তুর্কি-সাইপ্রাস বিবাদে গ্রিস
মো.আবু রায়হানঃতুরস্ক এবং গ্রিস দুটি দেশই ন্যাটোর সদস্য। কিন্তু পূ্র্ব ভূমধ্যসাগর এলাকা থেকে জ্বালানি আহরণের প্রতিযোগিতায় তারা হয়ে উঠেছে পরস্পরের প্রতিপক্ষ।ইস্তাম্বুলের আয়া সোফিয়া জাদুঘর -যা কয়েক শতাব্দী ধরে অর্থডক্স খ্রিষ্টানদের গির্জা ছিল - তাকে মসজিদে পরিণত করার কথা ঘোষণা করে তুরস্ক। এ ঘটনাটিও গ্রিসকে মর্মাহত করে।সম্প্রতি সাইপ্রাস দ্বীপের উপকুলে সাগরে বিশাল গ্যাসের মজুত আবিষ্কৃত হয়। এর পরই সিপ্রিয়ট সরকার, গ্রিস, ইসরায়েল এবং মিশর এই সম্পদ ব্যবহারের জন্য একসাথে কাজ করতে উদ্যোগী হয় । ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে তুরস্ক লিবিয়ার সাথে এক চুক্তি স্বাক্ষর করে। আংকারার বক্তব্য, এর মাধ্যমে তারা তুরস্কের দক্ষিণ উপকুল থেকে লিবিয়ার উত্তর-পূর্ব তীর পর্যন্ত একটি বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা সৃষ্টি করেছে। এবছর ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের ইতিহাসের বৃহত্তম গ্যাসের মজুতের সন্ধান পায় আঙ্কারা।পরে আরও অনুসন্ধান কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন এরদোয়ান।তুরস্ক ভূমধ্যসাগরের যে এলাকায় প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য অনুসন্ধান চালাচ্ছে, ধারণা করা হচ্ছে সেখানে গ্যাসের বিশাল মজুত রয়েছে।তবে তুরস্কের এই অনুসন্ধান কার্যক্রমের তীব্র সমালোচনা করেছে দুই প্রতিবেশী দেশ গ্রিস ও সাইপ্রাস। সাগরের ওই অংশে তুর্কি সার্বভৌমত্ব মানতে রাজি নয় দেশ দুটি। এ নিয়ে প্রথমে আলোচনার কথা বললেও পরে বৈঠকে বসতে অস্বীকৃতি জানায় গ্রিস। অন্যদিকে আলোচনার তাগিদ দিয়ে এরদোয়ান বলেছেন, ‘গ্রিস হয় রাজনীতি ও কূটনীতির ভাষা বুঝবে, না হয় তাদের বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার মুখে পড়তে হবে। তুরস্কের জনগণ যেকোনও পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত রয়েছে। সাইপ্রাসের সঙ্গে তুরস্কের কয়েক দশকের দীর্ঘ বিরোধে এবার গ্রিসও যুক্ত হয়েছে। বরাবরই এ বিবাদে সাইপ্রাসের পক্ষ নিয়েছে গ্রিস। তবে ভূমধ্যসাগরে তুর্কি অনুসন্ধান কার্যক্রম নিয়ে এবার আঙ্কারার সঙ্গে সরাসরি বিবাদে জড়িয়েছে এথেন্স।তুর্কি-সাইপ্রাস বিবাদে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়া। মঙ্গলবার রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ এ প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তুরস্ক ও সাইপ্রাসের মধ্যকার যেকোনও আলোচনায় মধ্যস্থতা করতে মস্কো প্রস্তুত রয়েছে।
ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপগুলোর মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম দ্বীপ সাইপ্রাস বর্তমানে একটি বিভক্ত রাষ্ট্র।এর পশ্চিমে গ্রিস, পূর্বে লেবানন, সিরিয়া এবং ইসরাইল, উত্তরে তুরস্ক ও দক্ষিণে মিসর। দেশটি তুরস্ক উপকূল থেকে ৪০ মাইল দক্ষিণে এবং সিরিয়া থেকে ৬০ মাইল উত্তরে অবস্থিত।সাইপ্রাস ইউরোপ মহাদেশের অন্তর্গত।৩৯৫ সালে এ দ্বীপটি বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায়। আরবরা এটি দখল করে ৬৪৩ সালে। ১১৯১ সালে তৃতীয় ক্রুসেডের সময় এটি দখল করে ইংল্যান্ডের রাজা রিচার্ড। ১৫৩৯ সালে অটোমানরা এটি দখলে নেয়। অখণ্ড (তুর্কি ও গ্রিক) সাইপ্রাসপ্রায় তিনশ বছর শাসন করেন তুর্কি সুলতানরা। ১৮৭৮ সাল পর্যন্ত সাইপ্রাসে তুর্কি শাসন অব্যাহত ছিল। রুশ-তুর্কি যুদ্ধের পর দ্বীপটি ব্রিটেনের দখলে চলে যায়।১৮৭৮ সালে দ্বীপটি ব্রিটেনের একটি সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত হয়। ১৯২৫ সালে দ্বীপটিকে ব্রিটিশরা নিজেদের একটি কলোনি বলে দাবি করে। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের পতন হলে দ্বীপটি সম্পূর্ণরূপে ব্রিটিশদের অধীনে চলে যায়। এরপর থেকেই শুরু হয় গ্রিক ও তুর্কি সাইপ্রিয়টদের বিভাজন। গ্রিক অর্থোডক্স চার্চ 'ইনোসিস (Enosis)' নামের একটি ধারণা সাইপ্রাসে গ্রিক সাইপ্রিয়টদের মাঝে ছড়িয়ে দেয় যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে সাইপ্রাসকে গ্রিসের সাথে সংযুক্তিকরণ। ১৯৫০ এর দশকে সাইপ্রাস অর্থোডক্স চার্চ এবং গ্রিকপন্থী সাইপ্রিয়টদের 'EOKA' নামক একটি চরমপন্থি সংগঠন ইনোসিস বাস্তবায়নে সহিংস কার্যক্রম শুরু করে। ফলশ্রুতিতে বহু ব্রিটিশ ও তুর্কি সাইপ্রিয়ট সহিংসতার শিকার হয়। অবশেষে, জুরিখ চুক্তির মাধ্যমে ১৯৬০ সালে ব্রিটিশদের থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন রিপাবলিক অব সাইপ্রাস গঠিত হয়।নব-রচিত সংবিধানে তুর্কি সাইপ্রিয়টদের অধিকার সংরক্ষিত করা হয়েছিল এবং গ্রিস ও তুরস্ককে এই দ্বীপের তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তব অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছিল। গ্রিকপন্থী সাইপ্রিয়টরা সংখ্যালঘু তুর্কি সাইপ্রিয়টদের হত্যা এবং বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে থাকে এবং ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত গ্রিস ২০,০০০ সেনা প্রেরণ করে। অবশেষে জাতিসংঘ ১৯৬৪ সালে শান্তিরক্ষা বাহিনী প্রেরণ করে যা আজ পর্যন্ত বলবত রয়েছে।কিন্তু গ্রিকপন্থী সাইপ্রিয়টরা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করলে সাইপ্রাস গ্রিসের অধীনে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। ফলে তুরস্ক সাইপ্রাসে সামরিক অভিযান চালায় এবং দ্বীপটির উত্তর অংশ দখলে নেয়। ১৯৮৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এই উত্তর অংশটি 'Turkish Republic of Northern Cyprus' নামে আত্মপ্রকাশ করে এবং আজ অবধি শুধুমাত্র তুরস্ক তাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। অন্যদিকে গ্রিক অধ্যুষিত রিপাবলিক অব সাইপ্রাস নামে পরিচিত দ্বীপের দক্ষিণ অংশ জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ভুক্ত একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি-প্রাপ্ত রাষ্ট্র। ২০০৪ সালে দুই অংশকে একত্রীকরণের লক্ষ্যে জাতিসংঘের অধীনে একটি গণভোট আয়োজিত হয়েছিল। উত্তর সাইপ্রাসের ৬৫% জনগণ 'হ্যাঁ' ভোট দিলেও দক্ষিণের ৭৬% জনগণ 'না' ভোট দেয়। ফলে একত্রীকরণ সম্ভব হয়নি।গ্রিস এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন সাইপ্রাসকে সমর্থন দিচ্ছে। উত্তর সাইপ্রাসে এখনও তুরস্কের ৪০,০০০ সেনা মোতায়েন রয়েছে সম্ভাব্য গ্রিক হস্তক্ষেপ রোধ করার জন্য। মূলত, পূর্ব ভূমধ্যসাগরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় তুরস্ক ও গ্রিস যথাক্রমে নর্দার্ন সাইপ্রাস ও সাইপ্রাসকে প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করছে।
সাইপ্রাসের মূল আয়তনের ৪০ শতাংশ তুর্কিরা আর ৬০ শতাংশ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত ইউরো সাইপ্রাস (Republic of Cyprus) এর দখলে। উত্তর সাইপ্রাসের আয়তন ৩,৩৫৫ বর্গকিলোমিটার যা সাইপ্রাস দ্বীপের প্রায় এক তৃতীয়াংশের সমান। উত্তর সাইপ্রাসের উত্তর সীমান্তের ৭৫ কিলোমিটার তুরস্কের সাথে পূর্ব সীমান্তের ৯৭ কিলোমিটার এবং সিরিয়ার সাথে অবস্থিত।দেশটির সরকারি নাম তুর্কি প্রজাতন্ত্র উত্তর সাইপ্রাস Turkish Republic of Northern Cyprus-TRNC)। শুধু তুরস্ক উত্তর সাইপ্রাসকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বাকি দেশগুলো একে সাইপ্রাস প্রজাতন্ত্রের অংশ বলে মনে করে।এই ঘটনাটি সাইপ্রাসের রাজনীতিতে এতই গভীর প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে যে দুই অংশের সম্পর্ক ভাল না, এমনকি সরাসরি টেলিযোগাযোগ পর্যন্ত নেই। তাই দুই অংশের বিভক্তি রেখায় আন্তর্জাতিক সৈন্য পাহারায় রয়েছে।তুর্কি সাইপ্রিয়টদের বেশিরভাগই মুসলিম। উত্তর সাইপ্রাস বা তুর্কি সাইপ্রাস মূলত তুরস্কের সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। শুধুমাত্র তুরস্ক কর্তৃক স্বীকৃত উত্তর সাইপ্রাসকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সাইপ্রাস প্রজাতন্ত্রের অংশ হিসাবে বিবেচনা করে।জাতিসংঘ একে সাইপ্রাসের তুরস্ক অধিকৃত অংশ হিসেবে দেখে। উত্তর সাইপ্রাসের স্বাধীনতা ঘোষণার পর প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান দেশটিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।কিন্তু জাতিসংঘ দেশটিকে স্বীকৃতি না দেওয়ায় আন্তর্জাতিক (বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের) চাপে দেশ দুটি তাদের স্বীকৃতি প্রত্যাহার করে নেয়।জাতিসংঘের ভাষ্য মতে উত্তর সাইপ্রাসের স্বাধীনতা ঘোষণা আইনত অবৈধ।২০০২ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান দ্বীপের একীভূতকরণের জন্য আলোচনার শুরু করেন। ২০০৪ সালে উভয় পক্ষের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার পরে দ্বীপের একীভূতকরণের জন্য একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। এ পরিকল্পনাটি জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে। কিন্তু, উভয় পক্ষের জাতীয়তাবাদীরা এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যানের জন্য প্রচারণা চালায়। এতে তুর্কি সাইপ্রিয়টরা এই পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও গ্রীক সাইপ্রিয়টদের অধিকাংশই এটি প্রত্যাখ্যান করে।উত্তর সাইপ্রাসের প্রথম আদমশুমারী অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালে। তখন দেশটির জনসংখ্যা ছিল ২,০০,৫৮৭ জন। এরপর ২০০৬ সালের দ্বিতীয় আদমশুমারীতে দেশটির জনসংখ্যা ২,৬৫,১০০ উল্লেখ করা হয়।২০১১ সালে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকদের সহায়তায় উত্তর সাইপ্রাসের তৃতীয় আদমশুমারিটি করা হয়েছিল। এতে দেশটির মোট জনসংখ্যা ২,৯৪,৯০৬ উল্লেখ করা হয়। বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল, শ্রমিক ইউনিয়ন এবং স্থানীয় সংবাদপত্র এই ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে। তাদের দাবি, সরকার তুরস্ক থেকে আর্থিক সহায়তা লাভের জন্য জনসংখ্যা কম দেখিয়েছে।তুর্কি সাইপ্রিয়টদের ৯৯% সুন্নি মুসলমান। কিন্তু উত্তর সাইপ্রাস একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।
দক্ষিণ সাইপ্রাসকে মুল সাইপ্রাস বলে যার রাজধানী নিকোশিয়া। আয়তন ৯২৯৫ বর্গকিমি।জনসংখ্যা ১১ লাখ ৭০ হাজার ১৬৬ জন। পৃথিবীর শেষতম বিভক্ত রাজধানী এটি। অবশ্য 'Last divided capital in the world' বলে নিকোশিয়াকে সাইপ্রাস ব্রান্ডিং করছে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য। মূল সাইপ্রাসের অধিবাসিরা মূলত গ্রীক সাইপ্রিয়টদের ভাষাও গ্রীক।গ্রিক সাইপ্রিয়টদের বেশিরভাগই গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের সদস্য ।ইউরোবেরোমিটার ২০০৫ অনুসারে, সাইপ্রাস হচ্ছে ইউরোপের প্রধান পাঁচটি ধার্মিক দেশের একটি। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত যে পাঁচটি দেশে রাষ্ট্রধর্ম আছে সাইপ্রাস তাদেরও একটি। সাইপ্রাসের রাষ্ট্রধর্ম হচ্ছে সাইপ্রিয়ট অর্থোডক্স চার্চ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন