নবীজির ওফাত, দাফনে বিলম্ব ও খিলাফতের উদ্ভব
মো.আবু রায়হানঃ হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর তার দাফন ক্রিয়া সম্পন্ন করতে তিন দিন সময় লেগেছিল বলে যা প্রচলিত আছে তা সঠিক নয়।তিন দিন বলতে ৭২ ঘণ্টা বোঝায়।৩১ জানুয়ারি থেকে ১ মার্চ যেমন তিন মাস হয় না (বরং ত্রিশ দিন বা এক মাস হয়), তেমনি তিন দিনের নাম বললেই তিন দিন বা ৭২ ঘণ্টা হয় না।আসলে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দাফন সম্পন্ন হতে কত সময় লেগেছিল?বিশুদ্ধ হাদিস ও ঐতিহাসিকদের তথ্যমতে,নবীজি (সা.)-এর ওফাত হয়েছিল সোমবার দ্বিপ্রহরে মতান্তরে বিকেলে আর দাফন হয়েছিল বুধবার এশার সময়। তাহলে আরবি হিসাবে (সূর্যাস্ত থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এক দিন ধরে) সোমবার দিনের ১ ঘণ্টা বা ২ ঘণ্টা, মঙ্গলবার (সোমবার সূর্যাস্তের পর থেকে মঙ্গলবার সূর্যাস্ত পর্যন্ত) ২৪ ঘণ্টা এবং বুধবারের (সূর্যাস্তের পর থেকে এশা পর্যন্ত) ১ ঘণ্টা বা ২ ঘণ্টা (মোট ২৬ বা ২৮ ঘণ্টা)। বাংলা হিসাবে (সূর্যোদয় থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত এক দিন ধরে) সোমবারের (সোমবারের আসর থেকে মঙ্গলবারের সূর্যোদয় পর্যন্ত) ১৩ ঘণ্টা বা ১৪ ঘণ্টা এবং মঙ্গলবারের (সূর্যোদয় থেকে এশা পর্যন্ত) ১৩ ঘণ্টা বা ১৪ ঘণ্টা (সব মিলে ২৬ থেকে ২৮ ঘণ্টা)। ইংরেজি হিসাবে (মধ্যরাত থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত এক দিন ধরে) সোমবারের (আসর থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত) ৭ ঘণ্টা বা ৮ ঘণ্টা এবং মঙ্গলবারের (রাত ১২টা থেকে এশা পর্যন্ত) ১৯ ঘণ্টা বা ২০ ঘণ্টা (সব মিলে ২৬ থেকে ২৮ ঘণ্টা)। আরবি হিসাবে তিন দিন (সোমবার, মঙ্গলবার ও বুধবার), বাংলা ও ইংরেজি হিসাবে দুই দিন (সোমবার ও মঙ্গলবার); কিন্তু সময় ২৬ ঘণ্টা থেকে সর্বোচ্চ ২৮ ঘণ্টা মাত্র; যাকে তিন দিন তো দূরের কথা দুই দিনও বলা যাবে না। কারণ, কোনো সংখ্যা অর্ধেকের কম হলে পূর্ণ সংখ্যা বলা যায় না। সাধারণত অর্ধেকের কম হলে তা ধরা হয় না।প্রিয় নবীজি (সা.) এর দাফন বিলম্বিত হওয়ার কারণ- মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মৃতদের দাফন দ্রুত সম্পন্ন করো, বিলম্ব কোরো না।’(বুখারি, হাদিস- ১৩১৫) তার পরও মহানবী (সা.)-এর জানাজা ও দাফন বিলম্বিত হয়েছে। এর কারণ হল-
ক.প্রিয় নবীজি (সা.) ইন্তেকালের আগে কয়েকবার অজ্ঞান হয়েছিলেন এবং পুনরায় সুস্থ হয়েছিলেন। তাই ১২ রবিউল আউয়াল ইন্তেকাল করলেও তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। দীর্ঘ সময় পর যখন তাঁর ইন্তেকাল নিশ্চিত হয়, তখন মধ্যরাত। সকালে যখন তাঁর মৃত্যুর খবর সাহাবায়ে কেরাম শুনলেন, তখন অনেকেই তা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। যেমন হযরত ওমর (রা.) নবীজি (সা.)-এর ইন্তেকালের খবর শুনে পাগলপ্রায় হয়ে গেলেন।তিনি তরবারি হাতে নিয়ে বের হলেন আর বললেন: ‘যে বলবে রাসুল (সা.) ইন্তেকাল করেছেন, আমি তাকে হত্যা করব।ইন্তেকালের খবরে আবু বকর (রা:) সুন্হ নামক আবাসস্থল থেকে ঘোড়ায় চড়ে ফিরে আসলেন।