলজিয়ামের ব্রাসেলস এবং আফ্রিকার মিসর ও নাইজেরিয়াতে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে সারা বিশ্বকে উৎকণ্ঠায় ফেলে দেয় এই আইএস। সারা বিশ্বে ‘জিহাদের’ নামে সন্ত্রাসী ভাবধারা ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল সংগঠনটি। বিন লাদেনের অনুসারীরা সিরিয়াতে সংগঠিত হয়ে জাবাত আল নুসরা নামের জিহাদি সংগঠন গড়ে তোলে।
২০২০ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সংসদে বলেন,‘‘আমরা যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার অন টেরর অবস্থানের পক্ষ নিলাম৷ কিন্তু তারা এখানে অভিযান করল এবং তাকে হত্যা করল, শহিদ করল এবং ... পুরো দুনিয়া আমাদের বিরুদ্ধে অবমাননাকর কথা বলল, আমাদের কিছু জানাল না (অভিযানের বিষয়ে), যেখানে আমরা এই ওয়ার অন টেররের কারণে ৭০,০০০ মানুষকে হারিয়েছি৷''ইমরান ওয়াশিংটনকে উদ্দেশ্য করে আরো বলেন, ‘‘ওয়ার অন টেররে আমরা অ্যামেরিকাকে সমর্থন দিয়েছি এবং এর বদলে শুধু অপমানই সয়েছি৷ আফগানিস্তানে সব ব্যর্থতার জন্য তারা আমাদের ওপরই দোষ চাপিয়েছে৷ তারা আফগানিস্তানে সফল হতে পারেনি, সে কারণে আমাদের ওপর খোলাখুলিভাবে দোষ চাপিয়েছে৷''

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

মো.আবু রায়হান:  কিয়ামত সংঘটিত হবার  পূর্বে হযরত ঈসা (আ.) এর সঙ্গে দাজ্জালের জেরুজালেমে যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধে ইহুদিরা দাজ্জালের পক্ষাবলম্বন করবে। হযরত ঈসা (আ.) দাজ্জালকে হত্যা করবেন।এদিকে  ইহুদিরা প্রাণ ভয়ে পালাতে চেষ্টা করবে।  আশেপাশের গাছ ও পাথর/ দেয়ালে আশ্রয় নেবে। সেদিন গারকাদ নামক একটি গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে। গারকাদ ইহুদীবান্ধব গাছ।গারকাদ একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হল কাটাওয়ালা ঝোঁপ।গারকাদ এর ইংরেজী প্রতিশব্দ Boxthorn। Boxএর অর্থ সবুজ ঝোঁপ এবং thorn এর অর্থ কাঁটা। এ ধরনের গাছ বক্সথর্ন হিসেবেই পরিচিত। এই গাছ চেরি গাছের মতো এবং চেরি ফলের মতো লাল ফলে গাছটি শোভিত থাকে।  ইসরায়েলের সর্বত্র বিশেষত অধিকৃত গাজা ভূখন্ডে গারকাদ গাছ ব্যাপকহারে  দেখতে পাওয়া যায়।ইহুদিরা কোথাও পালাবার স্থান পাবে না। গাছের আড়ালে পালানোর চেষ্টা করলে গাছ বলবে, হে মুসলিম! আসো, আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে। আসো এবং তাকে হত্যা কর। পাথর বা দেয়ালের পিছনে পলায়ন করলে পাথর বা দেয়াল বলবে, হে মুসলিম! আমার পিছনে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে, আসো! তাকে হত্যা কর। তবে গারকাদ নামক গাছ ইহুদিদেরকে ...

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল

#মো. আবু রায়হান ইসলামের যুদ্ধগুলোর মধ্যে খন্দকের যুদ্ধ অন্যতম। ৫ হিজরির শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবীজি (সা.) মদিনায় আসার আগে সেখানে বড় দুটি ইহুদি সম্প্রদায় বসবাস করত। বনু নাজির ও বনু কোরায়জা। ইহুদিদের প্ররোচনায় কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র মদিনার মুসলমানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদিনার ওপরে গোটা আরব সম্প্রদায়ের এক সর্বব্যাপী হামলা এবং কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা। এসময় ২৭দিন ধরে আরব ও ইহুদি গোত্রগুলি মদিনা অবরোধ করে রাখে। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসির পরামর্শে হযরত মুহাম্মদ (স:) মদিনার চারপাশে পরিখা খননের নির্দেশ দেন। প্রাকৃতিকভাবে মদিনাতে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল তার সাথে এই ব্যবস্থা যুক্ত হয়ে আক্রমণ কারীদেরকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। জোটবাহিনী মুসলিমদের মিত্র মদিনার ইহুদি বনু কোরায়জা গোত্রকে নিজেদের পক্ষে আনে যাতে তারা দক্ষিণ দিক থেকে শহর আক্রমণ করে। কিন্তু মুসলিমদের তৎপরতার ফলে তাদের জোট ভেঙে যায়। মুসলিমদের সুসংগঠিত অবস্থা, জোটবাহিনীর আত্মবিশ্বাস হ্রাস ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে শেষপর্যন্ত আক্রমণ ব্যর্থ হয়।এই যুদ্ধে জয়ের ফলে ইসল...

উটের যুদ্ধ ইসলামের প্রথম ভাতৃঘাতি যুদ্ধ

#মো.আবু রায়হান উটের যুদ্ধ বা উষ্ট্রের যুদ্ধ বা জামালের যুদ্ধ ( Battle of the Camel) ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ইরাকের বসরায় সংঘটিত হয়। এটি ইসলামের ইতিহাসের প্রথম গৃহযুদ্ধ।এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী এর বিরুদ্ধে হযরত তালহা-জুবায়ের ও আয়েশা (রা)সম্মলিত যুদ্ধ। পটভূমি হযরত ওসমান (রা) এর বিভিন্ন প্রদেশে প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিয়োগ নিয়ে একদল তার বিরুদ্ধে অভিযোগ টেনে বিদ্রোহ শুরু করে।হযরত ওসমান বিভিন্নভাবে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন। তাদের কথামত মিশরের গভর্নরকে প্রতিস্থাপন করে আবু বকরের ছেলে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর কে নিয়োগ করলেও বিদ্রোহীরা শান্ত হয় নি। তারা নানাভাবে অভিযোগ টেনে এনে ওসমান (রা) এর অপসারণের দাবী করতে থাকে। ওসমান সবকিছু মীমাংসার আশ্বাস দিলেও তারা ৬৫৬ সালের ১৭ জুন তারা বাড়ি অবরুদ্ধ করে এবং এক পর্যায়ে তারা তার কক্ষে প্রবেশ করে কুরআন তেলাওয়াত করা অবস্থায় হত্যা করে।ওসমান (রা.)-এর হত্যাকাণ্ডের পর আলী (রা.) খলিফা হন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে যখনই আলী (রা.) ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন তখনই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবের কার...