আয়া সোফিয়া জাদুঘর থেকে পুনরায় মসজিদ

মো. আবু রায়হানঃতুরস্কের ভেতরে এবং বাইরে বহু গোষ্ঠীর জন্য আয়া সোফিয়ার ১৫০০ বছরের ইতিহাস ব্যাপক ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব বহন করে।১৯৩৪ সালে করা এক আইনে এই ভবনটিতে ধর্মীয় প্রার্থনা করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।আয়া সোফিয়া মধ্যযুগের রোম সাম্রাজ্যের সাবেক রাজধানী কনস্টান্টিনোপলের(ইস্তাম্বুল) বর্তমান তুরস্কের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত।আয়া সোফিয়া পৃথিবীতে স্থাপত্যশিল্পের এক বিস্ময়। এখানে রোম ও তুর্কি স্থাপত্যশিল্পীরা নিজ নিজ সময়ে কীর্তির স্বাক্ষর রেখে পৃথিবীকে চমকিত করেছেন। আজও প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক স্থাপত্যশিল্পের এই বিস্ময় দেখতে আসেন।দেড় হাজার বছরের পুরনো আয়া সোফিয়া এক সময় ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় গির্জা, পরে তা পরিণত হয় মসজিদে,তারও পর একে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়। এই স্থাপনাটি ১৯৩৪ সালে আধুনিক তুরস্কের স্থপতি ও স্বাধীন তুরস্কের প্রথম রাষ্ট্রপতি মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক যাদুঘরে রূপান্তর করেছিলেন। জাদুঘর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা বেসরকারি সংস্থা সম্প্রতি দেশটির আদালতে এ বিষয়ে মামলা করলে রায় দেওয়ার আগে ২ জুলাই শুনানিতে আদালত পক্ষগুলোর যুক্তি শুনেন। পিটিশনে বলা হয়েছে, আয়া সোফিয়া ইস্তাম্বুল বিজেতা উসমানিয়া সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ- এর নিজস্ব সম্পত্তি যা ১৪৫৩ সালে ইস্তাম্বুল দখলের মাধ্যমে অর্জন করে এই ধর্মীয় স্থাপনাকে মসজিদে রূপান্তর করেন ।

ওসমানীয়দের দখলের পূর্বে আয়া সোফিয়া
মাত্র ১৭ মিনিটের শুনানীর পর তুরস্কের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক সংস্থা – দি কাউন্সিল অব স্টেট – বলেছে তারা ১৫ দিনের মধ্যে এ ব্যাপারে একটি রুলিং দেবেন।তুরস্কের শীর্ষ আদালত ১০ জুলাই শুক্রবার আয়া সোফিয়াকে ১৯৩৪ সালের তৎকালীন সরকারের যাদুঘরে পরিণত করার আদেশটি বাতিল করেছে। আদালত জানায়,১৯৩৪ সালে মন্ত্রিসভার যে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মসজিদ হিসেবে এর ব্যবহার বাদ দিয়ে যাদুঘরে রুপান্তরিত করেছিল তা আইন মেনে করা হয়নি। যার ফলে এখন বিখ্যাত এই স্থাপনাটি আবারো মসজিদে রূপান্তরিত করতে আর কোন বাধা রইল না।তুরস্কের প্রশাসনিক আদালত ১৯৩৪ সালের সিদ্ধান্তকে বাতিল করে দেয়ার কয়েক মিনিটের পরেই প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান ১০ জুলাই আয়া সোফিয়াকে মসজিদ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করার জন্য আদেশ জারি করেন। রজব তাইয়েব এরদোগান বলছেন, আদালতের রায়ের পর নামাজ পড়ার জন্য আয়া সোফিয়াকে খুলে দেয়া হবে।টুইটারে এক পোস্টে মি. এরদোগান জানান,আয়া সোফিয়ার সম্পত্তি 'দিয়ামাত' বা তুর্কী ধর্মীয় বিষয়ক দফতরের হাতে সোপর্দ করা হবে।এরপরই আয়া সোফিয়াতে প্রথমবারের মত আজান দেয়া হয়।সরকারের সমর্থক হাবার টিভিসহ অন্যান্য টেলিভিশন চ্যানেলে এই দৃশ্য সম্প্রচার করা হয়। রায় প্রকাশের পরই খুশিতে মেতে উঠে তুর্কিরা। তারা ইস্তাম্বুলের আয়া সোফিয়ার আশেপাশে আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মুখরিত করে তোলেন। জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া এক তাত্ক্ষণিক ভাষণে প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান তুরস্কের জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে আয়া সোফিয়াকে ইবাদতের জন্য উন্মুক্ত করেন। আনুষ্ঠানিক আজান ধ্বনিত হয় এবং আগামি ২৪ জুলাই শুক্রবার ৮৫ বছর বন্ধ থাকার পর প্রথম জুমার নামাজ পড়ার ঘোষণা দেয়া হয়। ৪৮১ বছর মুসলমানরা এখানে নামাজ পড়েছেন, আজান দিয়েছেন। কিন্তু ১৯৩৪ সালে কামাল আতাতুর্ক আয়া সোফিয়ায় আজান ও নামাজ নিষিদ্ধ করে এটাকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করেন। ১৯৯১ সালে আয়া সোফিয়ার পাশে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয় এবং মসজিদটির দরজা আয়া সোফিয়ার দিকে খুলে দেওয়া হয়। মানুষ ওখানে নামাজ পড়তে থাকে।
ওসমানীয়দের দখলের পর আয়া সোফিয়া
৩৩০ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট কনস্টান্টাইন বসফরাস প্রণালীর উপকূলে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। নাম দেন নোভারোমা বা নতুন রোম। তবে কালের পরিক্রমায় তা হয়ে দাঁড়ায় কনস্টান্টিনোপল। ৩৯৫ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট থিউডোসিয়াস তার দুই পুত্রের মধ্যে সাম্রাজ্য ভাগ করে দেন। ফলে পশ্চিম রোম এবং পূর্ব রোম সাম্রাজ্য নামে দুইটি সাম্রাজ্যের সৃষ্টি হয়। পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের নাম হয় বাইজান্টাইন। কনস্টান্টিনোপল হয় তার রাজধানী। গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের প্রধান কেন্দ্র হিসেবেও নগরীটি পরিচিতি লাভ করে।বসপরাস প্রণালীর পশ্চিম পাড়ে ইস্তাম্বুলের ফাতিহ এলাকায় গম্বুজশোভিত এই বিশাল ঐতিহাসিক আয়া সোফিয়া খুব সহজেই দর্শকদের নজর কাড়ে। খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকে খ্রিস্টান সম্রাট দ্বিতীয় কনস্টান্টিন প্রথম এই হাজিয়া সোফিয়া’ গির্জা নির্মাণ করেন।৩৬০ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি ‘হাজিয়া সোফিয়া’ গির্জা খ্রিস্টানদের উপাসনার জন্য খুলে দেয়া হয়। ৪০৪ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিনোপলে সৃষ্ট দাঙ্গায় এই গির্জার একাংশ ভস্মীভূত হয়। পরবর্তীতে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে সম্রাট প্রথম জাস্টিনিয়ানের আদেশে এটিকে পুনর্নির্মাণ করা হয়।এই সুবিশাল ক্যাথিড্রাল তৈরির সময় তখনকার প্রকৌশলীরা ভূমধ্যসাগরের ওপার থেকে নির্মাণসামগ্রী নিয়ে এসেছিলেন।হাজিয়া সোফিয়া নির্মাণ শেষ হয় ৫৩৭ সালে। এখানে ছিল অর্থডক্স চার্চের প্রধানের অবস্থান। বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজকীয় অনুষ্ঠান, রাজার অভিষেক ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হতো এখানেই।প্রায় ৯০০ বছর ধরে হাজিয়া সোফিয়া ছিল পূর্বাঞ্চলীয় অর্থডক্স খ্রিষ্টান ধর্মের কেন্দ্রবিন্দু। অবশ্য মাঝখানে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে একটি সংক্ষিপ্ত কালপর্ব ছাড়া, যখন চতুর্থ ক্রুসেডের সময় ইউরোপের ক্যাথলিকরা এক অভিযান চালিয়ে কনস্টান্টিনোপল দখল করে নেয়। তারা হাজিয়া সোফিয়াকে একটি ক্যাথলিক ক্যাথিড্রালে পরিণত করেছিল। এই স্থাপনাটি অর্থোডক্স গির্জা হিসেবে স্থাপনের পর থেকে ১২০৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়। ১২০৪ সালের পর এটি ক্যাথলিক গির্জায় রূপান্তরিত হয়। যা প্রায় ৫৭ বছর ক্যাথলিক গির্জা হিসেবে ব্যবহারের পর ১২৬১ সালে তা আবার অর্থোডক্স গির্জায় রূপান্তরিত হয়। আর তা ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৯২ বছর স্থায়ী হয়। প্রায় ১০০০ বছর ধরে এটিই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গির্জা। প্রায় ত্রিভুজাকৃতির কনস্টান্টিনোপল শহরের উত্তরে বসফরাস প্রণালীর অংশ গোল্ডেন হর্ন, পূর্বে বসফরাস প্রণালীর মূল অংশ আর দক্ষিণে মারমারা সাগরের অথৈ জল। এ ছাড়াও রয়েছে শহরকে ঘিরে রাখা অসংখ্য নগর-প্রতিরক্ষা দেয়াল। ফলে প্রাকৃতিকভাবেই সুরক্ষিত ছিল শহরটি।কনস্টান্টিনোপল বিজয় কেবল ওসমানি সালতানাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণই ছিল না, বরং এর বিজেতা সেনাপতি ও সেনাবাহিনীর জন্য বিশেষভাবে দোয়া করে গিয়েছেন মহানবি হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম। রাসূলুল্লাহ সা: এই শহর সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামের সামনে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন -“লাতাফতাহুন্নাল কুসতুনতিনিয়াতা, ফালা নে’মাল আমীরূ আমীরূহা ওয়ালানে’মা জাকাল জাইশু।” অর্থাৎ নিশ্চিতরূপে তোমরা কুসতুনতিনিয়া জয় করবে। সুতরাং তার শাসক কতই না উত্তম হবে এবং তার জয় লাভকারী সৈন্যরাও কতই না উত্তম হবে! (মুসনাদে আহমদ)। (“Verily you shall conquer Constantinople. What a wonderful leader will her leader be, and what a wonderful army will that army be!”) দ্বিতীয় মুহাম্মাদের আমলে কনস্টান্টিনোপলের সিংহাসনে ছিলেন কনস্ট্যান্টাইন ড্রাগাসেস। ১৪৫৩ সালে ৭ম ওসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদ খ্যাত শাসক সুলতান মোহাম্মাদ ফাতিহ এর দখলে চলে যায় কনস্টান্টিনোপল। এমনকি দ্বিতীয় মুহাম্মদের পূর্বে তারই জাতির নৃপতিরা ১৭ বা ১৮ বার চেষ্টা করেছেন, সফল হননি। দ্বিতীয় মুহাম্মদ পেরেছেন, তাই তিনি ফাতিহ বা নগরদোর উন্মোচনকারী।তিনি মুহাম্মাদ ফাতিহ অর্থাৎ বিজয়ী মুহাম্মাদ নামে পরিচিতি পেলেন।
আয়া সোফিয়া মসজিদের ভেতরের দিক
কনস্টান্টিনোপলের নতুন নাম হয় ইস্তাম্বুল। চিরকালের মত অবসান হয় বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের।ফলে কনস্টান্টিনোপলের হাজিয়া সোফিয়া গির্জাকে মসজিদে রূপান্তর করা হয়। হাজিয়া সোফিয়া গির্জাকে আয়া সোফিয়া মসজিদে রূপান্তর করেন।যার নতুন নামকরণ হয় ইম্পিরিয়াল মসজিদ যা প্রায় ৪৮১ বছর স্থায়ী হয়। তুরস্কের প্রধান মসজিদ সুলতান আহমেদ মসজিদ, যেটি ব্লু মসজিদ নামে পরিচিত।এটি স্থাপিত হয় ১৬১৬ সালে। কিন্তু এই মসজিদ স্থাপনের পূর্বে ইম্পিরিয়াল মসজিদ-ই ছিল তুরস্কের প্রধান মসজিদ।
আয়া সোফিয়ায় ঢুকে বিজয়ী সুলতান দ্বিতীয় মুহামমদ নির্দেশ দেন এটাকে সংস্কার করে একটি মসজিদে পরিণত করতে। তিনি এই ভবনে প্রথম শুক্রবারের নামাজ পড়েন।অটোমান স্থপতিরা আয়া সোফিয়ার ভেতরের অর্থডক্স খ্রীষ্টান ধর্ম সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতীক-চিহ্নগুলো সরিয়ে ফেলেন বা পলেস্তারা দিয়ে ঢেকে দেন। আয়া সোফিয়া মসজিদের অবস্থা তখন খুব খারাপ; এমনকি এর দরজাগুলিও ভেঙে নীচে পড়েছিল। সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মাদ এটির মেরামতের নির্দেশ দেন এবং স্থাপনাটিতে চারটি মিনার সংযুক্ত করেন। পরবর্তীতে ষোড়শ শতাব্দীতে দ্বিতীয় সুলতান সেলিমের শাসনামলে আয়া সোফিয়া মসজিদের বহিরাবরণকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এই কাজের দায়িত্ব পান তৎকালীন ওসমানীয় সাম্রাজ্যের বিখ্যাত স্থাপত্যশিল্পী মিমার সিনান। ইতিহাসে সিনান ছিলেন প্রথম স্থাপত্যশিল্পী যিনি তার নির্মিত স্থাপনাগুলোকে ভূমিকম্প প্রতিরোধক্ষম করে তৈরি করেছিলেন। আয়া সোফিয়া মসজিদকেও একই বৈশিষ্ট্য দেয়ার পর তিনি মসজিদের পশ্চিম পার্শ্বে আরো দু’টি মিনার সংযোজন করেন। পরবর্তীতে দ্বিতীয় সুলতান সেলিম ইন্তেকাল করলে ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে মসজিদের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে সুলতানের সমাধি স্থাপন করা হয়।
ওই সময়ে মসজিদটিতে আরো যেসব স্থান সংযোজন করা হয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সুলতানের বসার জায়গা, মরমর পাথরে তৈরি মিম্বার এবং মুয়াজ্জিনের জন্য একটি ছাদযুক্ত বারান্দা। ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন সুলতান প্রথম মাহমুদ আবার এই মসজিদ পুনর্নির্মাণের নির্দেশ দেন। এই সময়ে আয়া সোফিয়া মসজিদে একটি মাদ্রাসা সংযোজন করা হয় যেটি বর্তমানে লাইব্রেরিতে রূপ নিয়েছে। এই লাইব্রেরিতে রয়েছে তিন লাখেরও বেশি বই। সেইসঙ্গে এ সময়ে দরিদ্র মানুষদের তৈরি করা খাবার পরিবেশনের জন্য একটি বড় রান্নাঘর স্থাপন করা হয়। এই মসজিদে সবচেয়ে ব্যাপকভিত্তিক মেরামত ও পুনর্নির্মাণ কাজ হয় ১৮৪৮ ও ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে। সে সময় এই কাজে ৮০০ শ্রমিক নিয়োগ করা হয়। এবার মসজিদের পিলারগুলোতে বিশাল বিশাল গোলাকৃতি ফলক ঝুলিয়ে দেয়া হয়। এসব ফলকে শোভা পায় আল্লাহ তায়ালার গুণবাচক নামগুলো। পাশাপাশি বিশ্বনবী (সা.), আবুবকর, ওমর, ওসমান, আলী, হাসান ও হোসেইনের নামও এসব ফলকে স্থাপন পায়।আয়া সোফিয়া মসজিদের আয়তন প্রায় ছয় হাজার বর্গমিটার। চারটি বিশাল স্তম্ভের উপর মসজিদের মূল গম্বুজ স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া, মসজিদে রয়েছে মোট ১০৭টি স্তম্ভ ও নয়টি দরজা। মূল গম্বুজের নীচ দিয়ে মসজিদের ভেতরে সূর্যের আলো পৌঁছানোর জন্য স্থাপন করা হয়েছে ৪০টি জানালা। এসব জানালা দিয়ে মসজিদের সোনালী মোজাইকের উপর যখন সূর্যের আলো নিক্ষিপ্ত হয় তখন চমৎকার এক আধ্যাত্মিক পরিবেশ ও দৃশ্যের অবতারণা হয় যা দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। নীল মসজিদ সহ এ শহরের এবং বিশ্বের অন্য বহু মসজিদের নির্মাতাদের অনুপ্রাণিত করে এর স্থাপত্য।প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৮ সালে শেষ হলে অটোমান সাম্রাজ্য পরাজিত হয়। বিজয়ী মিত্রশক্তিগুলো তাদের ভূখন্ডকে নানা ভাগে ভাগ করে ফেলে।তবে ওই সাম্রাজ্যের অবশেষ থেকেই জাতীয়তাবাদী তুর্কী শক্তির উত্থান হয়। তারা প্রতিষ্ঠা করে আধুনিক তুরস্ক।তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা এবং ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট মুস্তাফা কামাল আতাতুর্ক আদেশ দেন, হাগিয়া সোফিয়াকে একটি জাদুঘরে পরিণত করতে। ১৯৩৪ সালে তুর্কি সেকুলার পার্টি এটিকে জাদুঘরে রূপ দেয়। আয়া সোফিয়া এখন তুরস্কের সবচেয়ে দর্শনীয় স্থান বলে স্বীকৃত। প্রতিবছর ৩৭ লক্ষ পর্যটক এটি দেখতে আসেন।
আয়া সোফিয়া মসজিদের মিহরাব
তবে এটিকে পুনরায় মসজিদ হিসেবে রূপান্তরের দাবি উঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। দীর্ঘদিন ধরে স্থাপনাটিকে মুসলিম উসমানীয় উত্তরাধিকার হিসেবে বিবেচনা করে আবার মসজিদে রূপান্তরিত করার জন্য চাপ দিচ্ছিল। ২০০৬ সালে তুর্কি সরকার মুসলমানদের নামাজ আদায় এবং খ্রিস্টানদের উপাসনার জন্য যাদুঘরের একটি অংশ বরাদ্দ দেন। ২০১৩ সালে মসজিদের মিনার থেকে প্রতিদিন দুই ওয়াক্ত নামাজের আজান প্রচার শুরু হয়।রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান তুরস্কের ক্ষমতায় আসার পর তিনিই পুরনো মসজিদ আয়া সোফিয়াকে পুনরায় মসজিদে রূপান্তরের দাবিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যান। ২০১৪ সালে আনাতোলিয়ান ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশন আয়া সোফিয়াকে মসজিদে পুনঃরূপান্তরের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে। এর স্লোগান ছিল 'জায়নামাজ নিয়ে আয়া সোফিয়ায় চলো'। এই আন্দোলনের সময় আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরের দাবিতে দেড় কোটি মানুষ স্বাক্ষর করেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দেন যে আয়া সোফিয়ার ব্যাপারে সরকার চিন্তাভাবনা করবে।২০১৫ সালে, একজন আলেম ৮৫ বছরের মধ্যে প্রথমবারের জন্য আয়া সোফিয়ার ভিতরে কোরআন তেলাওয়াত করেছিলেন। পরের বছর থেকে, তুরস্কের ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ পবিত্র রমজান মাস ও মুহাম্মদ (সা.) এর উপর কোরআন নাজিলের বছরকে কেন্দ্র করে কোরআন তেলাওয়াত ও সম্প্রচার শুরু করে। ২০১৮ সালে এরদোগান কোরআন তিলাওয়াত করে সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদসহ আয়া সোফিয়ার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা সকলের রুহের মাগফেরাতে কামনা করে মোনাজাত করেছিলেন। ইসলামপন্থী গোষ্ঠী এবং ধার্মিক মুসলমানরা দাবি করেন যে আয়া সোফিয়াকে আবার মসজিদে পরিণত করা হোক। তারা ওই আইনের বিরুদ্ধে ভবনটির বাইরে বিক্ষোভও করেন।তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বক্তব্যে এই দাবির প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। গত বছর স্থানীয় নির্বাচনের আগে এক প্রচার সভায় দেয়া বক্তৃতায় তিনি বলেন, আয়া
সোফিয়াকে জাদুঘরে পরিণত করা ছিল এক বিরাট ভুল।এরপর তিনি তার সহযোগীদের নির্দেশ দেন কিভাবে ভবনটিকে মসজিদে পরিণত করা যায় তা খতিয়ে দেখতে। আবার অন্যরা বিশ্বাস করেন, ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য সাইটের অংশ হিসেবে খ্রিস্টান ও মুসলিম সংহতির প্রতীক হিসেবে একটি যাদুঘর থাকা উচিত।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, গ্রিস ও ইউনেস্কো এই রায় প্রকাশের আগে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। ইস্টার্ন অর্থডক্স চার্চের প্রধান এর বিরোধিতা করেছেন। গ্রিস – যে দেশে লক্ষ লক্ষ অর্থডক্স খ্রীষ্টানের বাস – তারাও এর বিরোধিতা করেছে।গ্রিসের সংস্কৃতিমন্ত্রী লিনা মেনডোনি অভিযোগ করেন, তুরস্ক উগ্র জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় চেতনা জাগিয়ে তুলতে চাইছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, হাজিয়া সোফিয়ার মত একটি ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থানে ওই প্রতিষ্ঠানের আন্ত:-সরকার কমিটির অনুমোদন ছাড়া কোন পরিবর্তন করা যাবে না।ইউনেস্কোর উপপরিচালক আরনেস্তো রামিরেজ একটি গ্রিক সংবাদপত্রে দেয়া সাক্ষাতকারে এর সাথে একমত প্রকাশ করে বলেন, এরকম পরিবর্তন আনতে হলে ব্যাপকভিত্তিক অনুমোদন প্রয়োজন।আয়া সোফিয়ার আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে আঙ্কারার বক্তব্য হলো, এটি একান্তই তুরস্কের আভ্যন্তরীণ বিষয়।গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলেছিলেন যে, যারা আয়া সোফিয়া সম্পর্কে তুরস্কের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছে তারা সরাসরি তুরস্কের সার্বভৌমত্বের দিকে আঙুল তুলছে।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও গত সপ্তাহে একটি বিবৃতিতে তুরস্ক সরকারকে আয়া সুফিয়াকে জাদুঘর হিসেবে রাখার আহ্বান জানিয়েছিল।তখন তুর্কি প্রেসিডেন্ট উল্লেখ করেন, তুরস্কে ৪৩৫টি গীর্জা ও সিনাগগ রয়েছে যেখানে খ্রিস্টান ও ইহুদিরা প্রার্থনা করতে পারে।তুরস্কের প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ইব্রাহিম কালান গত ৯ জুলাই আনাদোলু এজেন্সিকে বলেন, নামাজের জন্য ইস্তাম্বুলের আয়া সোফিয়াকে পুনরায় খোলার ফলে এটি তার পরিচয় থেকে বঞ্চিত হবে না, বরং এটি সর্বদা বিশ্বের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত থাকবে।তিনি আরো বলেন, আমাদের প্রধান মসজিদগুলো যেমন ব্লু মসজিদ, ফাতিহ ও সুলায়মানিয়া মসজিদগুলো যেমন দর্শনার্থী এবং ইবাদতের জন্য উন্মুক্ত এটিও তেমনি থাকবে। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু জোর দিয়ে বলেছেন, এই ভবনটির অবস্থান তুরস্কের ভূখন্ডে, তাই এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে গ্রীসের কিছু বলার থাকতে পারে না।আমরা আমাদের দেশে আমাদের সম্পদ নিয়ে কী করছি তা আমাদের বিষয়।
আয়া সোফিয়া মসজিদের অযুখানা
হযরত উমার (রা)-এর আদেশে সাহাবী আবু উবাইদা (রা) জেরুজালেম অধিকার করবার জন্য এগিয়ে যান মুসলিম বাহিনীকে নিয়ে। সামনে সামনে ছিলেন খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা)। নভেম্বরে জেরুজালেমে এসে পৌঁছায় মুসলিম বাহিনী। ছয় মাস অবরোধ করে রাখার পর নগরকর্তা সোফ্রোনিয়াস আত্মসমর্পণ করতে রাজি হন। তবে শর্ত একটাই, হযরত উমার (রা)-কে নিজে আসতে হবে, তাঁর হাতেই সমর্পণ করবেন।
সোফ্রোনিয়াস অবাক বিস্ময়ে দেখলেন কোনো জাঁকজমক ছাড়াই হযরত উমার (রা) তাঁর দাস আর গাধা নিয়ে জেরুজালেম এসেছেন। তিনি ঘুরিয়ে দেখালেন পবিত্র শহরটি। যখন নামাজের সময় হলো, তখন সোফ্রোনিয়াস তাঁকে চার্চে আহ্বান করলেন, কিন্তু উমার “না” বললেন। তিনি জানালেন, এখন যদি তিনি এই চার্চে নামাজ আদায় করেন, তাহলে পরে মুসলিমরা এই চার্চ ভেঙে মসজিদ বানিয়ে ফেলবে। এতে খ্রিস্টানরা তাদের পবিত্র স্থান হারাবে। উমার (রা) এখানে কোনো জবরদস্তি করানো থেকে বিরত করলেন এ কারণে যে, এটাই সেই জায়গা যেখানে খ্রিস্টানরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে যীশু খ্রিস্ট ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন আর এখানের গুহাতেই তাঁর দেহ রাখা হয়েছিল। উল্লেখ্য, সেই চার্চ এখনো আছে, নাম হলো Church of the Holy Sepulchre. হযরত উমার (রা) চার্চের বাইরে বেরিয়ে নামাজ পড়লেন। পরে সেখানে আরেকটি মসজিদ বানানো হয়, নাম দেয়া হয় ‘মসজিদে উমার’। তবে উল্লেখ্য, কয়েক শতক পর (১০০৯ সালে) ফাতিমীয় খলিফা আল হাকিম উমার (রা) এর কথা সম্পূর্ণ অমান্য করে এই চার্চ ধ্বংস করে দেন, পরবর্তীতে তাঁর পুত্র খলিফা আজ-জহির চার্চটি আবার নির্মাণ করার অনুমতি দেন। ১০৪৮ সালে সেটি বানানো শেষ হয়।
Constantinople was a land taken by force (Jihad) and Constantine did not surrender with terms of peace. The legal basis in the Hanafi school (which the Ottomans followed) is to take everything in that land after conquest as ghanima (spoils of war) and doing with it as the Muslims see fit as per the Shariah.মুসলিম আইনশাস্ত্র (ফিকহ) অনুযায়ী কোন মুসলিম শহরে অমুসলিমদের জৌলুসপূর্ণ ধর্মীয় স্থাপনা থাকবে না, যা মসজিদের চেয়ে বৃহৎ ও অধিক দৃষ্টিগোচর।অতএব আয়া সোফিয়াকে চার্চ হিসেবে বহাল রাখার সুযোগ ছিল না। একটা উপায় ছিল ভেঙে ফেলা। কিন্তু এরচে’ উত্তম বিকল্প হল মসজিদে রূপান্তর। তাই (বহু সূত্রমতে) সুলতান খ্রিস্টানদের কাছ থেকে আয়া সোফিয়া কিনে নিয়ে স্থাপনাটি মসজিদে রূপান্তর করেন। ১৪৫৩ সালের ১ জুনে মসজিদে রূপান্তরিত আয়া সোফিয়ায় প্রথমবারের মত জুমার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়, যাতে ইমামতি করেন ফাতিহ-এর শিক্ষক শায়খ আক শামসুদ্দিন।
কিছু ভিডিও লিংক
1. https://youtu.be/ak6ch21Xopw

2. https://youtu.be/5IWL36lb0qU

3. https://youtu.be/MQ-2DzYsR9Y

4. https://youtu.be/3gPqrgzXcRI

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

যে গাছ ইহুদিদের আশ্রয় দেবে অর্থাৎ ইহুদিদের বন্ধু গাছ

রক্তপাতহীন মক্কা বিজয়ের দিন আজ

খন্দক যুদ্ধ কারণ ও ফলাফল