ঘোড়া থেকে নামার পর মসজিদে প্রবেশ করলেন।কারো সাথে কোন কথা না বলেই আয়েশা (রা) এর ঘরে প্রবেশ করে রাসূল (সা) এর দিকে গেলেন। সেসময় তিনি হাবিরা নামক স্থানে কাপড় দ্বারা আবৃত ছিলেন।আবু বকর (রা:) নবীজির চেহারা মুবারক হতে কাপড় সরিয়ে তাঁকে চুম্বন করলেন এবং কাঁদতে লাগলেন অতঃপর বললেন- আপনার জন্য আমার পিতা-মাতা কুরবান হোক, নিশ্চয় আল্লাহ আপনাকে দুবার মৃত্যু দিবেন না। আপনার উপর যে মরণ লিখা হয়েছিল তা হয়ে গেছে।"O Messenger of Allah! May my father and mother be sacrificed for you! You are as beautiful as you were alive. The institution of prophethood ended with your death. Your fame and honor is so great that you are free from crying over it. O Muhammad! Do not forget us near your Lord! Remember us!"আবূ বকর (রা) সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে মসজিদে নববিতে ডেকে একত্র করে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন।তাতে তিনি বললেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: ‘কুল্লু নাফছিন যায়িকাতুল মাউত’,অর্থাৎ ‘জীবনমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।’(সুরা আলে ইমরান, আয়াত -১৮৫)। তিনি আরও বলেন, কোরআন করিমে এরশাদ হয়েছে: ‘হযরত মুহাম্মদ (সা.) অবশ্যই একজন রাসুল, তাঁর পূর্বে বহু রাসুল (আ.) গত হয়েছেন। তবে যদি তিনি মৃত্যুবরণ করেন অথবা শহীদ হন, তবে কি তোমরা পেছন দিকে ফিরে যাবে?’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত -১৪৪)।( 'Muhammad is no more than an Messenger: many were the Messengers that passed away before Him. If he died or was slain, will ye then turn back on your heels? If any did turn back on his heels, not the least harm will he do to Allah; but Allah (on the other hand) will swiftly reward those who (serve him) with gratitude.'(Aal-i Imran, 3/144 ).মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরও বলেন: ‘(হে নবী! (সা) নিশ্চয় আপনি মরণশীল এবং তারাও মরণশীল। (সুরা জুমার, আয়াত- ৩০)।হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর বক্তব্যে সাহাবায়ে কেরাম নিশ্চিত হলেন নবী করিম (সা.) ইন্তেকাল করেছেন। এরপর প্রিয় নবীজি (সা.)-কে শেষ দেখা ও তাঁর প্রতি সালাত ও সালাম, দোয়া-কালাম পেশ করতে থাকলেন তাঁরা। বুখারি শরিফের হাদিসের বর্ণনামতে , নবী-রাসুলদের এই স্বাধীনতা দেওয়া হয় যে আপনি কি পৃথিবীতে থাকতে চান? না কি চলে যেতে চান। কিন্তু নবী-রাসুলরা চলে যাওয়াকেই প্রাধান্য দিয়েছেন (বুখারি, হাদিস - ৬৫০৯)। ওফাতের সময় ছিল ১১ হিজরি, মাসটি ছিল রবিউল আউয়াল, আর তারিখ ছিল ১২, দিনটি ছিল সোমবার, বয়স ছিল ৬৩, ওফাতের স্থান হযরত আয়েশা (রা.)-এর হুজরা—তাঁর কোল।
খ. মহানবী (সা.)-কে কোথায় দাফন করা হবে, তা সাহাবায়ে কেরামের জানা ছিল না। ফলে তাঁদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। কেউ কেউ বলেন, জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হোক, কেউ কেউ বলেন, মসজিদ-ই-নববীতে দাফন করা হোক, আবার কেউ কেউ প্রস্তাব করেন হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর পাশে সমাহিত করা হোক। এমতাবস্থায় হযরত আবু বকর (রা.) বলেন,আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, নবী যেখানেই মৃত্যুবরণ করেন সেখানেই সমাহিত হন। ("Every prophet is buried in the place where he dies.")অতঃপর হযরত আয়েশা (রা.)-এর হুজরায় যেখানে রাসুল (সা.) ইন্তেকাল করেন, সেখানে সমাহিত করার ব্যাপারে একমত হন।
গ. একের পর এক সাহাবি দুর দূরান্ত থেকে আসতে থাকলেন। এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকল কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত। তারপর নবীজি (সা.)-কে দাফন করা হয়।
ঘ.খলিফা নির্বাচনে ঐকমত্যে পৌঁছতে বিলম্ব : মহানবী (সা.)-এর স্থানে কে রাষ্ট্রের খলিফা হবেন, এ নিয়ে আনসার ও মুহাজিরদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিয়েছিল। পরবর্তী সময় হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর ব্যাপারে সবাই ঐকমত্যে পৌঁছলে মহানবী (সা.)-এর দাফনের কাজ সম্পন্ন করা হয়। উল্লেখ্য, প্রচলিত নিয়মে জামাত করে নবীজির জানাজার নামাজ পড়া হয়নি, এর প্রয়োজনও ছিল না। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)। মঙ্গলবার তাঁকে গোসল দেওয়া হয়। গোসল দিয়েছেন হযরত আব্বাস (রা.), হযরত আলী (রা.), হযরত আব্বাস (রা.)-এর দুই ছেলে ফজল ও সাকাম, রাসুল (সা.)-এর আজাদকৃত ক্রীতদাস সাকরাম, ওসামা বিন যায়েদ ও আউস ইবনে খাওলা (রা.)। গোসলের পর বিশ্বনবী (সা.)-কে তিনটি ইয়েমেনি সাদা কাপড়ে কাফন পরানো হয়, অতঃপর ১০ জন ১০ জন করে সাহাবায়ে কেরাম হুজরায় প্রবেশ করে পর্যায়ক্রমে জানাজার নামাজ আদায় করেন। নামাজে কেউ ইমাম ছিলেন না। সর্বপ্রথম বনু হাশিম গোত্রের সাহাবিরা, তারপর মুহাজির, অতঃপর আনসার, তারপর অন্যান্য পুরুষ সাহাবি, অতঃপর মহিলা ও সর্বশেষে শিশুরা জানাজার নামাজ পড়ে। জানাজার নামাজ পড়তে পড়তে মঙ্গলবার সারা দিন অতিবাহিত হয়ে যায়। মঙ্গলবার দিবাগত রাতে আমাদের প্রিয় নবী (সা.)-কে হযরত আয়েশা (রা.)-এর হুজরায় দাফন করা হয়।
খিলাফত-খিলাফত শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে আরবি খলিফা শব্দ থেকে। খলিফা শব্দের বহুবচন খুলাফা এবং খালাইফ।খলিফা শব্দটি আরবি খলফ শব্দ থেকে এসেছে; যার অর্থ প্রতিনিধি, উত্তরাধিকারী, স্থলাভিষিক্ত হওয়া, ইমারত,ইমামত,শাসন,কর্তৃত্ব প্রভৃতি।Caliphate implies a politico-religious Muslim state governed by a caliph.পারিভাষিক অর্থে ‘আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও আইনগত কর্তৃত্বকে স্বীকার করে নিয়ে পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর মৌলিক নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে পরিগঠিত রাষ্ট্র ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনাকে ইসলামী খেলাফত বলা হয়। A caliphate is an Islamic state. It's led by a caliph, who is a political and religious leader who is a successor (caliph) to the Islamic prophet Muhammad. His power and authority is absolute.খিলাফত হল সরকারের ইসলামী রুপ যা মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক একতার প্রতিনিধিত্ব করে। ইসলামে খিলাফত এমন একটি শাসনব্যবস্থার নাম যা মহান আল্লাহর বিধান ও মহানবী (সা)-এর সুন্নাহ দ্বারা পরিচালিত। এই শাসনব্যবস্থায় সার্বভৌমত্বের অধিকারী একমাত্র মহান আল্লাহ। এই ধরনের শাসন ব্যবস্থার সরকার প্রধানকে খলিফা বলা হয়। ইসলামী পরিভাষায় খলিফা হলেন এমন ব্যক্তি যিনি যাবতীয় বিষয়ে শরীআত অনুযায়ী সমস্ত উম্মাতকে পরিচালিত করেন। ইসলামী রাষ্ট্রে খলিফা সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী। তিনি রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে গভর্নর, শাসক, নেতা, কাজি নিযুক্ত করেন।আল-আহকামুস সুলতানিয়া গ্রন্থের লেখক আল-মাওয়ার্দির মতে, 'মহানবী (সা.)-এর উত্তরাধিকারী শাসকই খলিফা।' আর খলিফা শাসিত অঞ্চলই খিলাফত। অর্থাৎ মহানবী (সা.)-এর তিরোধানের পর তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে যিনিই ইসলামী রাষ্ট্রের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন, তিনিই খলিফা এবং সেই খলিফা যেসব অঞ্চলের ওপর তাঁর শাসন বলবৎ করতে সক্ষম হয়েছেন, সেই অঞ্চলগুলো খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত। কিতাবুল ইবার গ্রন্থের লেখক ইবনে খালদুন বলেন, 'খিলাফত হলো এমন একটি প্রতিষ্ঠান; যা মুহাম্মদ (সা.)-এর মিশনের প্রতিনিধিত্ব করে।' যদিও টি. ডাব্লিউ আরনল্ড তাঁর দ্যা খিলাফত গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে খলিফা শব্দটির রাজনৈতিক ব্যবহার জাহেলিয়া যুগেও প্রচলিত ছিল। তবে অন্য কোনো সূত্র তাঁর উপরোক্ত মতকে সমর্থন করেনি। বরং আধুনিক গবেষকরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে হযরত আবু বকর (রা.)-এর খলিফা উপাধি গ্রহণের মধ্য দিয়ে এর প্রচলন হয়েছে। তবে খলিফা আবু বকর (রা.)-এর খলিফা উপাধি গ্রহণের অনেক আগে আল কোরআনে ওই শব্দের ব্যবহার আমরা লক্ষ করেছি। এ প্রসঙ্গে কুরআনুল কারিমে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার ও সৎকর্মশীল আল্লাহ তাঁদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তিনি অবশ্যই তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন।’ (সুরা আন নুর - ৫৫)।
খিলাফাতের উদ্ভব-হযরত মোহাম্মদ (সা)-এর মৃত্যুর পর ইসলামি রাষ্ট্রে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। খলিফা ছিলেন মুসলমানদের শাসক ও সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা।তিনি ছিলেন ইসলামি ভূ-খন্ডের রক্ষক, প্রধান বিচারপতি এবং রাষ্ট্রের সংগঠক ও প্রশাসক। হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকার নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। যতদিন হযরত মুহাম্মাদ (সা) জীবিত ছিলেন, ততদিন কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু তাঁর ইন্তেকালের সাথে সাথেই সমস্যা শুরু হয়। ইতিহাসবিদ P.K Hitti বলেন,The caliphate is therefore the first problem Islam had to face.” অন্যান্য সাম্রাজ্যের মতো কি ইসলামেও নেতৃত্ব রক্তের সম্পর্কের মাধ্যমে স্থলাভিষিক্ত হবে, নাকি অভিজ্ঞতায় বলিষ্ঠতা কার বেশি সেটা দেখা হবে? যদি রক্তের সম্পর্কই মানা হয় তবে মুসলিম বিশ্বের প্রথম খলিফা হবার কথা ছিল হযরত আলী (রা) এর, যিনি ছিলেন নবী (সা) এর চাচাতো ভাই, জামাতা। তিনি আলী (রা) এর মর্যাদার কথা বলে থাকলেও স্পষ্ট করে কখনো এ বাক্য বলে যাননি– “আমার পরে আলীই হবে প্রথম খলিফা এবং এ কারণেই যত চিন্তা শুরু হয়।খলিফা নির্বাচন নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে কয়েকটি দলের উদ্ভব হয়।
ক. কুরাইশ- কুরাইশরা ছিল আরবদের অভিজাত বংশ।মহানবী এই কুরাইশ বংশের ছিলেন। অতএব তাঁরা দাবি করলেন যে, তাদের কুরাইশ বংশের লোককেই খলিফা নিযুক্ত করা উচিৎ।
খ. হযরত আলীকে খলিফা নির্বাচনে একটি গোষ্ঠী তৎপর হয়ে উঠে। অথচ হযরত আলী কিছুই জানতেন না। তখন আলী (রা) নবী করীম (সা) এর জানাজার প্রস্তুতি এবং সেই সংক্রান্ত কাজ করছিলেন। যিনি বাল্যকাল থেকে মহানবীর (সা.) পবিত্র কোলে লালিত-পালিত হয়েছেন । যিনি কম বয়সে ইসলাম কবুল করেন। যার জ্ঞানের তোরণ অতিক্রম করে মহানবীর জ্ঞানের মহানগরীতে পদার্পন করতে হয় ।নবীজী (সা.) তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন,আমি হলাম জ্ঞানের নগরী আর আলী হচ্ছে তার দরজা ।আলীর সমর্থকরা(তখনো শিয়া নামে তারা পরিচিত ছিলেন না) বলেন গাদির খুমের ঘটনার দিন আলী (রা)-কে নবী (সা) খলিফা নির্বাচিত করে যান।
গ. মুহাজের - মক্কা থেকে যারা হিজরত করে মদিনা গিয়েছিলেন তারা ছিলেন মুহাজের।তারা নিজেদের মধ্য থেকে নেতা নির্বাচনের পক্ষে ছিল। মোহাজেররা ইসলামের প্রথম বিশ্বাসী হিসাবে নিজেদের গোত্র থেকে খলিফা নির্বাচনের প্রস্তাব করেন। এছাড়া তাঁরা আরও দাবী করেন যে, তারা মহানবীর সগোত্রের লোক।
ঘ. আনসার-যারা হিজরতের পর মদিনায় মুসলমানদের সাহায্য করেছিলেন তাদের বলা হয় আনসার। আনসারগণ দাবী করলেন যে, শত বিপদ আপদ উপেক্ষা করে তাঁরা ইসলাম ধর্ম, মহানবী ও তার অনুসারীদিগকে রক্ষা করেছেন এবং মদীনায় আশ্রয় দিয়েছেন। অতএব তাঁদের দল থেকেই খলিফা নির্বাচিত হওয়া উচিৎ।আনসাররা মদিনার সাকিফা বনু সায়িদা নামক স্থানে একত্রিত হয়েছিল আলোচনা করবার জন্য যে তারা কাকে নেতৃত্ব দেবেন। অনেকটা যেন গৃহযুদ্ধ কিংবা অন্তত শীতল যুদ্ধ হতে চলেছে, খলিফা কি আনসারদের থেকে হবেন নাকি মুহাজেরদের থেকে? আনসারগণ খাযরাজ গোত্রের নেতা সাদ বিন ওবায়দাকে খলিফা পদের জন্য মনোনীত করলেন।এ ব্যাপারটি জানবার সাথে সাথেই আবু বকর,উমর,আবু উবায়দা প্রমুখ ছুটে গেলেন সেখানে। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠল যখন আনসাররা আনসার ও মুহাজির উভয় থেকে দুজন খলিফা নির্বাচনের প্রস্তাব করেন।ওমর বলেন এক খাপে যেমন দুটি তলোয়ার রাখা যায় না তেমনি একই সঙ্গে দুজন খলিফা অসম্ভব।তখন আবু বকর, ওমর অথবা আবু ওবায়দাকে খলিফা হিসাবে মনোনীত করার কথা উত্থাপন করেন। কিন্তু তাঁরা উভয়েই এই প্রস্তাব আবু বকরের অনুকূলে প্রত্যাখ্যান করলেন। প্রস্তাব করা হয় আবু বকর (রা)-এরই খলিফা হওয়া উচিৎ। কারণ তিনি সবচেয়ে অভিজ্ঞ, আর নবীজীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, বিপদের বন্ধুও বটে। (উল্লেখ্য, আলী (রা) এর বয়স তখন যথেষ্ট কম, প্রায় ৩২ । তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন না )। উপস্থিত জনতার উদ্দেশে ওমর (রা.) এক যুগান্তকারী ভাষণ দেন।"O Abu Bakr! You led the prayer to the Muslims upon the order of the Messenger of Allah. You are his caliph and we pay allegiance to you. We pay allegiance to you, who are more beloved to the Messenger of Allah than all of us." রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে আবু বকর (রা.)-এর সম্পর্ক, ইসলামের জন্য আবু বকর (রা.)-এর ত্যাগ নিয়ে কথা বলেন। জনগণ সমর্থন জানায়। জনগণের মতামতের ওপর ভিত্তি করে আবু বকর (রা.) ইসলামের প্রথম খলিফা বা রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে নির্বাচিত হন।ওমর ইবনুল খাত্তাব,আবু ওবায়দা আবু বকরের হাত ধরে তারা আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করলেন।ওমর ও আবু ওবায়দার আনুগত্যের পর আনসারগণ দলে দলে এগিয়ে এসে আবু বকরের নেতৃত্ব স্বীকার করলেন।ওমর ফারুক (রা.)-এর উপস্থিত বুদ্ধিমত্তায় শিশু ইসলামি রাষ্ট্রের সেই সংকট দূরীভূত হয় এবং এভাবে ৬৩২ সালে উদ্ভব ঘটে ইসলামের ইতিহাসে নতুন ধর্মীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের যা খিলাফত নামে সমধিক পরিচিত।With Muhammad’s death in 632 CE, disagreement broke out among his followers over deciding his successor. Muhammad’s prominent companion Umar ibn al-Khattab nominated Abu Bakr, Muhammad’s friend and collaborator. With additional support, Abu Bakr was confirmed as the first caliph (religious successor to Muhammad) that same year. আবু বকর (রা.) ছিলেন বয়স্কদের মধ্যে প্রথম পুরুষ মুসলমান।তিনি ছিলেন রাসুল (সা.)-এর মিরাজ গমনের সত্যায়নকারী।মহানবী (সা.)-এর হিজরতের সঙ্গী। ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ পুরুষ ও রাসুলের একান্ত কাছের মানুষ। রাসুল (সা.)-এর জীবদ্দশায় অসুস্থতার সময় আবু বকর (রা.) জামাতে নামাজের ইমামতি করেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস-৭১৩)।মুসলমানদের জামাতের ইমামতিও খেলাফতের ইঙ্গিত বহন করে। এ ছাড়া হাদিসে এসেছে, ‘এক নারী মহানবী (সা.)-এর কাছে এলো। তিনি তাঁঁকে আবার আসার জন্য বললেন। ওই নারী বলল, আমি এসে যদি আপনাকে না পাই তাহলে কী করব? মহানবী (সা.) বলেন, যদি আমাকে না পাও, তাহলে আবু বকরের কাছে আসবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস - ৩৫৫৯)।এ হাদিসটি স্পষ্টভাবে আবু বকর (রা.)-এর খলিফা হওয়ার প্রমাণ বহন করে। সুন্নিরা তাকে খলিফাতুর রাসুল’ বা ‘আল্লাহর রাসুলের উত্তরাধিকারী’ বলে সম্মান করে থাকে। যদিও শিয়ারা আবু বকরকে বৈধ খলিফা বলে স্বীকার করে না। শিয়া মতাদর্শ অনুযায়ী,হযরত আলী প্রথম খলিফা হিসেবে যোগ্য।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন